সম্প্রতি কুড়িগ্রাম জেলার সীমান্তবর্তী ফুলবাড়ী উপজেলায় গিয়ে দেখলাম স্থানীয় অনেকে মিলে নীলকুমর নদ ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ ঘটনা কাছে থেকে না দেখলে নদ ভাগ-বাঁটোয়ারা করার বাস্তবতা হয়তো কোনো দিন বুঝতে পারতাম না। স্বল্পশিক্ষিত-বেশি শিক্ষিত অনেকে মিলে নদটি খেয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন।
তাঁরা মনে করেন, নদটি যেহেতু ভরাট হয়েছে, তাই সেটি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়া তাঁদের অধিকার। কেউ খনন করতে এলে তাঁরা বাধা দেবেন—এ কথাই তাঁরা বলছেন। সারা দেশে নদী নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসব দখলদারের পক্ষ নিতে পারে, সেই আশঙ্কা বেশি। যদি স্থানীয় প্রশাসন নদের পক্ষে দাঁড়ায়, তাহলে সেটি হবে বিরল ঘটনা।
যাঁরা নদটি নিজেদের নামে লিখে নিতে চান, এমন একজনের সঙ্গে কথা হয় ফুলবাড়ী উপজেলার টংকার মোড়ে। তিনি জানালেন, নতুন রেকর্ড করার সময়ে এক লাখ টাকা সেটেলমেন্ট অফিসারকে ঘুষ দিয়েছিলেন। ঘুষের বিনিময়ে তাঁর নামে সাত বিঘা রেকর্ড হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে বেশি জানাজানি হওয়ার কারণে তাঁর নামে রেকর্ড হয়নি।
ওই সেটেলমেন্ট অফিসার বিভিন্নজনের কাছে আনুমানিক ৫০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন মর্মে ‘ঘুষদাতা’ ব্যক্তিটি জানান। যে সেটেলমেন্ট অফিসার ঘুষ নিয়েছিলেন বলে ওই ব্যক্তি দাবি করেছেন, সেই অফিসার মারা গেছেন। ঘুষের টাকাও তিনি ফেরত দেননি বলে ঘুষদাতা দাবি করেছেন। সে জন্য আক্ষেপ করে ঘুষদাতা বলছিলেন, অফিসারটি মারা গেলেও তিনি ক্ষমা করবেন না। টংকার মোড় বাজারে অনেকের কাছে একই ধরনের ঘুষের বিষয়ে জানতে পারলাম।
নীলকুমর নদ ফুলবাড়ী উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদটি নীলকুমর, নীলকুমার ও নীলকমল নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের অন্যতম ছিটমহল ছিল দাসিয়ারছড়া। বিলুপ্ত দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নীলকুমর। কালীরহাট বাজারের কিছুটা দূরে আজেরজল নামক স্থানে নদটি দুই ভাগ হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অর্থাৎ একটি শাখা নদী বেরিয়ে গেছে। দুটি প্রবাহই মিলেছে আন্তসীমান্ত নদী ধরলায়। দুটি প্রবাহই নীলকুমর নামে পরিচিত। শুষ্ক মৌসুমে কয়েক বছর আগেও সারা বছর পানি থাকত। এখন আর সম্পূর্ণ নদে সারা বছর পানি থাকে না। নদটি আন্তসীমান্ত হলেও যৌথ নদী কমিশন কর্তৃক স্বীকৃত নয়।
আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য হলো, জেলা কিংবা উপজেলা প্রশাসন যদি নদী সুরক্ষার কাজ না করেন, তাহলে মন্ত্রীদেরও কিছুই করার থাকে না। ফলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দয়ার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। তাঁদের কোনো জবাবদিহি নেই। যখন নদীকর্মীরা আন্দোলন করেন, তখন প্রশাসনে থাকা ব্যক্তিরা আন্দোলনকারীদের সরকারবিরোধী আখ্যা দিয়ে নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করেন।
আজেরজল নামক স্থানে ঠিক যে স্থানে একটি শাখা নদী উৎপন্ন হয়েছে, ওই স্থানেই সেতুবিহীন আড়াআড়ি পাড় দিয়ে পুকুর তৈরি করা হয়েছে। ফলে নীলকুমর নদের পানি দুই নদীতে যেতে পারে না। পানির উৎস বন্ধ করা হয়েছে, অনেকগুলো ছোট ছোট সেতু তৈরি করা হয়েছে, যা নদের প্রকৃত মাপের চেয়ে অনেক ছোট।ÿ ক্ষেত্রবিশেষে ৫-১০ ভাগের এক ভাগ।
এই নদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বাস্তবতা আছে। যখন ছিটমহল বিলুপ্ত হয়নি, তখন ছিটমহলের ভেতরের জমি বেচাকেনার কোনো উপায় ছিল না। ফলে নদের যে অংশ ছিটমহলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, সে অংশ কেউ দখল করতে পারেনি। ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময় হওয়ার পর থেকে নদটি ব্যক্তির নামে লিখিত নেওয়ার জোর চেষ্টা চলছে। যে অংশ ছিটমহলের বাইরে ছিল, তার অনেক অংশ ব্যক্তির নামে লিখেও নেওয়া হয়েছে।
নদটি উদ্ধারে কয়েকটি কাজ করা জরুরি। প্রথমত সিএস রেকর্ডের আলোকে এবং বিদ্যমান অবস্থান আমলে নিয়ে নদটি খনন করতে হবে। যে অংশ ব্যক্তির নামে লিপিবদ্ধ হয়েছে, রেকর্ড সংশোধনের আগে সেই মালিকানা বাতিল করতে হবে। তারপর খননপূর্বক রেকর্ড সংশোধন করতে হবে। যাঁরা অবৈধভাবে নদ ব্যক্তির নামে লিখে দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। ২০-২৫ বছর আগে এসি ল্যান্ড কিংবা ইউএনও যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হয়তো আজ সচিব, জ্যেষ্ঠ সচিব হয়েছেন। এ রকমও যদি কেউ ব্যক্তির নামে নদ লিখে দিয়ে থাকেন, তবু তাঁদের শাস্তি দিতে হবে।
নীলকুমর নদের দুটো প্রবাহের অনেকগুলো স্থানে ঘুরেছি। যাঁরা দখল করেছেন এবং করতে চান, তাঁদের কাছে নদের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। তাঁরা মনে করেন, নদটি বীজতলা হিসেবে খুব কাজে লাগছে। ধান চাষ হচ্ছে, এটি খুব লাভজনক। ভাগ-বাঁটোয়ারার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য সবার ভাষ্য হচ্ছে, এই নদ খনন হতে এত সময় লাগছে কেন। তাঁরা চান দ্রুত নদটি খনন করা হোক। বাস্তবে নদটি খনন হলে এবং অবৈধ দখলদারদের কাগজমূলেও উচ্ছেদ করতে পারলে নদটি বাঁচবে। নয়তো নদটি বেদখল হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অভিশাপে পরিণত হবে।
গত বছর নদটির একটি অংশ খনন করতে গিয়েছিলেন বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা। খনন করতে দেওয়া হয়নি। এ বছর জেলা প্রশাসনের উচিত হবে নদর পক্ষে থাকা। সরকারের পক্ষে থেকে একই সঙ্গে নদটি উদ্ধার করা এবং খনন করায় সার্বিক সহায়তা দেওয়া।
নদটি সরেজমিন দেখতে গিয়েছিলাম বাংলা বিভাগের সহকর্মী খাইরুল ইসলামসহ। ফেরার সময়ে বাস থেকে নেমে রিকশায় যাচ্ছিলাম আর নদটির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে কথা বলছিলাম। নদ ব্যক্তির নামে লিখিত হওয়ার প্রসঙ্গ এলে সাধারণ রিকশাচালক আমাদের সঙ্গে আলাপে যোগ দিলেন এবং বললেন, ‘নদী কাঁইয়ো লেখি নিবার পাবার নয়। নদী লেখি নেওয়া যায় না।’ আমাদের সাধারণ খেটে খাওয়া এই নাগরিক যেভাবে নদীকে বোঝেন, সেভাবে যদি তথাকথিত সচেতন ব্যক্তিরা কিংবা নদীর প্রতি দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বুঝতেন, তাহলে নদীর সর্বনাশ হতো না। তখন নদীর প্রশ্নে মানবিক বাংলাদেশ হতো।
আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য হলো, জেলা কিংবা উপজেলা প্রশাসন যদি নদী সুরক্ষার কাজ না করেন, তাহলে মন্ত্রীদেরও কিছুই করার থাকে না। ফলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দয়ার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। তাঁদের কোনো জবাবদিহি নেই। যখন নদীকর্মীরা আন্দোলন করেন, তখন প্রশাসনে থাকা ব্যক্তিরা আন্দোলনকারীদের সরকারবিরোধী আখ্যা দিয়ে নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করেন।
এসব করে হয়তো দখলদারদের স্বার্থ দেখা যাবে, দেশের নয়। আমরা চাই সংশ্লিষ্ট উপজেলা এবং জেলা প্রশাসন নদটি সুরক্ষায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিক। নয়তো ভাগ–বাঁটোয়ারাকারী ও প্রশাসনের দেওয়া অপবাদ মেনে নিয়ে নদ উদ্ধারে প্রতিবাদ তথা আন্দোলন জারি রাখতে হবে।
● তুহিন ওয়াদুদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নদী রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক
wadudtuhin@gmail.com