সিরিয়ার জনগণ, অন্তত তাদের বেশির ভাগই আজ উল্লাসে মেতে উঠেছে। তারা এই মুহূর্তটি উপভোগ করুক। এই উল্লাস তাদের প্রাপ্য।
সিরিয়ার জনগণ, অন্তত তাদের বেশির ভাগই আজ উল্লাসে মেতে উঠেছে। তারা এই মুহূর্তটি উপভোগ করুক। এই উল্লাস তাদের প্রাপ্য।

মতামত

স্বৈরাচারী বাশারের পতনের পর সিরিয়ায় এখন কী হবে

এখানে ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটি ব্যবহার করা যথার্থ হবে। কারণ, বাশার আল-আসাদের শাসনের পতন ঘটেছে। ৫০ বছরের বেশি সময়ের নির্মম স্বৈরশাসন এবং ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধ ও সীমাহীন কষ্টের পর যা ঘটেছে, তা যুগান্তকারী ঘটনা।

সিরিয়ার জনগণ, অন্তত তাদের বেশির ভাগই আজ উল্লাসে মেতে উঠেছে। তারা এই মুহূর্তটি উপভোগ করুক। এই উল্লাস তাদের প্রাপ্য। এই উদ্‌যাপন ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পরের আনন্দোৎসবের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এই স্মৃতিগুলো আমাদের জন্য সতর্কবার্তা এবং হুমকি।

সতর্কবার্তাটি হলো, যদি আসাদের স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোর আকস্মিক পতন নিয়ন্ত্রণহীন বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়, তাহলে জনতার এই আনন্দ অতি শিগগিরই কান্নায় পরিণত হতে পারে। আর হুমকিটা হলো, সিরিয়ায় এখন যে রাজনৈতিক ও সামরিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা এমন সব স্বার্থান্বেষী শক্তির দখলে চলে যেতে পারে, যারা ন্যায়বিচার ও মিলমিশের চেয়ে ক্ষমতা ও প্রতিশোধে বেশি আগ্রহী।

সিরিয়ায় প্রতিশোধ হলো এমন একটি ‘খাবার’, যা গরম-গরম পরিবেশন করা হয় এবং এটি এখন আবার ‘মেনুতে’ ফিরে এসেছে।

২০১১ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম সিরিয়ার দারায় একটি জনবিদ্রোহ থেকে আসাদকে উৎখাত করার প্রচারণার সূচনা হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে ইদলিবের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ঘাঁটি গড়ে তোলা জঙ্গি গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) সফল অগ্রযাত্রা এবং জনগণের সহায়তায় রাজধানী দামেস্কের পতন একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়েছে। সেই দিক থেকে এটিকে জনতার বিপ্লব বলা যেতে পারে।

তবে এইচটিএস নেতা আবু মুহাম্মদ আল-জোলানির অধীনে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা এখনো কেউ বলতে পারে না।

একসময় আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত থাকা জঙ্গি এবং মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত জোলানি এখন জাতীয় মুক্তির নায়ক হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন। তবে ইদলিবে তাঁর নেতৃত্বাধীন এইচটিএস মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং স্বৈরশাসনের রেকর্ড রেখে গেছে।

জোলানির বাহিনী যখন দক্ষিণে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন সিরিয়ার বহু মানুষ এইচটিএসের পতাকাতলে শামিল হয়েছে। তবে অন্যান্য গোষ্ঠীও (যাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভিন্ন) এই সংকট থেকে ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে রয়েছে উত্তর-পূর্বের কুর্দি নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী মিলিশিয়াদের একটি জোট; মার্কিন সমর্থিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস; তুর্কি সমর্থিত বিদ্রোহী দলগুলো (যাদের একত্রে বলা হয় সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) এবং দক্ষিণের বিরোধী গোষ্ঠীগুলো। এরা আসাদের প্রতি ঘৃণার দিক থেকে এসটিএসের সঙ্গে এক হলেও অন্য কোনো বিষয়ে একমত নয়।

যুদ্ধের আগে সিরিয়া ছিল বহুজাতিক, বহুধর্মীয়, সহনশীল এবং ধর্মনিরপেক্ষ। এখন কি সেই পুরোনো সিরিয়া আবার গড়ে তোলা সম্ভব? জোলানি কি দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য? অথবা অন্য কেউ কি এই বিশৃঙ্খলা ও বিভাজন ঠেকাতে পারবে? এখনো এসব প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই।

যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপের দেশগুলো সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে সমানভাবে অবাক হয়েছে। এটি একটি বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতা। তবে সিরিয়ার যুদ্ধে পশ্চিমের দীর্ঘ ব্যর্থতার রেকর্ড রয়েছে। তারা এখানকার সন্ত্রাস, যুদ্ধাপরাধ এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের মতো ঘটনার দিকে অনেকটাই চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। এখনো পশ্চিমারা নীরব দর্শক হয়ে আছে।

আসাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজি জালালি ঘোষণা দিয়েছেন, আসাদের মতো তিনি পালাবেন না। বরং তিনি নিজের জায়গায় থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে কাজ করতে চান। তাঁর কথাগুলো সাহসী। আশা করা যায়, তিনি তাঁর কথায় অটল থাকতে পারবেন।

সামনের চ্যালেঞ্জগুলো সত্যিই ভয়ংকর। গৃহযুদ্ধে তিন লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। কেউ কেউ বলছেন, এই সংখ্যা এর দ্বিগুণও হতে পারে।

২০১১ সাল থেকে প্রায় এক লাখ মানুষ নিখোঁজ বা গুম হয়েছেন। তাঁরা কোথায়? এই ভয়ংকর হিসাব এখন শুরু হবে। প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা বা ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ বিচার ছাড়াই আটক ছিলেন। তাঁদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়েছে।

এখন বন্দিশিবিরগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে আহত এবং প্রতিশোধপরায়ণ মানুষের ঢল ভেঙে পড়া সমাজে ফিরছে। তুরস্ক ও জর্ডানে অবস্থানরত লাখ লাখ শরণার্থী হয়তো একসঙ্গে দেশে ফেরার চেষ্টা করবে। সামনে মানবিক ও নিরাপত্তাজনিত বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রবল।

সিরিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিদেশি হস্তক্ষেপ দেশটির সংকটের মূল অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসাদের পতন তাঁর প্রধান সমর্থক রাশিয়া ও ইরানের জন্য একটি বড় পরাজয়।

২০১৫ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সিরিয়ার গণতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলোকে সমর্থন দেওয়ার বদলে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইকে অগ্রাধিকার দিলে ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়ায় প্রবেশ করেন। রাশিয়ার বিমানবাহিনী এবং ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এর বিনিময়ে পুতিন সামরিক ঘাঁটি এবং কৌশলগত সুবিধা অর্জন করেন। এখন এই সবকিছু ঝুঁকির মুখে।

ইরানের জন্য সিরিয়ার পতন আরেকটি বড় ধাক্কা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে দুর্বল করেছে। আর হিজবুল্লাহ আসাদের জন্য বড় সমর্থক গোষ্ঠী ছিল। এতে ইরানের অবস্থান আরও বিপদে পড়েছে।

শোনা যাচ্ছে, দামেস্কে ইরানের দূতাবাস আক্রমণের শিকার হয়েছে, আর তাদের কূটনীতিকেরা পালিয়ে গেছেন। তবে রাশিয়া ও ইরান সহজে হার মানবে না। তারা নতুন পরিস্থিতি নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। আর এটি সিরিয়ার মানুষের জন্য ভালো নাও হতে পারে।

ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। হামাস এবং ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে ইসরায়েল দামেস্কসহ সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানে ইরান ও হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তু বলে দাবি করা জায়গাগুলোতে বারবার বোমা হামলা চালিয়েছে।
তেহরান মনে করে, আসাদের পতনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে। এখন ইসরায়েল তার সীমান্তের একটি ভেঙে পড়া রাষ্ট্রকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। আসাদের রাসায়নিক অস্ত্র কার দখলে যাচ্ছে এবং ইসলামপন্থী জঙ্গিদের হুমকি কতটা থাকছে, তা নিয়ে তারা চিন্তিত।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সম্ভবত এইচটিএস-কে আসাদের বাফার জোন তৈরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর আক্রমণ শুরু করার সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন। কুর্দি ‘হুমকি’ নিয়ে তাঁর উদ্বেগ রয়েছে। তাই তিনি আরও সেনা সীমান্তে পাঠাতে পারেন।

তবে এরদোয়ান কি আসাদের শাসন ভেঙে পুরো সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চেয়েছিলেন? এই পরিবর্তন কীভাবে তুরস্কের স্বার্থে কাজ করতে পারে, এর ব্যাখ্যা হয়তো তিনিই দিতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপের দেশগুলো সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে সমানভাবে অবাক হয়েছে। এটি একটি বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতা। তবে সিরিয়ার যুদ্ধে পশ্চিমের দীর্ঘ ব্যর্থতার রেকর্ড রয়েছে। তারা এখানকার সন্ত্রাস, যুদ্ধাপরাধ এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের মতো ঘটনার দিকে অনেকটাই চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। এখনো পশ্চিমারা নীরব দর্শক হয়ে আছে।

আরব দেশগুলোর কাছ থেকেও কোনো সাহায্য আশা করা যায় না। এক বছর আগে আসাদ আরব লিগ সম্মেলনে তাঁর আন্তর্জাতিক দুর্নাম দূর করে ফিরে এসেছিলেন। সৌদি বাদশাহ মোহাম্মদ বিন সালমানসহ অনেকেই তাঁকে আরব লিগে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

তবে আসাদ আগে যেমন বর্বর ছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা-ই থেকে গেছেন। সিরিয়ার জনগণের ওপরই এখন দেশটিকে বাঁচানোর দায়িত্ব পড়েছে। কারণ, আর কেউ তাদের সাহায্য করবে না।

  • গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
    সাইমন টিসডাল অবজারভার-এর পররাষ্ট্র–সংক্রান্ত বিশ্লেষক