‘শরীফার গল্প’-এর সমস্যা নিয়ে ভাবা দরকার

সপ্তম শ্রেণির নতুন ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ‘শরীফার গল্প’ আছে। গল্পে এমন এক মানুষের কথা বলা হয়েছে, যিনি নিজেকে মেয়ে মনে করেন, অথচ শারীরিকভাবে তিনি একজন পুরুষ। তিনি ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের মতো সাজতে ও পোশাক পরতে পছন্দ করতেন। কিন্তু আশপাশের কেউ তাঁর এ আচরণ সহজভাবে মেনে নেননি। এ কারণে একসময় তাঁকে বাড়ি ছেড়ে হিজড়াদের দলে যোগ দিতে হয়। সেখানে যাওয়ার পর তিনি অন্য হিজড়াদের সঙ্গে একাত্ম অনুভব করেন।  

গল্পটা এখানে শেষ হতে পারত। কিন্তু এরপর শরীফ থেকে শরীফা নামধারী এই মানুষটি বলছেন, ‘শহরের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে, নতুন শিশু আর বর-বউকে দোয়া-আশীর্বাদ করে পয়সা রোজগার করি। কখনো লোকের কাছে চেয়ে টাকা সংগ্রহ করি। আমাদেরও ইচ্ছে করে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন কাটাতে, পড়াশোনা, চাকরি-ব্যবসা করতে। এখনো বেশির ভাগ মানুষ আমাদের সঙ্গে মিশতে চায় না, যোগ্যতা থাকলেও কাজ দিতে চায় না।’

শরীফার এই গল্প আছে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ অধ্যায়ে। পাঠটি যোগ করা হয়েছে লিঙ্গবৈচিত্র্য ও জেন্ডারের ধারণা দিতে। পাঠ্যবইয়ে এ-সম্পর্কিত ধারণা যোগ করার আগে হিজড়াদের নিয়ে আসা হয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) আবাসিক কর্মশালায়। নতুন শিক্ষাক্রমের ১০টি বিষয়ের লেখকদের সঙ্গে তাঁদের মতবিনিময়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বই প্রকাশের অল্প সময়ের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হবে, এটি এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বা বইয়ের লেখকদের ধারণায় ছিল না।

বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, পাঠ অংশের উপস্থাপনায় কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়ে থাকলে এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করলে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় লেখাটি পর্যালোচনা করার জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দিয়েছে। এ পর্যালোচনার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মাথায় রাখা দরকার। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট, বিদ্যমান আইন এবং ধর্মীয় চিন্তার সঙ্গে যত দূর সম্ভব একে সমন্বিত করতে হবে। নইলে এই অবহেলিত জনগোষ্ঠী তাদের ন্যূনতম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকবে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হিজড়া শিক্ষার্থীদের ভাতা দেওয়া হয়। তবে দুটি কারণে বেশির ভাগ হিজড়া শিক্ষার্থী ভাতার সুবিধা পান না। প্রথমত, অভিভাবকেরা সন্তানের হিজড়া পরিচয় লুকিয়ে রাখেন। দ্বিতীয়ত, পরিবার ও সমাজের নানা বাধার শিকার হয়ে হিজড়া শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ছেড়ে দেন। হিজড়া শিশুদের ঝরে পড়া ঠেকাতে কিংবা মূলধারার শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। এর বাইরেও সমস্যা আছে।

২০১৮ সালে প্রকাশিত হার্ভার্ড ডিভিনিটি স্কুলের একটি ধারণাপত্রে উল্লেখ আছে, ব্রিটিশ সরকার ১৮৭১ সালে হিজড়াদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করে এবং তাঁদের দেখামাত্র গ্রেপ্তার করার আদেশ দেয়। এখন বাংলাদেশে ‘ট্রান্সজেন্ডার’-সম্পর্কিত ধারণার বিরোধী যাঁরা, তাঁরা এটিকে কেবল সমকামিতা দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। লৈঙ্গিক পরিচয় আর জেন্ডার পরিচয় যে সব সময় মেলে না, তার নমুনা হিসেবে পৃথিবীতে রয়েছে ট্রান্স-নারী আর ট্রান্স-পুরুষ মানুষগুলো।

বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে ট্রান্সজেন্ডারদের সরাসরি স্বীকৃতি নেই। ‘থার্ড জেন্ডার’ বা ‘হিজড়া’ নামে এ ধরনের মানুষের লিঙ্গবৈশিষ্ট্য নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও উপমহাদেশের বাইরে ‘থার্ড জেন্ডার’ শব্দটির ব্যবহার সীমিত আর ‘হিজড়া’ এ অঞ্চলের একটি বিশেষ সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়। ফলে থার্ড জেন্ডার বা হিজড়া নামের মধ্যে ট্রান্স-নারী ও ট্রান্স-পুরুষদের পরিচয় স্পষ্ট হয় না।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করে। সেখানে বলা হয়, ক্রোমোজমের ত্রুটি বা জেনেটিক কারণে যেসব জন্মগত যৌনপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নারী বা পুরুষ কোনো শ্রেণিতেই অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, তাঁরা হিজড়া।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চারটি শিক্ষা কমিশন, একটি কমিটি এবং একটি শিক্ষানীতি হয়েছে। ১৯৭২ সালের কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে সব শিশুর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে বলেছে। ১৯৮৮ সালের মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশন শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। ১৯৯৭ সালের শামসুল হক কমিটি সৌহার্দ্য গড়ে তোলা ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলার কথা বলেছে। ২০০২ সালের এম এ বারী কমিশন এবং ২০০৩ সালের মনিরুজ্জামান মিঞা কমিশন সর্বজনীন শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছে।

সর্বশেষ ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে সব ধরনের প্রতিবন্ধী এবং আর্থসামাজিকভাবে বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার উল্লেখ আছে। তবে কোনো কমিশন, কমিটি বা নীতি হিজড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে আলাদা করে কিছু বলেনি। এই প্রথম নতুন শিক্ষাক্রমে লিঙ্গসহ সব ধরনের বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় নিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হিজড়া শিক্ষার্থীদের ভাতা দেওয়া হয়। তবে দুটি কারণে বেশির ভাগ হিজড়া শিক্ষার্থী ভাতার সুবিধা পান না। প্রথমত, অভিভাবকেরা সন্তানের হিজড়া পরিচয় লুকিয়ে রাখেন।

দ্বিতীয়ত, পরিবার ও সমাজের নানা বাধার শিকার হয়ে হিজড়া শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ছেড়ে দেন। হিজড়া শিশুদের ঝরে পড়া ঠেকাতে কিংবা মূলধারার শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। এর বাইরেও সমস্যা আছে।

হিজড়া শিক্ষার্থীরা সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন এবং তাঁদের উপযোগী পরিবেশ নেই। যেমন হুইলচেয়ার ব্যবহার করা শিক্ষার্থীর জন্য র‍্যাম্প দরকার, তেমনি হিজড়া শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা শৌচাগার দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের কোটায় ভর্তির সুযোগ রাখা হয়েছে; তবে চিন্তা করা হয়নি এ ধরনের শিক্ষার্থী ভর্তি হলে তাঁদের কোন আবাসিক ব্যবস্থায় রাখা হবে।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, চিকিৎসা ও সম্পত্তির অধিকারের প্রয়োজনীয়তার কথা সরকারও স্বীকার করেছে। তবে ফলপ্রসূ একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি করার জন্য নির্ভরযোগ্য ভিত এখনো সমাজে তৈরি হয়নি। ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে হিজড়া সম্প্রদায়ের এমন কিছু সত্যিকার মানুষের ছবি ও নাম ব্যবহার করা হয়েছে, যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন।

এই ছবিগুলো ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য যেন ব্যতিক্রম বা বিশেষ উদাহরণ না হয়, সে প্রচেষ্টা থেকেই পাঠটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে আইন বা নীতিমালা তৈরি করেও কাজের কাজটি হবে না। 

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক