মতামত

পশ্চিমের কাছে কেন মোহাম্মাদ বিন সালমানের সাত খুন মাফ

সৌদি আরবের কার্যত সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি মোহাম্মাদ বিন সালমানের (ডানে) বিরুদ্ধে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার নির্দেশ দেওয়াসহ মানবাধিকার লংঘনের অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো পশ্চিমা নেতারা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
ছবি: রয়টার্স

নিজ স্বার্থে পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা নতুন নয়। তবে ইদানীং তার বহিঃপ্রকাশ আরও নগ্ন হয়েছে। অন্য দেশে গুম, খুন, মানবাধিকার হরণ আর গণতন্ত্রহীনতা প্রশ্নে তারা প্রায়ই হুমকি-ধমকি ও নানা সবক দেয়। কিন্তু নিজ স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রেই তারা তাদের নিজেদের তৈরি মানদণ্ডেরই লঙ্ঘন ঘটায়।

সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার পর সারা পৃথিবীতে নিন্দার ঝড় ওঠে। মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে জামাল খাসোগিকে হত্যার অনুমোদন দিয়েছিলেন যুবরাজ সালমান। সে সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে স্বচ্ছতা দাবি করেছিল এবং যাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, তাঁদের জবাবদিহি করতে বলেছিল।

জামাল খাসোগি সৌদি সরকারের এজেন্টদের দ্বারা ২০১৮ সালের ২ অক্টোবরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে গুপ্তহত্যার শিকার হন। এ ঘটনার ১৮ দিন পর সৌদি সরকার তাদের কোনো রকম সংশ্লিষ্ট না থাকার অবস্থান থেকে সরে আসে। পরে স্বীকার করে নেয়, হাতাহাতি এবং বাগ্‌বিতণ্ডার পর গলায় ফাঁস লাগার কারণে খাসোগি দূতাবাসে মারা যান।

এই ঘটনা এবং ইয়েমেনে যুদ্ধের কারণে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের অধীন সাবেক জার্মান সরকার সৌদি আরবে জার্মানি অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। সে সময় জার্মানির সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে ফ্রান্সসহ আরও কয়েকটি দেশ সৌদি আরবে অস্ত্র রপ্তানি থেকে বিরত থাকে। ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেই সৌদি আরবের প্রতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ এবং অস্ত্র রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এ ধরনের ঘটনা পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। সে সময় সৌদি আরবে ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে আচরণ এবং অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয়ে কথা উঠেছিল।

তুরস্কে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয়

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর হওয়ার পর জ্বালানি সংকটের মুখে এখন পশ্চিমারা চার বছর আগের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কথা ভুলে সৌদি আরবের দ্বারস্থ হচ্ছে। জামাল খাসোগির মৃত্যুর পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ইইউ কাউন্সিলের সভাপতি চার্লস মিশেল, যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং সাম্প্রতিককালে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ—সবাই প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করেছেন।

মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে খাসোগিকে হত্যার বিষয়ে যুবরাজ সালমান অনুমোদন দিয়েছিলেন। এ ঘটনা জানার পরও মার্কিনরা সৌদি আরব সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি। বরং ২০১৭ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পাদিত ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রয়ের চুক্তি বহাল থাকে। সেই চুক্তি ছিল মার্কিন ইতিহাসে বৃহত্তম একক অস্ত্র রপ্তানি চুক্তি। সেই চুক্তিতে সৌদি আরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০ বছরে প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র কিনবে বলেও বলা হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা এসব অস্ত্র মূলত ব্যবহৃত হচ্ছে আট বছর ধরে চলা সৌদি আরব-ইয়েমেন যুদ্ধে। বছরের পর বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ ইয়েমেনের জনগণকে ইতিমধ্যে মানবেতর পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই যুদ্ধে ইতিমধ্যে ৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষর মৃত্যু ঘটেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েনজেল মিকালস্কি সৌদি আরবের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘সৌদি আরব এবং তার জোটের অংশীদাররা ইয়েমেনে হাসপাতাল, কিন্ডারগার্টেন এবং স্কুলে বোমাবর্ষণ করছে। এটা যুদ্ধাপরাধ।’

সৌদি শাসকেরা বরাবরই এ ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, সৌদি আরবে বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট স্বৈরশাসক রয়েছে। নারী, সাংবাদিক এবং বিরোধী দলের সদস্যরা সেখানে নির্যাতিত হন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দানা আহমেদ বলেছেন, ‘সৌদি আরবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পুরো মাত্রায় ঘটছে। সেখানে বাক্‌স্বাধীনতা নেই, মৃত্যুদণ্ড বাড়ানো হয়েছে এবং বিদেশি শ্রমিকদের শোষণ করা হচ্ছে।’

খাসোগিসহ ইয়েমেনে সাধারণ নাগরিকদের হত্যার কারণে ইউরোপের অনেক দেশ সৌদি আরবের বিরুদ্ধে তথাকথিত নিষেধাজ্ঞার কথা বললেও বিকল্প পথে তারা অস্ত্র ব্যবসা করছে। ফ্রান্সের মানবাধিকারকর্মীরা উত্তর ফ্রান্সের সমুদ্রবন্দর লে হাভরে ফরাসি অস্ত্র নিতে বাহরি-ইয়ানবু নামে একটি কার্গো জাহাজ এলে তা অবরোধ করেন। পরে সৌদি জাহাজটি অস্ত্র বোঝাই না করেই ফেরত যায়। মুখরক্ষার জন্য সে সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ অস্ত্র চুক্তিকে সমর্থন করে বলেছিলেন, রিয়াদের সরকার তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন যে ফরাসি অস্ত্র বেসামরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না।

গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ তাঁর সৌদি আরব সফরে প্রিন্স মোহাম্মদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি সৌদি আরবের কাছ থেকে জার্মানিতে জ্বালানি রপ্তানিবিষয়ক চুক্তি করেন। বিনিময়ে চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের জোট সরকার পূর্ববর্তী আঙ্গেলা ম্যার্কেল সরকারের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে এবং সৌদি যুদ্ধবিমানের জন্য সরঞ্জাম এবং গোলাবারুদ রপ্তানি করতে জার্মান পার্লামেন্ট অনুমোদন দেয়।

সৌদি আরব অতীতে ইয়েমেনে বিমান হামলা চালিয়ে বারবার পদ্ধতিগতভাবে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর হামলা করে বহু মানুষকে হত্যা করেছে। বিশেষ করে ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে, বিষয়টি জানার পরও জার্মানি সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া লজ্জাজনক বিষয়।

জার্মানির বন শহরের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর কনভার্সনের অস্ত্রবিষয়ক গবেষক ম্যাক্স মুচলার বলছেন, সৌদি আরব অতীতে ইয়েমেনে বিমান হামলা চালিয়ে বারবার পদ্ধতিগতভাবে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর হামলা করে বহু মানুষকে হত্যা করেছে। বিশেষ করে ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে, বিষয়টি জানার পরও জার্মানি সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া লজ্জাজনক বিষয়।

আর জার্মান পার্লামেন্টের বামদলীয় সাংসদ সেভিম দাগডেলেন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি এই অস্ত্র রপ্তানিতে অনুমোদনকারীদের ‘অপরাধী’ বলে অভিহিত করেছেন।

কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মোস্তফা কামাল সাঈদ বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার আগে বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি সৌদি আরবকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করবেন। কিন্তু এখন তিনি তা বেমালুম ভুলে গিয়ে সৌদি আরবে সফর করেছেন এবং মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর হওয়ার পর জ্বালানি সংকটের মুখে এখন পশ্চিমারা তাদের মানবাধিকারের মানদণ্ড নিজেরাই লঙ্ঘন করছে। সবকিছু ভুলে পশ্চিমা দেশগুলো আবারও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে নৈকট্য খুঁজছে।

  • সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
    Sharaf.ahmed@gmx.net