মতামত

ছাত্রলীগের ছায়া প্রশাসন–মন্ত্রিপাড়া ও নব্য জমিদারিবিলাস

উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, টেন্ডারবাজি, কিংবা পোস্ট-পদবি ‘বিক্রি’র অধিকার তো প্রভাবশালী নেতাদের হাতে। উপ, সহ, পাতি—এসব নেতা তাহলে চলবে কী করে?
ফাইল ছবি

রুমে আটকে পেটাতে পেটাতে এক শিক্ষার্থীর কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলা হয়েছে। আরেক শিক্ষার্থী মুঠোফোন মেরামত করে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগান। চাহিদা অনুযায়ী চাঁদা না দিতে পারায় তাঁকে রুমে ডেকে এনে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে কেড়ে নেওয়া হয়েছে টাকা।

দুটি ঘটনাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। ‘কোন বাপে সিট দেয়’ বলে হুমকি দেওয়ার ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের জেরে এক শিক্ষার্থীকে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। হুমকি দেওয়া হয়েছে, বিবস্ত্র করে ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।

এটি ইডেন মহিলা কলেজের ঘটনা, যেখানে ‘ছাত্রলীগই সব, চোখ বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ’। প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার হলে শঙ্কিত অভিভাবকদের নিয়ে সহকারী প্রক্টর হলে গেলে তাঁদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। খবর সংগ্রহে গেলে মারধর করা হয় সাংবাদিকদের।

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সহকারী প্রক্টরকেও মারতে উদ্যত হলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জহুরুল হক হলের ছাদে বিয়ার খেয়ে উচ্চ স্বরে গান গাওয়া নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের বাগ্‌বিতণ্ডা একপর্যায়ে হাতাহাতিতে পরিণত হয়। শেষে লাঠিসোঁটা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ালে পুরো হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

গণমাধ্যমে গত কয়েক দিনের এ ধরনের ভয়াবহ সংবাদগুলো জোড়া দিলে কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না শিক্ষাঙ্গনে কতটা ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আবাসিক হলগুলোয় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, সেটাকে নব্য জমিদারতন্ত্র না বলে উপায় নেই। কয়েক প্রজন্ম আগেও জমিদারেরা আর তাঁদের নায়েব, পাইক, পেয়াদারা মিলে বাংলার কৃষক- প্রজাদের ওপর যখন-তখন নিপীড়নের খড়্গ নামিয়ে দিতেন। কথায় কথায় কর-খাজনা আরোপ করা হতো। না দিতে পারলে চলত অকথ্য নির্যাতন। নিজেদের জমিদারিতে জমিদারের কথাই শেষ আইন। আবার অভিজাত্যের বলে প্রজাদের কাছ থেকে তৈরি করা হতো দুস্তর ব্যবধানের দেয়াল। জমিদারের বাড়ির সামনে জুতা পায়ে দিয়ে কিংবা ছাতা মাথায় দিয়ে প্রজারা কেউ যেতে পারতেন না।

২৮ আগস্ট প্রথম আলোর শিরোনাম ছিল ‘হলে “ছায়া প্রশাসন” চালায় ছাত্রলীগ’। লেখাটিতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩টি হলের বেশির ভাগ কক্ষের নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের হাতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাতটি হলের ছয়টিই নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের ছয় নেতা। হলের নিয়মকানুন-আইন তাঁরাই তৈরি করেন, বিচারের ব্যবস্থাও করেন। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুমের মাধ্যমে হলে তোলা হয়।

এরপর ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে নিয়মিত যাওয়া, আনুগত্যসহ অন্যান্য পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দও তাঁরাই করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাধ্যক্ষ হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা রয়েছে। কেননা প্রাধ্যক্ষ পদে দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা একটা করে বাংলোয় থাকার সুযোগ পান। আবাসিক শিক্ষকেরাও বেশ কম ভাড়ায় আকর্ষণীয় বাসা পান। আছে বিশেষ ভাতাও। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দেখভালের জন্য এসব সুবিধা দেওয়া হলেও সেই কাজই তাঁরা করেন না।

জাতীয় রাজনীতিতে টিকে থাকার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ছাত্ররাজনীতিকে লেঠেল হিসেবে ব্যবহার করার ইতিহাস বেশ পুরোনো। এই রাজনীতি টিকে থাকার একমাত্র ভিত্তি হলো গণরুম ও গেস্টরুম। ফলে যেকোনো মূল্যে শিক্ষার্থী নিপীড়নের এই যন্তরমন্তর চালু রাখতেই হবে! একসময় হলগুলোয় এ ধরনের রাজনৈতিক কক্ষের সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিল।

হলের প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকেরা যে সিট দিতে পারবেন না, সেই বাস্তব বুঝটা শিক্ষার্থীরা ভালো করেই বোঝেন। সে জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলে একদল শিক্ষার্থী সম্প্রতি ‘এক দফা এক দাবি, সিট চাই সিট চাই’ বলে হলের মূল ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছেন। এর কারণ হলো সেই ভবনে বাস করেন ছাত্রলীগের হল শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এই সুযোগে হলটিতে গণের সঙ্গে মানে শিক্ষার্থীদের থেকে নিজেদের পৃথক করতে ছাত্রলীগের নেতারা আলাদা ‘মন্ত্রিপাড়া’ গড়ে তুলেছেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবধানের দেয়াল তোলার এই প্রথাকে মানসিকতার দিক থেকে জমিদারিবিলাস ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান এখন দ্বিতীয় মেয়াদ পার করছেন। এর আগে কয়েক দশক ধরে শিক্ষকতা করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে প্রাধ্যক্ষ এবং আবাসিক শিক্ষকদের বদলে ছাত্রলীগ যে ছায়া প্রশাসন চালায়, তা তিনি জানেন না। তাঁর ভাবনায় কয়েক দশক আগের নিজের হলবাসের স্মৃতি এখনো জাজ্বল্যমান। উপাচার্য বলেন, ‘আমরাও হলের শিক্ষার্থী ছিলাম, প্রশাসনের মাধ্যমেই হল পরিচালিত হতে দেখেছি। এখনো সেভাবেই আছে। এর মধ্যে বড় আকারের পরিবর্তন তো চোখে পড়ে না।’

দিন কয়েক আগে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী কয়েক তরুণের সঙ্গে আলাপচারিতার একপর্যায়ে ‘কেন তাঁরা ছাত্ররাজনীতি করছেন’ সেই প্রসঙ্গ উঠলে অকপট উত্তর দেন, ‘পোস্ট (পদ) দরকার, তাই...।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই পোস্ট তো লটারির মতো। শেষ পর্যন্ত কজনের ভাগ্যেরই আর শিকে ছেঁড়ে? আবার নিয়মিত সম্মেলন না হওয়ায় প্রত্যাশী নেতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। আদর্শহীন রাজনীতির এমন খালি সংখ্যার যে কানাকড়ি মূল্য নেই, তার নজির আমাদের ইতিহাসে বেশুমার।

জাতীয় রাজনীতিতে টিকে থাকার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ছাত্ররাজনীতিকে লেঠেল হিসেবে ব্যবহার করার ইতিহাস বেশ পুরোনো। এই রাজনীতি টিকে থাকার একমাত্র ভিত্তি হলো গণরুম ও গেস্টরুম। ফলে যেকোনো মূল্যে শিক্ষার্থী নিপীড়নের এই যন্তরমন্তর চালু রাখতেই হবে! একসময় হলগুলোয় এ ধরনের রাজনৈতিক কক্ষের সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিল।

এখন সেটা বাড়তে বাড়তে প্রায় পুরোটার নিয়ন্ত্রণই ছাত্রলীগের হাতে। এত এত নেতা; তাঁদের চলতেও তো অর্থ প্রয়োজন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, টেন্ডারবাজি, কিংবা পোস্ট-পদবি ‘বিক্রি’র অধিকার তো প্রভাবশালী নেতাদের হাতে। উপ, সহ, পাতি—এসব নেতা তাহলে চলবে কী করে?

বাপ-দাদার সম্পত্তি তো আর সবার নেই। উপাচার্য, প্রাধ্যক্ষ, আবাসিক শিক্ষকদের হয়ে ছাত্রলীগ যখন ছায়া প্রশাসন চালায়, তখন তারা তাদের বেতন-ভাতা ছাত্রলীগের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারে! সেটা হলে মুঠোফোন মেরামত করে কিংবা প্রাইভেট পড়িয়ে পড়াশোনার খরচ জোগানো শিক্ষার্থীরা অন্তত রেহাই পাবেন।

মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

monoj.dey@prothomalo.com