সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর প্রথম আলোসহ কয়েকটি দৈনিকে বেশ লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে। ইউজিসির প্রতিবেদনের মূল বিষয় ছিল খ্যাতিমান শিক্ষকদের সমন্বয়ে ‘পুল’-এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রথম পর্যায়ে সরকারি) উপাচার্যসহ বেশ কিছু পদে নিয়োগ দেওয়া। এতে পদগুলোয় গুণী মানুষদের দেখা যাবে।
আরেকটি বিষয় ছিল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ের উন্নয়ন। বর্তমানে এটি বলতে গেলে তলানিতে আছে। ১৯৭৩ সালে নতুন দেশে নতুন উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি হলো; যা ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো কার্যকর। গত ৫০ বছরে গণতান্ত্রিক এই অধ্যাদেশের প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ আমরা দেখেছি।
দলীয় বিবেচনায় অনেক ক্ষেত্রে আইন শিথিল করে অধ্যাদেশটির অপপ্রয়োগ হয়েছে বহুবার। তবে ইউজিসির সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিবেদনে (ক) উপাচার্য নিয়োগ ও (খ) বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ের ব্যাপারে তাদের চিন্তাভাবনাকে সাধুবাদ জানাই।
ভদ্র–সভ্য জগতের অনেক দেশেই নিরপেক্ষ ‘পুল’-এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ বলে মনে করি। প্রস্তাবে দেশের খ্যাতিমান শিক্ষকদের দ্বারা গঠিত পুল বিচার-বিশ্লেষণ করে উপাচার্যের প্যানেল তৈরি করবে। তারপর এই প্যানেল যাবে কোথায়?
তার আগে আমার শঙ্কার কথা বলি (শঙ্কা অমূলক হলে আমি খুশি হব): দেশের খ্যাতিমান শিক্ষকদের এই পুল গঠন করবেন কে? খ্যাতিমান শিক্ষকেরা দলীয় রাজনীতি করেন না, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবঘর পরনিন্দায় গরম করেন না, টেলিভিশনের পর্দায় খামাখা হাত-পা নেড়ে অযৌক্তিক প্যাঁচাল পাড়ার সময় তাঁদের নেই। তাঁরা ব্যস্ত থাকেন পড়াশোনায়—পড়ানো ও গবেষণা নিয়ে। অনেকের মতে, চারপাশে একশ্রেণির স্তাবক তৈরি করে তাঁরা পীরগিরিও করেন না।
তাঁরা বলতে গেলে নিভৃতচারী মানুষ, ক্ষমতার চারপাশে তাঁরা ঘুরঘুর করেন না বা হম্বিতম্বি করে নিজের অবস্থার জানান দেন না। আমার মতামত হলো, খ্যাতিমান এই শিক্ষকদের পুল তৈরি করার প্রক্রিয়ায় বিবেচনায় আনতে হবে: (১) তাঁদের সারা জীবনের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অর্থাৎ ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবনের প্রথম ধাপের আগেই উচ্চমানের শিক্ষা অর্জন, (২) গবেষণা, গবেষণা-পরামর্শক ও গবেষণা সংগঠক হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি, (৩) তৃতীয় ধাপে তাঁদের গবেষণা প্রকাশনার মান ও সংখ্যা, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হবে, (৪) শিক্ষা প্রশাসনের নানা পর্যায়ে প্রথম শ্রেণির দক্ষতা, (৫) দেশ ও দেশের বাইরের শিক্ষা ও গবেষণায় স্বীকৃতি, (৬) আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উচ্চ মানের ফেলোশিপ, বৃত্তি, সদস্যপদ, ভিজিটিং প্রফেশনালশিপ, (৭) দেশের ভেতরে ও বাইরে উচ্চমানের সম্মেলন ও গবেষণাধর্মী শিক্ষাক্রমে অংশগ্রহণ ও (৮) সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ ও ভালো শিক্ষক হওয়া। পুল তৈরির কাজটি কঠিন, তবে অসম্ভব নয়।
বলতে দুঃখ হয়, বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থানীয়, বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে একেবারে তলানিতে। যাকে আমরা ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে একধরনের গর্ব বোধ করি, তার অবস্থান তথৈবচ। ইউজিসিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর গবেষণা, মানোন্নয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্বমান শুধু ধরে রাখা নয়, তাদের আগামী দিনের দিকনির্দেশনাও দিতে হবে ওই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিতে। শিক্ষার মান, গবেষণার মান ও প্রশাসনিক কাঠামোর মান—এসব বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিংয়ের জন্য অশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের ডিজিটাল যুগে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যাচাই করা খুব বেশি কঠিন কিছু নয়। আশি ও নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিএইচডি থিসিসের পরীক্ষণের পূর্ণ রিপোর্ট জমা দিতে হতো সেখানকার ইউজিসিকে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটি সমমান রক্ষা হয় কি না, তা দেখভাল করা।
আমি সবিনয়ে ইউজিসির কাছে প্রশ্ন রাখছি, আপনারা কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার মান, উচ্চতর শিক্ষা কার্যক্রমের চুলচেরা নিরীক্ষা জনসমক্ষে প্রকাশ করেন? যদি করেন তবে বিশ্বের মানদণ্ডে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান দ্রুত নিচের দিকে যাচ্ছে কেন? এ ব্যাপারে আপনাদের কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর আছে? যদি না থাকে, তবে অযথা অক্সফোর্ড-জাতীয় কথাবার্তা না বলাই ভালো।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিংয়ের মান রক্ষা ও ওপরের দিকে তুলে ধরতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে আরেকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (বিএসি)। আমি বিদেশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পর্যায়ে কাজ করার সময় ওই দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দেশীয়, আন্তর্জাতিক ও আন্তর্জাতিক মান নির্ণয় ও তাদের গ্রহণযোগ্য স্বীকৃতি নিয়ে তিন-চারবার কাজ করেছি।
আমি বিনয়ের সঙ্গে বলছি, বিএসি সম্পূর্ণ একটি ভুল নামে তার দুর্বল অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বিএসি নামের প্রতিষ্ঠান কি এ দেশের মান নির্ণয় ও স্বীকৃতি দিয়ে থাকে? মোটেই না। অ্যাক্রেডিটেশনের অর্থ হলো মান নির্ণয়ের স্বীকৃতি। কোনো দেশের অ্যাক্রেডিটেশন সাধারণভাবে হয়ে থাকে কোনো প্রোগ্রামের (কার্যক্রম) মান নির্ণয় ও স্বীকৃতি ঘিরে। অথচ বিএসি নামধারী প্রতিষ্ঠানটি ভুল নামের আড়ালে এদিক-ওদিক ভারী ভারী কথা বলছে, যার কোনো অর্থ হয় না। প্রতিষ্ঠানটি সরকারি পয়সা, মানে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় চলছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে তাদের কোনো কথা নেই।
আমার সুপারিশ থাকবে, বিএসি নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ একাডেমিক অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (বিএএসি) করা হোক। তারপর যদি তাদের সদিচ্ছা ও শক্তিমত্তা থাকে, তবে তাদের কর্মকাণ্ড দেশের মানুষকে জানাক। মানুষ জানুক করদাতাদের করের পয়সায় আপনাদের কাজ কিছুটা করছেন। আপনাদের সৎ উপদেশ ও সুপারিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংঙ্কিংয়ে ভূমিকা রাখবে।
সবশেষে আমি ইউজিসির উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপরের দিকে কর্মকর্তা নিয়োগের নতুন পদ্ধতিকে স্বাগত জানাই। নিয়োগের সুপারিশ দেওয়ার জন্য যে পুল তৈরি হবে, তাতে দেশের খ্যাতিমান শিক্ষকদের যাতে জায়গা হয়—দলমানা শিক্ষক ও আমলাদের দ্বারা ওই পুল তৈরি হলে তা হবে ঠুঁটো জগন্নাথ—যা ভালো কিছু দিতে পারবে না।
আর র্যাঙ্কিংয়ের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হলে শিক্ষা কার্যক্রম, মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ ও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা একান্ত জরুরি। যখন দেখি, অনেক শিক্ষক কোনোরকমে তাঁদের ক্লাস নেওয়ার পরপরই ছুটে যান প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কড়ি কামানোর জন্য, তখন র্যাঙ্কিংয়ের অবস্থা ওপরে ওঠার চেয়ে নিচের দিকে যেতে থাকবে, সন্দেহ নেই।
ড. এ এস এম মুজিবুর রহমান ইমেরিটাস অধ্যাপক, সুলতান কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়