শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০ – ১৫ আগস্ট ১৯৭৫)
শেখ মুজিবুর রহমান  (১৭ মার্চ ১৯২০ – ১৫ আগস্ট ১৯৭৫)

মতামত

চাপিয়ে দেওয়া ‘বঙ্গবন্ধুচর্চার’ ফলে যে ক্ষতি হলো

‘পয়লা বৈশাখ মানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’—এটি এক শিশুর উত্তর। মনে আছে, ২০২২ সালের ১৪ এপ্রিলের সেই ভিডিও ক্লিপটার কথা?

কোনো এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘পয়লা বৈশাখ মানে কী?’ সে প্রথমে একটু থতমত খেলেও পরে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বাক্যটি বলেছিল। সেই ভিডিও বেশ কয়েক দিন ধরে ভেসে বেড়িয়েছিল পুরো সোশ্যাল মিডিয়ায়।

আমার একবারের জন্যও হাসি পায়নি; বরং অজানা এক শঙ্কা এসে মনে ভর করেছিল। শিশুটির শেখায় কোনো দোষ আছে বলেও মানতে পারছিলাম না। আমরা যা শেখাচ্ছি, তা-ই তো শিখছে তারা। দোষটা আমাদের কিংবা আমাদের বাংলাদেশের সিস্টেমের।

একটি রাষ্ট্র শক্তিশালী কি না, তা হিসাব করতে গেলে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করতে হয়। তার মধ্যে একটি হলো ‘সিম্বলিক ক্যাপাবিলিটি’। যেখানে বলা হয়, একটি রাষ্ট্র তখনই শক্তিশালী যখন সে রাষ্ট্রটি তার প্রতি জনগণের ভালোবাসা, একাত্মতা, ভক্তি ও দেশপ্রেম জাগ্রত করতে পারে।

জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের এই আস্থা অর্জনের সক্ষমতাই হচ্ছে সিম্বলিক ক্যাপাবিলিটি। এখন কোন রাষ্ট্র কী উপায়ে এই কাজ করবে, সেটি তার নিজস্ব ব্যাপার।

কিন্তু এই সিম্বলিক ক্যাপাবিলিটি অর্জন করতে গিয়ে কিছু কিছু জিনিস এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, যার ফলাফল ওই শিশুটির বক্তব্য।

আমরা ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছি। তার পরের ইতিহাসও কম ঘটনাবহুল নয়। একেক সময়ে একেক দিকে মোড় নিয়েছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ঘটেছে ক্ষমতার রদবদল।

সামরিক শাসন, রাজনৈতিক দলগুলোর শাসন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন—সবই বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে; কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা, প্রেম কিংবা ভক্তি জাগানোর জন্য সুচিন্তিত কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

আমার ব্যক্তিগত অভিমত, গত পনেরো বছরে শিক্ষার্থীদের ঘিরে স্কুলের বেশির ভাগ কর্মসূচি শুধু বঙ্গবন্ধুতেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই সেই শিশু এর বাইরে অন্য কোনো কিছু দেখার, শোনার বা জানার সুযোগই পায়নি।

রাষ্ট্র তার জায়গা থেকে অবশ্যই চেষ্টা করে যাবে ছোট–বড় সবার মধ্যে দেশের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করার। এর মধ্যে ভুল কিছু নেই, ভুলটা পদ্ধতিতে।

পাঠ্যপুস্তকের কথা নাহয় বাদ দিলাম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেকোনো প্রতিযোগিতার বিষয় কেন শুধুই ‘বঙ্গবন্ধু’ হতে হবে? হোক সেটি আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, গ্রন্থ পর্যালোচনা কিংবা রচনা প্রতিযোগিতা। সবকিছুতেই বিষয় একই।

আবার পুরস্কারের বইও একজন মানুষকেন্দ্রিক। ওদিকে কেউ যদি সাতই মার্চের ভাষণ মুখস্থ করে বঙ্গবন্ধুর ঢঙে বলতে পারে, তাহলে তো আর কথাই নেই! তার বাহবা পাওয়া কে আটকায়! আমি বলছি না এগুলোর চর্চা বাদ দেওয়া উচিত।

১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধ কিংবা বঙ্গবন্ধুকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে চাওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কিন্তু ‘বঙ্গবন্ধু’ বিষয়টি যে শুধু নির্দিষ্ট একটি দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের আশায় ব্যবহার করা হয়েছে তা এখন আর অস্পষ্ট নয়।

বঙ্গবন্ধুর নাম সামনে রেখে শুধুই তেলবাজি করা হয়েছে; ফলস্বরূপ সেই তেলেই ডুবে গেলেন বঙ্গবন্ধু।

বছর দুয়েক আগে প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাট্যসংগঠক, নাট্যপরিচালক ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় একজন নেতার মূল্যায়ন অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে হওয়া দরকার।’

সুতরাং শিশুদের এটাও জানার সুযোগ করে দিতে হবে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার বিষয় বঙ্গবন্ধু ছাড়াও একটা ফুল কিংবা পাখিও হতে পারে। রচনার বিষয় হতে পারে ‘একটি বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা’। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুখস্থ করার চেয়ে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা কিংবা তাত্ত্বিক আলোচনা করাটা বেশি জরুরি। ‘বঙ্গবন্ধু চর্চা’ করাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বেশি।

কেউ কেউ বলতে পারেন, নতুন প্রজন্ম দেশের ইতিহাস সম্পর্কে যাতে স্পষ্ট ধারণা পায়, তাই সবকিছুতেই এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; কিন্তু তাতে আদৌ লাভটা কি হয়েছে?

দেশপ্রেম জাগাতে সুপরিকল্পিত কোনো উপায় এ দেশে অনুসরণ করা হয় না; কিন্তু মনে রাখা উচিত ছিল, এসব ক্ষেত্রে জোর করে ওপর থেকে কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে তা অকার্যকর হতে বাধ্য।

গত পনেরো বছরের জোরজবরদস্তির ফলাফল এই ২০২৪–এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়ে নতুন করে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে সবাই। দেশকে ভালোবেসে দেশের জন্য কিছু না কিছু করতে চাচ্ছে। তাই এখনই সময় ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ গ্রহণের।

ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি—এই সবকটির মধ্যে যোগসূত্র থাকলেও স্বাতন্ত্র্য আছে। এই উপলব্ধি জনগণের মধ্যে থাকলে নতুন প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে পারলে, কেউ আর ওই শিশুর মতো বঙ্গবন্ধু ও পয়লা বৈশাখ গুলিয়ে ফেলবে না। ইতিহাসকে গল্পের মুক্তাঞ্চল বানাতে গেলে মারাত্মক ভুল হয়ে যাবে। কেননা, অতীত না জানলে ভবিষ্যতের দিকে সঠিকভাবে এগিয়ে যাওয়া যায় না, দেশের প্রতি ভালোবাসাও নিখাদ হয় না, দ্বিধাযুক্ত থাকে।

বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের মানুষই বিশ্বাস করে তাদের দেশটাই সেরা। আমরাও গাই, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’; কিন্তু কোথাও একটা ফাঁক থেকে গেছে। আমরাও তো অন্যান্য দেশের মতো চলচ্চিত্র, নাটক, মঞ্চনাটক সবকিছুর মাধ্যমে তুলে ধরতে পারি, আমরাই সেরা!

আমাদের দেশের সব অর্জনকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে। আমাদের গর্ব করার মতো জিনিসের তো অভাব নেই। খেলাধুলা, ঐতিহ্যবাহী স্থান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেমন বাউল গান, জামদানি শাড়ি, সিলেটের শীতলপাটি, ইলিশ, আমসহ কত কী আছে আমাদের!

কিন্তু যথোপযুক্ত উপায়ে সেগুলোকে উপস্থাপন করা হয় না কখনো। আমাদের আরও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, পরবর্তী প্রজন্মকে বিশ্বাস করাতে হবে এই ছোট্ট দেশটি সত্যিই অহংকার করার মতো। এই দেশটি আমাদের নিজেদের। তবেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

বিশেষ করে ব্যক্তির অবদানকে স্বীকার করার পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলো বিবেচনায় আনার সুযোগ করে দিতে হবে। এত বছরের গতানুগতিক দেশপ্রেমের সংজ্ঞা থেকে বেরিয়ে এসে শিশুদের নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।

শিশুরা দেশের ইতিহাস জানুক, সঙ্গে সমানভাবে পয়লা বৈশাখ চিনুক, বর্ষা উৎসব কিংবা বসন্ত উৎসবে যোগ দিক, চৈত্রসংক্রান্তির কাহিনি জানুক। বাংলাদেশ তো বৈচিত্র্যে ভরপুর একটি দেশ। বিচিত্র বিষয় সম্পর্কে তাঁরা জ্ঞান আহরণ করুক। তাতে মনুষ্যত্ব বোধটা খুব ভালোভাবে জেগে উঠবে। দেশের প্রতি টান তৈরি হবে।

বাংলাদেশের ইতিহাস নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরার এখনই উপযুক্ত সময়। রাজনৈতিক দলগুলোর চোখ দিয়ে দেশকে পরিমাপ করতে গেলে আবারও পক্ষপাতিত্বমূলক ইতিহাস জানবে নতুন প্রজন্ম।

প্রত্যাশা থাকবে পরবর্তী সময়ে যাঁরা দেশ পরিচালনার ক্ষমতায় আসবেন, তাঁরাও ২০২৪–এর গণ-অভ্যুত্থানের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেবে। ১৯৭১ পরবর্তী ইতিহাসও সঠিকভাবে তুলে ধরা হোক। এমনকি ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে ক্ষমতার কত রদবদলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পথ চলতে হয়েছে; সেই সবকিছুও খোলামেলা আলোচনা হোক।

মোটকথা, বাংলাদেশের ইতিহাসকে এককেন্দ্রিক না করে এর বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ হোক।

মানুষ সব সময় নিজের জিনিসটা আগলে রাখতে চায়। কখনোই ক্ষতি হতে দেয় না। আমাদের দেশের জনগণকেও বিশ্বাস করতে হবে, এই দেশের সবকিছু আমাদেরই উপার্জনের অর্থে গড়া। আমি নিজেই দেশের একটা ক্ষুদ্র অংশ।

এই বিশ্বাস থাকলে কেউ আর দুর্নীতি করতে পারবে না, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পারবে না। ২০২৪–এর গণ-অভ্যুত্থান সেই সুযোগ বয়ে নিয়ে এসেছে, জনগণের মধে৵ দেশপ্রেমের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করার।

ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি—এই সবকটির মধ্যে যোগসূত্র থাকলেও স্বাতন্ত্র্য আছে। এই উপলব্ধি জনগণের মধ্যে থাকলে নতুন প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে পারলে, কেউ আর ওই শিশুর মতো বঙ্গবন্ধু ও পয়লা বৈশাখ গুলিয়ে ফেলবে না।

ইতিহাসকে গল্পের মুক্তাঞ্চল বানাতে গেলে মারাত্মক ভুল হয়ে যাবে। কেননা, অতীত না জানলে ভবিষ্যতের দিকে সঠিকভাবে এগিয়ে যাওয়া যায় না, দেশের প্রতি ভালোবাসাও নিখাদ হয় না, দ্বিধাযুক্ত থাকে।

২০২৪–এর গণ-অভ্যুত্থান এই দেশটাকে নতুন করে আপন ভাবতে শিখিয়েছে। তবে এখানেই শেষ নয়, পরবর্তী প্রজন্মকে দেশের প্রতি দায়বদ্ধ করে তুলতে সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশের দিকে চোখ মেলে তাকালে সবাই যেন সমানভাবে অনুভব করি, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি’।

  • তথাপি আজাদ শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়