বান্দরবানে অল্প সময়ের মধ্যে থানচি, রুমা ও আলীকদমে হামলা চালিয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। প্রায় তিন বছর ধরে বান্দরবানের এসব এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীটি সক্রিয় আছে। একসময় এলাকাগুলোতে আমি দায়িত্ব পালন করেছি। আমি সেখানে রিজিওনাল এবং ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম। সেখানকার বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি—এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে সংগঠনটি গঠিত হয়েছে। জাতিগোষ্ঠীগুলোর বেশির ভাগ খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী।
কেএনএফকে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, নাথান বম, তিনি কিন্তু রুমারই ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও এখন সশস্ত্র পথে ঢুকেছেন। প্রথম দিকে তঁাদের বক্তব্য ছিল, তাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান জাতিগোষ্ঠী চাকমা ও মারমাদের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছেন। এ দুই জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাঁরা অস্ত্র তুলে নিয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটটা মূলত তৈরি হয়েছে ১৯৯৮ সালের পার্বত্য চুক্তির পরে। পার্বত্য চুক্তির ফলে যেসব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, তার বেশির ভাগই রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িকেন্দ্রিক এবং সুবিধাভোগীদের বেশির ভাগ ছিল চাকমা, এরপর মারমা। এখানে যে বঞ্চনা বা বৈষম্য তৈরি হয়েছে, সে কারণে কুকি-চিনেরা অস্ত্র ধরেছে বলে তাদের ভাষ্য।
তবে কেএনএফ ধীরে ধীরে তাদের চরিত্র বদলাতে থাকে এবং দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে। দেখা গেল, অর্থের জন্য তারা ইসলামি তথাকথিত জঙ্গিগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। সেই অর্থ দিয়ে হয়তো আরও বেশি অস্ত্র কিনেছে। এরপর সেখানে জঙ্গিগোষ্ঠীকে দমন করা হলো। কুকি-চিনের সঙ্গে শান্তি আলোচনার উদ্যোগও নেওয়া হলো। তবে শান্তি আলোচনার বিষয়টি হচ্ছে তাদের দিক থেকে পুরোনো খেলা। গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম যখন পুরোপুরি সশস্ত্র পরিস্থিতিতে ছিল, তখন এ রকম শান্তি আলোচনা বহুবার হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে। শান্তি আলোচনার মাধ্যমে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করে।
এ ধরনের গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি আলোচনা মানে হলো তাদেরকে আপনি স্বীকৃতি দিলেন। তারা তখন আরও লোকবল রিক্রুট করার সুযোগ পায় এবং প্রচার করে, দেখো সরকার এখন আমাদের গুরুত্ব দিচ্ছে, আমাদের সঙ্গে দর-কষাকষি করছে। আরও তরুণ ছেলে তখন তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। একটি সশস্ত্র সংগঠন যেভাবে বেড়ে ওঠে, কেএনএফও নিজেদের সেভাবে শক্তি বৃদ্ধি করেছে।
এখন সেনাবাহিনীকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারও সামরিকায়নের জন্য সমালোচনা উঠতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী এমন পদক্ষেপ তো নিতেই হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর তখন সেনাবাহিনী আবারও ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যাবে।
রুমা শহর যেটি মূলত রুমা বাজার নামে পরিচিত, সেটি একটু নিচের দিকে, অনেকটা উপত্যকার মতো। পাহাড় ও সাঙ্গু নদ দিয়ে রুমা বেষ্টিত। আমি যখন সেখানে দায়িত্বরত ছিলাম, সেখানে সরাসরি যাওয়া যেত না। এক পাশে নদী অতিক্রম করে যেতে হতো। অন্য পাশে পাহাড় থেকে নেমে যেতে হতো, সেখানে ছিল ক্যান্টনমেন্ট। এখন যোগাযোগব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে, নদের ওপর সেতু হয়েছে। সরাসরি গাড়িতে করে রুমা বাজারে চলে যাওয়া যায়। এখন নিঃসন্দেহে রুমায় জনসংখ্যা বেড়েছে। আর পার্বত্য চুক্তির পর সেনাবাহিনীকে অনেক জায়গা থেকে তুলে নেওয়া হয়, তাদের অবস্থান হলো কয়েকটি নির্ধারিত ক্যান্টনমেন্টে, যেমন রুমা, আলীকদম ও বান্দরবানে।
একসময় বান্দরবান এলাকায় একদম গভীর জঙ্গল পর্যন্ত অন্তত ৫০টি অপারেশনাল ক্যাম্প ছিল। প্রতিটি ক্যাম্পের চার কিলোমিটারের আশপাশে তারা নজরদারি করত ও টহল দিত। যে কারণে আশপাশে পাহাড়ি পাড়াগুলোতে কী হচ্ছে, কী ঘটছে তা জানা থাকত। সে সময় পুরো বান্দরবান ছিল রিজিওনাল কমান্ডারের অধীনে। পুলিশ, আনসার, ভিডিপি, এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের সবকিছুই সমন্বয় হতো ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে। পার্বত্য চুক্তির ফলে অধিকাংশ ক্যাম্প তুলে ফেলা হলো। এখন একটি ক্যান্টনমেন্টের অধীনে অপারেশনাল এরিয়া হয়ে গেল ৩০-৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত। একটি ছোট ক্যান্টনমেন্ট বা ব্যাটালিয়নের পক্ষে পাহাড়ি এলাকায় এ বিশাল এলাকাজুড়ে নজরদারি করা সম্ভব নয়। তাদের ওপর হামলা না হলে তাদেরও তখন কিছু করার থাকে না। সেনাবাহিনী এখন সেখানে কিছু চেকপোস্ট পরিচালনা করে।
এখন সবকিছু দেখছে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন। কেএনএফ গত কয়েক বছরে সক্রিয় হয়ে উঠল। গত কয়েক দিনে রুমা, থানচি ও আলীকদমে হামলা হলো, ব্যাংক লুট হলো। কেএনএফের সদস্যরা পুলিশের রাইফেল নিয়ে গেছে। ব্যাংকের টাকা নেওয়ার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো ১৪টা চায়নিজ রাইফেল নিয়ে গেছে। এখন এগুলো আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। রুমায় এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে অপহরণ করল।
বলা হচ্ছে, তারা খুব বেশি টাকা নিতে পারেনি ব্যাংক থেকে। আবার তারা একটি বিজ্ঞপ্তি ছেড়েছে, যেখানে তারা দাবি করেছে, ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে ওই ব্যাংক কর্মকর্তাকে তারা ছেড়ে দিয়েছে। তারা এ টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনবে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর যারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে, তাদের অস্ত্রগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। সেগুলো কেনা সহজ হবে এখন।
একই সঙ্গে এ অঞ্চলও মাদকের বড় রুট হয়ে উঠেছে। সশস্ত্র অস্থিরতা যেখানে, মাদকও থাকে সেখানে। এ মাদক ব্যবসাও মূলত অস্ত্র কেনার টাকা সংগ্রহের জন্য। সব মিলিয়ে এ অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এ অঞ্চলে শুধু বাংলাদেশের এসব এলাকা নয়, সেখানে আছে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন প্রদেশ এবং ভারতের মিজোরাম ও মণিপুর রাজ্য। এসব এলাকায় কুকি-চিনের বড় প্রভাব আছে। চিন প্রদেশে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ) লড়াই করছে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে। সেই গোষ্ঠীর বেশির ভাগ হচ্ছে কুকি-চিন। আবার মিজোরামেও এখান থেকে অনেক কুকি চলে গেছে। সেখানে এ নিয়ে নানা ধরনের অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে।
মণিপুরে মেইতেই গোষ্ঠীর সঙ্গে কুকিদের বড় সংঘাতও আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি। ফলে সীমান্তের ওপারে কুকি-চিনদের নানামুখী আন্দোলন ও তৎপরতার অনুপ্রেরণায় এখানে কেএনএফ গঠিত হয়েছে এবং সক্রিয় হয়েছে। তারা সেসব জায়গা থেকে অস্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। তারা এখন বান্দরবানের বিশাল এলাকা নিয়ে স্বায়ত্তশাসন দাবি করছে। যদিও সেটির সঙ্গে সীমান্তের ওপারে কুকি-চিন নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর কথা এখন পর্যন্ত তারা বলছে না।
রুমা, থানচি ও আলীকদম—তিন এলাকার দূরত্ব কিন্তু কম নয়। অল্প সময়ের মধ্যে তিন জায়গায় হামলার ঘটনায় এটা প্রতীয়মান হয়, অনেকগুলো দলে ভাগ হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে এসব হামলা চালিয়েছে কেএনএফ। তারা যে শক্তি দেখিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, এলাকাটিকে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চায়। এখন পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি একক নেতৃত্ব থাকতে হবে। সেই নেতৃত্ব যদি সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়া হয়, তাহলে তাদেরকে সব ধরনের পরিস্থিতির দায়দায়িত্বও দিতে হবে।
সেখানে র্যাব নিজেদের মতো যাবে, পুলিশও প্রতিহত করতে যাবে, এভাবে সমন্বয় হবে না। এটি অনেকটা যুদ্ধ পরিস্থিতি। পুলিশ তো এমন পরিস্থিতির জন্য প্রশিক্ষিত বাহিনী নয়। বিজিবি কিছু করতে পারলেও, এখানে তাদের জোড়ালো ভুমিকায় দেখছি না আমরা। যৌথ বাহিনী গঠন করে অভিযান চালিয়ে খুব একটা কাজ হবে বলে মনে হয় না। এখন সরকারকে চিন্তা করতে হবে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় যদি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়, তাহলে কমান্ড দিতে হবে একটি জায়গা থেকে এবং পুরো দায়দায়িত্বও তাকে নিতে হবে। নয়তো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে যাবে।
এখন সেনাবাহিনীকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারও সামরিকায়নের জন্য সমালোচনা উঠতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী এমন পদক্ষেপ তো নিতেই হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর তখন সেনাবাহিনী আবারও ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যাবে।
● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.), সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক
hhintlbd@yahoo.com