ইউক্রেন যুদ্ধ: পুতিনের দায় বনাম ন্যাটোর বেপরোয়া উসকানি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রাগারকে প্রস্তুত অবস্থায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
ছবি: এএফপি

একটি পারমাণবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কার ব্যাপারে বিশ্বের বিদ্যমান উদাসীনতা আজ স্পষ্টতই একটি বোধ–বিবেচনাহীন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়া এবং পশ্চিমকে পারমাণবিক উত্তেজনার দিকে নিয়ে যেতে পারে—এমন আশঙ্কার বিষয়টিকে কয়েক মাস ধরে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা খাটো করে দেখাচ্ছেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রাগারকে প্রস্তুত অবস্থায় রাখার নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে অনেক বিশেষজ্ঞ বলে আসছেন, পুতিন আসলে তাঁর ‘প্রতিপক্ষদের দূরে ঠেলে ফেলার’ জন্য মিথ্যামিথ্যি ভয় দেখিয়েছেন।

তবে গত বুধবার সকালে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচার করা ভাষণে পুতিন এ অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে আবার যে হুমকি দিয়েছেন, তার অন্তর্নিহিত প্ররোচনা ও উদ্দেশ্যকে কোনোভাবেই আর হালকাভাবে নেওয়া ঠিক হবে না।

যুদ্ধ সবার জন্য, বিশেষ করে ইউক্রেনের জন্য একটি বিপর্যয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। সে জন্য মাথা ঠান্ডা রাখার বিষয়টি অবশ্যই প্রাধান্য পাবে। যাঁরা এখনো জয়ের আশা করছেন, তাঁদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পারমাণবিক যুদ্ধে আসলে কারোরই জয় হয় না

তিনি সেখানে অভিযোগ করেছেন, পশ্চিমা কর্মকর্তারা রাশিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি দিয়েছেন (যদিও তাঁর বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তাঁর বক্তৃতার সময় অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন)। পুতিন তাঁর ভাষণে ইউক্রেনের চারটি রুশনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আসন্ন গণভোটে তাঁর সমর্থন দেন এবং সেখানে সেনা সমাবেশ ঘটাবেন বলে ঘোষণা করেন। ওই রুশ সেনাদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া অঞ্চলগুলো রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে কি না, তা অনুষ্ঠেয় গণভোটে ফয়সালা হবে।

পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিকে অপ্রাসঙ্গিক বলে উড়িয়ে দেওয়াকে আপাতত পশ্চিমাদের জন্য একটি সাচিবিক বিষয় হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে তাঁর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা যত দূরবর্তীই হোক না কেন, তাঁর এ অস্ত্র ব্যবহারের যেকোনো সুযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।

প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের ওপর নো-ফ্লাই জোন আরোপ করা বা রাশিয়ার ভূখণ্ডের জন্য হুমকি হতে পারে, এমন কোনো দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্র ইউক্রেনকে দেওয়া থেকে এ কারণে বিরত আছে যে প্রতিশোধ হিসেবে ক্রেমলিন ইউরোপকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।

তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কিয়েভকে যে অত্যাধুনিক সামরিক সহায়তা দিয়েছে, তা ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। গত কয়েক সপ্তাহে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান ক্ষয়ক্ষতি স্পষ্টতই পুতিনকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। তিনি ক্ষুব্ধ হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন এবং দেশে-বিদেশে নিজের প্রভাব হারাচ্ছেন। এ কারণেই তিনি ইউক্রেনে তার বিপত্তি পাল্টাতে তিন লাখ অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

অতীতের রাশিয়ান এবং আমেরিকান যুদ্ধগুলো ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাক বা অন্য অনেক জায়গায় দেখিয়েছে, সেনাসংখ্যা বাড়িয়ে যুদ্ধের সময় বাড়ানো যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেতা যায় না। এ কারণে তিনি তাঁর সামরিক আয়োজনে পারমাণবিক সতর্কতাকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। এর মাধ্যমে তিনি পশ্চিমকে এ নোটিশ দিয়ে রেখেছেন, ‘পিছু হটো, নয়তো পরিণতি মোকাবিলা করো’।

এখানেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারে পুতিনের হুমকির গুরুত্ব। হুমকিটি ‘একটি ফাঁকা আওয়াজ’ নয় বরং এ হুমকির বিষয়ে পুতিনকে বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস মনে হচ্ছে। সাত মাস আগে আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন সবচেয়ে বড় সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছেন পুতিন। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এত বিশাল সংখ্যক সেনা সমাবেশ আর কখনো দেখা যায়নি।

পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো পারমাণবিক অস্ত্রের আশ্রয় না নিয়েই অতীতে প্রচলিত যুদ্ধগুলোতে হার স্বীকার করেছে। সে জন্য বিশ্বশক্তিগুলোর উচিত দ্রুত উত্তেজনা বন্ধ করা এবং দেরি না করে কূটনৈতিক সমাধান খোঁজা।

সোজা কথায়, যুদ্ধটা যদি দীর্ঘায়িত হতে থাকে এবং অস্ত্র ব্যবহার বাড়তে থাকে, তাহলে পারমাণবিক বিপর্যয়ের বিপদ বাস্তবিকই আমাদের সামনে ঝুলছে। সেটি কৌশলগতভাবে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের মাধ্যমেও ঘটতে পারে কিংবা পারমাণবিক প্ল্যান্টে বোমা হামলা থেকেও হতে পারে।

তবে এর কোনোটিই অমোঘ বা অনিবার্য নয় বরং এর সবগুলোই সম্পূর্ণ এড়ানো সম্ভব। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো পারমাণবিক অস্ত্রের আশ্রয় না নিয়েই অতীতে প্রচলিত যুদ্ধগুলোতে হার স্বীকার করেছে। সে জন্য বিশ্বশক্তিগুলোর উচিত দ্রুত উত্তেজনা বন্ধ করা এবং দেরি না করে কূটনৈতিক সমাধান খোঁজা।

যুদ্ধ সবার জন্য, বিশেষ করে ইউক্রেনের জন্য একটি বিপর্যয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। সে জন্য মাথা ঠান্ডা রাখার বিষয়টি অবশ্যই প্রাধান্য পাবে। যাঁরা এখনো জয়ের আশা করছেন, তাঁদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পারমাণবিক যুদ্ধে আসলে কারোরই জয় হয় না।

 আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  •  মারওয়ান বিশারা মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক ও লেখক