চাওয়ার সঙ্গে পাওয়া মেলাতে গেলে কেন পাওয়ার সুখ কমে যায়

মানুষ যে আদতে কীসে খুশি হবে, কী পেলে সে নিজেকে সত্যিকার অর্থে সুখী মনে করবে, সেটা কি সে নিজে জানে? মানুষ কি জানে, বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে কতটা প্রত্যাশা ও আশা সে করে? জানে না।

গৌতম বুদ্ধ তাঁর অনুসারীদের প্রশ্ন করেছিলেন, কোন প্রাপ্তি তোমাকে সবচেয়ে সুখী করবে? বুদ্ধের এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি তাঁর অনুসারীরা। এর উত্তর এখনো দেওয়া অসম্ভব। কারও পক্ষে এ-সংক্রান্ত কোনো অনুমান করাও কঠিন।

প্রত্যাশা ও আশা ঠিক এমনই দুটি শক্তিশালী বিষয়, যাকে আশ্রয় করে মানুষ বাঁচে। আবার আশা পূরণ না হলে কষ্ট পায় এবং ভেঙে পড়ে, এমনকি আশাভঙ্গের ব্যথা সইতে না পেরে আত্মহননও করে। বড় ধরনের ব্যর্থতার পরও মনের কোনায় একটু আশা জাগিয়ে রাখে মানুষ, যদি ভালো কিছু হয়।

প্রত্যাশা থাকতে পারে সন্তানের কাছে, স্বামী বা স্ত্রীর কাছে, ভালোবাসার মানুষের কাছে, আত্মীয়-পরিজন, সহকর্মী ও বন্ধুদের কাছে। সাধারণত মা-বাবার কাছে সন্তানের প্রত্যাশার তেমন কিছু থাকে না। কারণ, মা-বাবা সব সময়ই চেষ্টা করেন সাধ্যের বাইরে গিয়ে সন্তানকে দিতে, সন্তানের জন্য কিছু করতে।

অবশ্য মা-বাবার মনে সন্তানকে ঘিরে কিছু প্রত্যাশা থাকে। তাঁরা চান সন্তান পড়াশোনা করে বড় হোক, নিজের পায়ে দাঁড়াক, সংসারে থিতু হোক এবং বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার পাশে থাকুক। মুখে স্বীকার না করলেও মা-বাবার মনে এমন একটি আশা থাকে। যে সন্তানকে ঘিরে তাঁদের জীবন পরিচালিত হয়, তাদের কাছে প্রত্যাশা করাটা খুব স্বাভাবিক।

ছেলের কাছে মা-বাবার প্রত্যাশা বেশি থাকে। কারণ, তাঁরা বৃদ্ধ বয়সে ছেলেকেই অভিভাবক বলে মনে করেন, মেয়েকে নয়। অপ্রিয় হলেও এ কথা সত্য, এ জন্যই আমাদের সমাজে ছেলেশিশুর কদর মা-বাবার কাছে বেশি।

ভবিষ্যতে সেই ছেলের বাসায় যখন মা-বাবার আশ্রয় হয় না, ছেলে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না বা মানুষ হয় না, তখন মা-বাবা অনেক বেশি ভেঙে পড়েন। বাস্তবতা এমন একটি ব্যাপার, যেখানে প্রত্যাশা ও প্রত্যাশাভঙ্গ পাশাপাশি অবস্থান করে।

সন্তান যখন চাকরি পায়, তখন বয়স্ক মা-বাবার মনে প্রত্যাশা তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক যে এবার সন্তান তাঁদের দেখভাল করবে। তাঁরা তাঁদের সবকিছু দিয়ে সন্তানকে বড় করেছেন, এই আশায় যে একদিন তাঁরা চিন্তামুক্ত জীবন কাটাবেন। সব মা-বাবার সে আশা হয়তো পূরণ না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মা-বাবার প্রত্যাশা ভেঙে যায় এবং তাঁরা বিপর্যস্ত বোধ করেন মানসিক, আর্থিক ও শারীরিকভাবে।

প্রত্যাশা হলো এমন একটি দৃঢ় ধারণা, যখন মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে আমি যেমন চাইছি, ঠিক তেমনই কিছু ঘটবে, হয়তো খানিকটা বেশিই হবে। মনের ভেতরে থাকা আমাদের এ প্রত্যাশা থেকেই অনেক সময় আমাদের বাস্তব চাওয়া-পাওয়া নির্ধারিত হয়ে থাকে। যেমন যখন পরিচিত কেউ বিদেশ থেকে আসে, আমরা প্রত্যাশা করি, নিশ্চয়ই সে কিছু উপহার নিয়ে আসবে আমার জন্য।

যদি আনে, তখন বিচার করি আমার প্রত্যাশার সঙ্গে মিলল কি না? যা ভেবেছি, তা-ই এনেছেন কি না? উপহারের দাম, প্রকৃতি বিচার করি। প্রত্যাশার সঙ্গে মেলাতে গিয়ে উপহার পাওয়ার সুখ ও আনন্দ কমে যায়।

অন্যের প্রতি বা নিজের জীবনের প্রতি যার আশা, চাহিদা অথবা প্রত্যাশা যত বেশি, তার প্রত্যাশাভঙ্গের বেদনাও তত বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। জীবনের কোনো কোনো সময় মানুষকে বলতে শোনা যায়, আমার বন্ধু, আমার ভাই বা প্রিয়জন কেন এমন আচরণ করল আমার সঙ্গে?

আমি তো ভেবেছিলাম আমার দরকারে ও আমার পাশে দাঁড়াবে, খোঁজখবর নেবে এবং সাহায্য করবে। কিন্তু সব সময় মানুষের চিন্তা অনুযায়ী বা প্রত্যাশা মতো সব চাওয়া পূরণ হয় না এবং হওয়া সম্ভবও নয়। এটা মেনে নেওয়াতেই বড় শান্তি।

এই আমি বা আপনি বিভিন্নজনের কাছে যা প্রত্যাশা করছি, সেই আমি বা আপনি কি পারছি অন্যের প্রত্যাশা পূরণ করতে? আমার মা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন সব সময় চাইতেন তাঁর সব আত্মীয়স্বজন আসবেন, খোঁজখবর নেবেন, ফোন করবেন।

কারণ, একটা সময় অসংখ্য মানুষের ভিড়ে আমাদের বাড়ি গমগম করত। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অসংখ্য মানুষ আসতেন, থাকতেন। আম্মা তাঁদের আদর করতেন, সাহায্য করতেন, রেঁধেবেড়ে খাওয়াতেন।

আম্মা তাঁর বৃদ্ধ বয়সে এসে প্রত্যাশা করতেন, এখনো সেসব মানুষ সেভাবেই আম্মার বা আমাদের খোঁজখবর করবেন। বুঝতেই চাইতেন না এখন সময় বদলেছে, মানুষের ব্যস্ততা, জীবনযাপন সবই বদলে গেছে। মনে মনে চাইলেও অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না। আমাদের প্রত্যেকের দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন ও ব্যস্ততায় সবাই ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়ছি।

আম্মাকেও সেটাই বোঝাতাম যে প্রত্যাশা কোরো না, কষ্ট বাড়বে। দেখ আমরাও তো পারি না কত স্বজনের খোঁজ নিতে। কাজেই যে যতটুকু করবে, তাতেই খুশি হও, দেখবে খুব ভালো লাগছে।

মানুষ যখন নিজেই কিছু অর্জন করতে চায়, যেভাবে নিজের জীবনকে গড়তে চায়, সেটাই আশা। আর অন্যের কাছ থেকে মানুষ যা পেতে চায় বা অর্জন করতে চায়, তাকে বলে প্রত্যাশা। আশা ভেঙে গেলেও যেমন মানুষের কষ্ট হয়, প্রত্যাশা পূরণ না হলেও মানুষের কষ্ট হয়। মানুষ যত দিন বাঁচে, আশা নিয়েই বাঁচে।

জীবনযুদ্ধে আশাই মানুষের মনে ও শরীরে শক্তি দেয়। কখনো কোনো কারণে আশা পূরণ না হলে, মানুষ হয়তো কিছুদিনের জন্য ভেঙে পড়ে, হতাশায় ভোগে। কিন্তু পরিবার, স্বজন, বন্ধু, সহকর্মীদের সহযোগিতা পেলে হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারে।

মানুষ যতই চেষ্টা করুক প্রত্যাশাহীন জীবন কাটাতে বা কারও কাছে কোনোরকম প্রত্যাশা না রাখতে, সেটা প্রায় অসম্ভব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের প্রত্যাশা থাকবেই প্রিয়জনদের কাছে। তবে প্রত্যাশাটা হওয়া উচিত পাশের মানুষটির মন, সামর্থ্য ও সময় বুঝে। নয়তো সুখের চেয়ে দুঃখই বেশি হবে।

এই যে নিজের জীবনের আশা পূরণ করার জন্য অন্য মানুষের সহযোগিতা কামনা করা, এটাই প্রত্যাশা। অন্যদিকে মানুষ যে আশা নিয়ে ছোটবেলা থেকে বড় হয়, সেই আশা পূরণ করার জন্য অনেকগুলো ধাপ পার হতে হয়। এর কোনো একটি ধাপে এসে যদি মানুষ আটকে যায়, অমনি তার জীবনের দৃশ্যপট পাল্টে যেতে পারে। গুণীজনেরা বলেন, সত্যি যদি আশা পূরণ করতে চাও, সিঁড়ির প্রতিটি স্টেপে পা রেখে ওঠো, তাতে ভারসাম্য বজায় থাকবে।

মানুষ যতই চেষ্টা করুক প্রত্যাশাহীন জীবন কাটাতে বা কারও কাছে কোনোরকম প্রত্যাশা না রাখতে, সেটা প্রায় অসম্ভব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের প্রত্যাশা থাকবেই প্রিয়জনদের কাছে। তবে প্রত্যাশাটা হওয়া উচিত পাশের মানুষটির মন, সামর্থ্য ও সময় বুঝে। নয়তো সুখের চেয়ে দুঃখই বেশি হবে।

সাধারণত মানুষ এমন মানুষের কাছেই প্রত্যাশা করে, যার সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্ক। এখানে কোনো কারণে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলে সম্পর্কটাই ভেঙে যেতে পারে, পারিবারিক বন্ধন টুটে যেতে পারে।

মানুষ এমনও কিছু প্রত্যাশা করতে পারে, যা প্রকৃতপক্ষে না-ও ঘটতে পারে। যেমন যদি ভাবি সবার জীবন একইভাবে চলবে, আমি যেভাবে চাইছি সেভাবেই সবকিছু ঘটবে, সবার সব চাওয়া ন্যায্য হবে, তাহলে ভুল হবে।

এ ছাড়া কেউ যদি ভাবে যে সবাই তার সঙ্গে একমত হবে, প্রত্যেকেই তাকে পছন্দ করবে, ভালোবাসবে, এটাও ভুল প্রত্যাশা করা হবে। আমি যেমন আমার পরিচিত সবাইকে একভাবে মূল্যায়ন করি না, অন্যের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য ধরে নিতে হবে। এর চেয়ে বরং আমাদের উচিত, যাদের আমরা ভালোবাসি ও পছন্দ করি, তাদের সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্ক তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে প্রত্যাশা পূরণের হার বাড়বে।

কিন্তু এরপরও আনন্দ-হাসি নিয়ে সুন্দর ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে প্রত্যাশা করতে হয়। এমনকি চিকিৎসকেরাও বলেন, সেই রোগীই দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন, যাঁর মনের জোর বেশি, যাঁর বেঁচে থাকার ইচ্ছা আছে এবং পাশে ভরসা করার মতো মানুষ আছে।

তাঁরা এ-ও বলেন, কেউ যদি ইতিবাচক চিন্তা করেন, তাহলে তাঁর মন ও শরীর দুই ভালো থাকে। আর যাঁরা ভালো চিন্তা করেন, তারা আশা নিয়ে বাঁচেন।

একটি লেখায় পড়েছি, তিন হাজার বছর আগের হিতোপদেশে বলা হয়েছে, ‘সানন্দ হৃদয় স্বাস্থ্যজনক; কিন্তু ভগ্ন আত্মা অস্থি শুষ্ক করে।’ আশা ও প্রত্যাশা দুটোই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ছোট কিছু করে বা সামান্য কিছু দিয়ে আমরা প্রিয়জনের মন ভরিয়ে দিতে পারি।

যেমন মানুষ প্রত্যাশা করে যে তার জন্মদিনে প্রিয়জনেরা তাকে শুভাশীষ জানাবে। সেই প্রত্যাশা পূরণ হলে ব্যক্তি খুব আনন্দিত হয় এবং বেঁচে থাকার উৎসাহ পায়। অন্যদিকে মানুষ যত বেশি হতাশ হয়, তত বেশি তার মানসিক ও শারীরিক শক্তি ক্ষয় হতে থাকে।

অথচ আমরা যদি একটু অন্যভাবে ভাবি, যেমন অন্যে যা প্রত্যাশা করেনি, আমরা ঠিক সেই কাজটিই করি, তাহলে দেখব দুজনের মধ্যেই সুখের অনুভূতি প্রবল হচ্ছে। যেমন পরিবারের তরুণ সদস্যটি যদি পরিবারের বয়স্ক মানুষকে নিয়ে সময় কাটান, প্রিয় বন্ধুর সাফল্যে তাকে নিয়ে খেতে যান, ভালোবাসার মানুষকে বছরের প্রথম বেলি ফুলের মালাটি কিনে দেন, দেখা যাবে তিনি হয়তো তা প্রত্যাশাই করেননি।

তাই প্রত্যাশার বেশি কিছু পেয়ে খুব খুশি হয়ে উঠবেন, যা দুজনকেই সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে সাহায্য করবে।

মানুষ সবচেয়ে বেশি যাকে পরিবর্তন করতে পারে, সেটা নিজেকে। তাই প্রত্যাশার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সুখী হওয়ার মন্ত্রটা জানা দরকার এবং সেভাবে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। সবাই আমার কথা শুনবে বা বুঝবে, এটা না ভেবে আমরা তো সহানুভূতির সঙ্গে অন্য কারও কথা শোনা ও বোঝার চেষ্টা করতে পারি।

আমরা যদি অনেক কিছু প্রত্যাশা না করে ছোট কিছু প্রত্যাশা করি এবং সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়ে যায়, তাহলে আনন্দের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। আমার যা আছে, আমি অন্যকে কতটুকু দিতে পারছি, আমি যা চাইছি, এর কতটুকু আমি পাচ্ছি...এ রকম একটি হিসাব মনের মধ্যে থাকলে, মানুষে মানুষে তা সব ব্যবধানকে অদৃশ্য করে দিতে পারে। জ্ঞানীরা বলেন, সাধ্যের মধ্যেই আছে সব সত্য। সাধ্যের বাইরে যে সাধ, তা কালে পূরণ হওয়ার নয়।

প্রখ্যাত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. এলিস লাস্কি বলেছেন, মানুষের নিজের এবং অন্যের ক্ষেত্রে ‘উচিত’ ও ‘অবশ্যই’ শব্দ দুটি পরিহার করা উচিত। কারণ, মানুষ যখন তার অবাস্তব আশা ও প্রত্যাশাগুলো ছেড়ে দিতে শিখবে, তখন তার সামনে একটি রাস্তা খুলে যাবে।

  • শাহানা হুদা যোগাযোগকর্মী ও কলাম লেখক