বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ প্রাকৃতিক বা অবশ্যম্ভাবী নয়। বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণেই তা ঘটেছে। কীভাবে বৈষম্য কমানো যায়, তা নিয়ে লিখেছেন কল্লোল মোস্তফা
সরকারি চাকরিতে বৈষম্যের বিরোধিতা করে শুরু হওয়া আন্দোলনটির সফল গণ–অভ্যুত্থানে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সব ধরনের বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ বিপুলসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ ও সমর্থন। এ কারণেই দেখা গেছে, আন্দোলনে নিহত ও আহতদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ হলেন শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। কাজেই গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশের সরকারের নীতিনির্ধারকদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো দেশের বিভিন্ন খাতে যে প্রবল বৈষম্য বিরাজ করছে, তা দূর করার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া।
গত এক দশকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট ও ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মধ্যে যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষ দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেয়েছে, অনেকেই খাওয়া কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, তখনো দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ৫ শতাংশ মানুষের হাতে এখন দেশের মোট আয়ের ৩০ দশমিক ০৪ শতাংশ পুঞ্জীভূত। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র দশমিক ৩৭ শতাংশ।
অথচ খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, দেশের আয়ে সবচেয়ে ধনী ও সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশের ভাগ ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৬১ ও শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক যুগে দেশের মোট আয়ে ৫ শতাংশ ধনীর ভাগ যখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে, সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশের ভাগ তখন আগের চেয়ে কমে অর্ধেক হয়েছে।
এ কারণেই আয়বৈষম্য–বিষয়ক গিনি সহগ ২০১০ সালের দশমিক ৪৫৮ থেকে ২০২২ সাল শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯৯, যা উচ্চ আয়বৈষম্যকেই নির্দেশ করে। দেশের সম্পদ যে কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে তা ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দেওয়া এই তথ্য থেকেও বোঝা যায়। দেশে ৫০ কোটি ডলার বা ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণের সম্পদ আছে ২১ ব্যক্তির কাছে।
বাংলাদেশে এই অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ প্রাকৃতিক বা অবশ্যম্ভাবী নয়। বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণেই তা ঘটেছে। এই রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক কাঠামোর বৈশিষ্ট্য হলো বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থা, অতিনিম্ন মজুরি, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ।
বাংলাদেশে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেখানে জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে ঠিকই ব্যয় করা হয়, কিন্তু তার বিনিময়ে কারখানা মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যথাযথ কর (প্রত্যক্ষ কর) আহরণ করা হয় না। মালিক ও ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের অতিনিম্ন মজুরি দিয়ে এবং কর্মস্থলের নিরাপত্তার পেছনে যথেষ্ট ব্যয় না করেই ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারেন। সেই সঙ্গে রয়েছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিংবা আমদানি-রপ্তানির নামে লুটপাট ও বিদেশে অর্থ পাচারের বিপুল সুযোগ।
অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো সামাজিক নিরাপত্তা খাত। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল এবং যতটুকু বরাদ্দ হয় তারও একটা বড় অংশ প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে না। সরকারি জরিপেই দেখা গেছে, তালিকাভুক্ত ভাতাভোগীদের ৪৬ শতাংশের বেশি ভাতা পাওয়ার যোগ্য নয়। (যোগ্য না হয়েও ভাতা নেন ৪৬%, ৩০ জানুয়ারি ২০২১, প্রথম আলো)
এ ছাড়া মোট বরাদ্দ বেশি দেখানোর কৌশল হিসেবে এই খাতে এমন কিছু কর্মসূচি দেখানো হয়, যা বাস্তবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিই নয়। এ রকম কতগুলো কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, কৃষি খাতে ভর্তুকি, সঞ্চয়পত্রের সুদ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দেওয়া প্রণোদনা ইত্যাদি। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় খুব কমসংখ্যক দরিদ্রই সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা পায়, আর যা–ও বা পায় তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। এ কারণেই দেশের অর্থনীতির আকার যত বড় হচ্ছে, বৈষম্য তত বাড়ছে।
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ধনিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আহরণ বাড়াতে হবে, শুল্ক ও ভ্যাটের নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পরোক্ষ কর আহরণ কমাতে হবে। শ্রমজীবী মানুষের জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে মানসম্মত কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে শ্রম আইনের আওতায় এনে শ্রমিকের বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মজুরি ও নিরাপদ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
ধনিক গোষ্ঠীর লুণ্ঠন ও দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করতে হবে, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে বিচার করে শাস্তি দিতে হবে। সেই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে, প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে ভাতা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক ও ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত রেশনব্যবস্থা চালু করতে হবে, যেন এতে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি এবং দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা দুটোই নিশ্চিত হবে, সেই সঙ্গে বাজারে এসব পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
একদিকে জিডিপির অনুপাতে অপ্রতুল বরাদ্দ, অন্যদিকে ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণের কারণে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য বেড়েছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে জিডিপির ১ ও ২ শতাংশের কম। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসারে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৪ থেকে ৫ শতাংশ এবং ইউনেসকোর পরামর্শ অনুসারে, জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত।
দেশে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু ও কারিকুলাম নিয়ে যত আলোচনা হয়, তার তুলনায় খুব কম আলোচনা হয় মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রাপ্তিতে বৈষম্য নিয়ে। অথচ ব্যাপক ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে শিক্ষা ক্রমশ সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে।
দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের বেশির ভাগই বেসরকারি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজও বেশির ভাগ বেসরকারি। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে হলে বিস্তর টাকা খরচের সামর্থ্য থাকতে হবে। এটা কিন্তু আপনা–আপনি ঘটেনি, কতগুলো সুনির্দিষ্ট নীতি ও কর্মসূচির মাধ্যমেই ঘটেছে। শিক্ষানীতি-২০১০ এবং বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক প্রণীত উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্র ২০০৬-২০২৬–এর আলোকে, বিশেষত উচ্চশিক্ষা খাতে বাণিজ্যিকীকরণ তীব্র হয়েছে। এর ফলে উচ্চশিক্ষা ক্রমে সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
ইউনেসকোর এক গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ শতাংশ পরিবারগুলো বহন করে। এনজিও বিদ্যালয়ে ফি সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ৩ গুণ বেশি আর বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ক্ষেত্রে এই ব্যয় ৯ গুণ বেশি। এ ছাড়া প্রাইভেট পড়ানোর খরচও দিন দিন বাড়ছে।(শিক্ষায় ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করে পরিবার: ইউনেসকো, প্রথম আলো, ৩ জানুয়ারি ২০২৩)
সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা বিনা মূল্যে পাওয়ার সুযোগ থাকলেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান, শিক্ষকের মান ও সংখ্যা, শিক্ষার উপকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসের (ব্যানবেইজ) ২০২৩ সালের তথ্য অনুসারে, প্রাথমিকে ভর্তির হার ৯৮ শতাংশ হলেও মাধ্যমিকে ঝরে পড়ে প্রায় ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।
উচ্চমাধ্যমিক থেকে ঝরে পড়ে আরো ২১ দশমিক ৫১ শতাংশ। উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় মাত্র ২০ দশমিক ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।(বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩, ব্যানবেইজ) প্রশ্ন উঠতে পারে, সবার উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন আছে কি না। তবে এর চেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো, কে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে আর কে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না—এটা পরিবারের আর্থিক সক্ষমতার বিচারে নির্ধারিত হওয়া উচিত কি না?
বাংলাদেশে কে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে তা মেধার ভিত্তিতে নয়, পরিবারের আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হচ্ছে। মা-বাবার দারিদ্র্য যদি সন্তানের শিক্ষাপ্রাপ্তির জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা কখনোই শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য গড়ার সুযোগ পাবে না। ফলে দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর হবে না। এ কারণেই বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষার সব স্তরে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা জরুরি, যেন মা-বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা সন্তানের শিক্ষাপ্রাপ্তির পথে বাধা হতে না পারে।
গত কয়েক দশকে স্বাস্থ্য খাতে বাণিজিকীকরণ বেড়েছে, বেসরকারি বাণিজ্যিক চিকিৎসাকেন্দ্রের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে, চিকিৎসার জন্য ব্যক্তিগত খরচের অংশ বেড়েছে, চিকিৎসার প্রয়োজনে মানুষের দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক, নার্সসহ প্রশিক্ষিত জনবলের ব্যাপক সংকট রয়েছে, বিদ্যমান জনবলের বেশির ভাগ আবার নগরকেন্দ্রিক, যদিও বেশির ভাগ মানুষের বসবাস এখনো গ্রামে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক-নার্স-ধাত্রীর সংখ্যা মাত্র ৯ দশমিক ৯, যা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অনেক কম (৪৮.৬)। এর মধ্যে বেশির ভাগের অবস্থানই শহর এলাকায়, যদিও দেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগ এখনো গ্রামে থাকেন। বাংলাদেশ হেলথ ওয়ার্কফোর্স স্ট্র্যাটেজি ২০২৩ অনুসারে, চিকিৎসক ও নার্সদের দুই-তৃতীয়াংশ এবং দন্তচিকিৎসক ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের অর্ধেকেরও বেশি শহর এলাকায় থাকেন। তাঁদের বেশির ভাগই আবার চিকিৎসা প্রদান করেন বেসরকারিভাবে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য হাসপাতালের বেডের সংখ্যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্যমাত্রার (১৮) তুলনায় অনেক কম (৯.৫৭)। কিন্তু যা আছে তা-ও আবার শহরকেন্দ্রিক এবং বেসরকারি হাসপাতাল কেন্দ্রিক (৫.৬১), ফলে ব্যয়বহুল।
এভাবে চিকিৎসাব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণের ফলে চিকিৎসা খরচ বাড়ছে, চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষকে চিকিৎসা খরচের ৭৩ শতাংশ নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হয়, যে খরচ করতে গিয়ে প্রতিবছর ৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে মালদ্বীপের মানুষকে নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হয় মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ, ভুটানে এই হার ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৪৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, ভারতে ৪৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, নেপালে ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ আর পাকিস্তানে ৫৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। (দেশে চিকিৎসায় ব্যক্তির পকেট ব্যয় ৭৩%, প্রভাব পড়ছে দারিদ্র্যে, প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০২৪)
বিপুল ব্যয় করেও দেশে চিকিৎসার মান সন্তোষজনক নয়; ফলে দেশের বাইরে বিশেষত পার্শ্ববর্তী ভারতে চিকিৎসা গ্রহণের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২২-২৩ সালে মেডিকেল ভিসায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়েছিলেন মোট ৩ লাখ ৪ হাজার ৬৭ জন বাংলাদেশি। ২০২৩-২৪ সালে এই সংখ্যা ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪ লাখ ৪৯ হাজার। এই সময়ে শ্রীলঙ্কা থেকে মাত্র ১ হাজার ৪৩২ জন, মিয়ানমার থেকে ৩ হাজার ১৯ জন এবং পাকিস্তানের মাত্র ৭৬ জন মেডিকেল ভিসায় ভারত গিয়েছিলেন। (২০২৩ সালে ভারতে বাংলাদেশি চিকিৎসা পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮%, দ্য বিজনেস্ট স্ট্যান্ডার্ড, ৩ জুলাই ২০২৪)
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে চিকিৎসা খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে, চিকিৎসা ব্যয়ে দুর্নীতি দূর করতে হবে, সর্বজনের চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, চিকিৎসাসুবিধা প্রাপ্তিতে গ্রাম–শহরের ভেদ দূর করতে হবে, সরকারি খাতে চিকিৎসক-নার্স-হাসপাতালের বিছানা ইত্যাদি বৃদ্ধি করতে হবে, যেন বেসরকারি খাতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষকে নিঃস্ব হতে না হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার কারণে অনেক মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, সেই ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার না হলে কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না।
কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক