ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিল, সেই ছাত্ররা এখনো রাজপথে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। ফলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন অভিভাবকহীন।
কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ–উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তেমন পরিবর্তন না হলেও সেখানে খুব একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে না।
বাস্তবতা হলো, গত পবিত্র ঈদুল আজহার পর থেকে দেশের পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হচ্ছে না। প্রথমে ছিল শিক্ষকদের ধর্মঘট; শেখ হাসিনা সরকার তাতে খুব একটা পাত্তা দেয়নি এবং তারপর শুরু হয় কোটাবিরোধী আন্দোলন। এরপর তো ইতিহাস।
এই গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার বাস্তবতা ছিল; ইতিহাসে বরাবরই দেখা গেছে, বাঙালি বিদ্রোহ করতে ওস্তাদ; কিন্তু বিদ্রোহের পরবর্তী যে গড়ার কাজ, সে ক্ষেত্রে বরাবরই পিছিয়ে।
এখন এই বিদ্রোহের ফসল পুরোপুরি ঘরে তুলতে ছাত্রদের দ্রুত পড়াশোনায় মন দেওয়া দরকার। পড়াশোনার মানোন্নয়ন না হলে কোনো অভ্যুত্থানই শেষবিচারে সফল হয় না।
শিক্ষাঙ্গনে জুলাই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় প্রভাব অনুভূত হচ্ছে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে। এই সম্পর্ক আগের মতো থাকবে না বলেই ধারণা করা যায়। যদিও এখন যা ঘটছে, তা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত হয়। নতুন এই বাস্তবতা শিক্ষকেরা কীভাবে সামলাবেন, তা এখন দেখার বিষয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক আশঙ্কার কথা জানালেন। আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষক বলেছিলেন, জীবনে এমন অপমানের শিকার হইনি। যাহোক, নতুন বাস্তবতায় আমাদের সেই পুরোনো মানুষেরাই থাকবেন; সবাই মিলেই নতুন পৃথিবী বিনির্মাণ করতে হবে।
ভাঙার চেয়ে গড়া অনেক কঠিন। বলা যায়, প্রকৃত সংগ্রাম শুরু হবে এখন। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা পাঠদানের সহায়ক নয়। সবাই রাজা হয়ে গেলে মুশকিল; সেই সঙ্গে শিক্ষকেরা যদি শ্রেণিকক্ষে যেতে ভয় পান, তাহলে পড়াশোনা যা–ও এত দিন ছিল, তা–ও থাকবে না।
যে শিক্ষকেরা সরাসরি ছাত্রদের সমর্থনে রাস্তায় নামেননি, তাঁরা শুধু যে এ কারণে আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন, ঢালাওভাবে এমন ট্যাগিং করা কাজের কথা নয়।
অনেকে অনেক কারণে মাঠে নামতে পারেননি। প্রশাসনের যাঁরা কর্তাব্যক্তি ছিলেন, তাঁদের বিষয় ভিন্ন। আবার সেই তাঁরাও এখন ছাত্রদের শ্রেণিকক্ষে পড়াবেন; সরকারের অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মতো তাঁদের তো বদলি করা যাবে না।
ফলে জটিল বাস্তবতার দিকেই আমরা এগোচ্ছি। ছাত্র ও কর্তাব্যক্তিদের তা মাথায় রাখতে হবে। এই বিনির্মাণের সময় প্রয়োজন তিতিক্ষার। নতুন সামাজিক সম্পর্ক নির্মাণে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
পরিবর্তিত বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রদের চাওয়া অবশ্যই গুরুত্ব পাওয়া উচিত। তবে মাটি এখনো নরম; আমরা চাইলে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে নতুন সম্পর্ক নির্মাণে ব্রতী হতে পারি।
এ পরিস্থিতিতে শিক্ষকেরা ছাত্রদের সঙ্গে মুক্ত সংলাপ করতে পারেন; তাঁদের চাওয়া-পাওয়া গুরুত্বের সঙ্গে শুনতে পারেন। সেটা হলে অন্তত আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অবস্থা, অন্যদিকে স্কুল-কলেজগুলোয় চলছে আরেক পরিস্থিতি। শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিক্ষকদের সঙ্গে বেয়াদবি করছে, এমনকি গায়ে হাত তোলার মতো গর্হিত কাজও করছে।
কিন্তু খালি চোখে যা দেখা যায়, সেটাই সত্যের একমাত্র রূপ নয়। এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে, একদল শিক্ষক প্রশাসনিক পদ পাওয়ার লোভে অন্য শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ব্যবহার করছেন।
এসব দেখে স্বাভাবিকভাবেই অনেকে বিস্মিত, ক্ষুব্ধ, হতাশ হচ্ছেন। সব দোষ গিয়ে পড়ছে ছাত্রদের ওপর। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, জেন–জি নষ্ট প্রজন্ম, এদের পড়াশোনার কী মূল্য, যারা শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলে।
যারা এত দিন সাবেক সরকারের সঙ্গে সখ্যের বিনিময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে বসে অন্যায় করেছেন, তাঁরা যেমন গর্হিত কাজ করেছেন; তেমনি এখন যাঁরা ছাত্রদের ব্যবহার করে সেই শিক্ষকদের জনসমক্ষে হেনস্তা করছেন, তাঁরাও গর্হিত কাজ করছেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দেশে চরম অবহেলিত; অথচ জাতি গঠনে এদের ভূমিকাই সবচেয়ে অগ্রণী। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ১৩তম গ্রেডে বেতন পান, যদিও সরকারি হাসপাতালের নার্স ও কৃষি উপসহকারীরা ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা।
তাঁদেরও মনে রাখা উচিত, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, সেই পুনরাবৃত্তি হয় আরও বিকৃত রূপে। তবে ছাত্ররা চাপ দিয়ে প্রধান শিক্ষকদের পদত্যাগ করাচ্ছেন—এ পরিস্থিতি মোটেও কাম্য নয়।
এটাও সত্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে জড়তা আছে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা সামন্তীয় পর্যায়ের। শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই অনুভব করে, তারা মর্যাদাহানির শিকার হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যেভাবে গাদাগাদি করে হলে থাকে বা গণরুমে এত দিন যেভাবে মর্যাদাহানি ও হয়রানির শিকার হয়েছে, তা অত্যন্ত অমানবিক। এ পরিস্থিতির আশু অবসান জরুরি।
এ তো গেল একটি দিক; সত্যের নানা দিক আছে, শুধু একদিক বিবেচনা করা হলে বিষয়টি একদেশদর্শী হয়। শিক্ষকেরাও সমাজে উপেক্ষার শিকার হয়েছেন যুগের পর যুগ ধরে। তা না হলে একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেন আমলাদের কর্তৃত্বে থাকতে হবে।
ফল হলো, একসময় সবচেয়ে ভালো ছাত্ররা শিক্ষক হতে চাইতেন, এখন তাঁরা অবধারিতভাবে আমলা হওয়ার চিন্তা করেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দেশে চরম অবহেলিত; অথচ জাতি গঠনে এদের ভূমিকাই সবচেয়ে অগ্রণী। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ১৩তম গ্রেডে বেতন পান, যদিও সরকারি হাসপাতালের নার্স ও কৃষি উপসহকারীরা ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শিক্ষাগত যোগ্যতায় এগিয়ে থাকলেও তাঁরা ১৩তম গ্রেডের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। যে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, সেই দেশের শিক্ষার কী হাল হবে, তা বলাই বাহুল্য।
এই শিক্ষকদের হাত ধরেই দেশে প্রথম শ্রেণির আমলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশায় উজ্জ্বল মুখ তৈরি হচ্ছে। কথাশিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কথা এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়: এ দেশে শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী নেই; আছে শুধু আমলা। এই বঞ্চনা ও অবহেলার অবসান ঘটাতে হবে।
এখন পড়াশোনায় ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেই পবিত্র ঈদুল আজহার পর থেকে একরকম ক্লাস হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি বেশি দিন চলতে পারে না।
সবচেয়ে বড় কথা, যে শিক্ষকেরা ক্লাস নেবেন, তাঁদের যদি ভীতি ও অস্বস্তির মধ্যে ক্লাস নিতে হয়, তাহলে পাঠদান ভালো হবে না। এমনিতেই অনেক সমস্যা আছে; এর মধ্যে যদি ভীতি যুক্ত হয়, তাহলে কথাই নেই। আমাদের দেশে শিক্ষকদের সম্মানের যে রীতি যুগের পর যুগ চলে আসছে, তা বিনষ্ট হওয়ার পেছনে শিক্ষকদের দায় আছে নিঃসন্দেহে।
কিন্তু শ্রেণিকক্ষে সেই তাঁরাই পড়াবেন; এ সম্পর্ক তাই পুনর্নির্মাণের বিকল্প নেই। শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতার কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করা যায়:
বাদশাহ্ কহেন, ‘সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।’
উচ্ছ্বাসভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে—
আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।
শিক্ষাগুরুর সেই চির উন্নত শির আরও উন্নত হোক, এটাই সবার চাওয়া। এ বিষয়ে সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ ছাড়া ভুলে যাওয়া চলবে না, বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে। এখন বিশ্বদরবারে আমাদের আরও প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। ফলে শিক্ষার মানোন্নয়ন ছাড়া গতি নেই; এ কথা বিস্মৃত হওয়ার অবকাশ নেই। প্রতি পদে এ কথা মনে করতে হবে।
প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক