মতামত

মার খেলেন কে? হিরো আলম নাকি এমপি প্রার্থী

আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমকে মারছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থকেরা। সোমবার বেলা সোয়া তিনটায় বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

যাঁরা ঘুষি মারছিলেন, লাথি ছুড়ছিলেন, ধুপধাপ পেটাচ্ছিলেন, তাঁরা সম্ভবত ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী আশরাফুল আলমকে মারছিলেন না; তাঁরা মারছিলেন হিরো আলমকে

আশরাফুল আলম কে—সেটি পরে জানলেও চলবে। আগে জানি, হিরো আলম কে? কে এই হিরো আলম?

উত্তরটা কমবেশি সবার জানা। তবু মনে করিয়ে দিই—হিরো আলম হলেন সেই ব্যক্তি যিনি বই হাতে ইশকুলে যাওয়ার বয়সে পেটের পীড়নে বাদাম চানাচুর বেচতেন; তারপর ক্যাবল টিভির (ডিশ লাইন) কানেকশন দেওয়ার কাজ করতেন; তারপর অনেক কষ্টে সেই ব্যবসার মালিকানা কিনে নেন; তারপর কালো হাড় বের করা লিকলিকে ‘না খাওয়া’ শরীর নিয়ে বাংলা সিনেমার গানে ঠোঁট মিলিয়ে মিউজিক ভিডিও বানিয়ে সেই ভিডিও ডিশ লাইনে ‘ছাড়তেন’; তারপর ফেসবুক-ইউটিউব জমানায় তাঁর ভিডিও ভাইরাল হওয়া শুরু করে; তারপর তিনি নিজের প্রযোজনায় নিজেই হিরো হয়ে অভিনয় করা শুরু করেন।

কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনে নিজেদের নামের শেষে ‘স্যার’ লাগিয়ে ‘মিজান স্যার’, ‘হিরু স্যার’, ‘লিটু স্যার’ যেভাবে একেকজন ‘স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু’ হয়ে বসে আছেন, প্রায় সেই কায়দায় আলম তাঁর নামের আগে ‘হিরো’ জুড়ে দিয়েছিলেন। সেই ‘হিরো’ আঠার মতো ‘আলম’-এর সঙ্গে জোড়া লেগে ‘হিরো আলম’ হয়ে গেছে।

যদ্দুর জানি, একমাত্র ছবি আঁকা ছাড়া নাচ, গান, অভিনয়, কবিতা লেখা, কবিতা আবৃত্তি করা, আত্মজীবনী লেখাসহ শিল্পের হেন কোনো সেক্টর নেই সেখানে হিরো আলম ‘পা’ দেননি। আমাদের প্রথাগত আর্ট স্কুলিংয়ের সংজ্ঞায় সেগুলোকে নাচ, গান, অভিনয় বলা যাবে কিনা তা নিয়ে ‘হেফাজতে আর্ট-কালচার’ মহলে নানা তর্ক আছে। কিন্তু যেটি তর্কাতীত, সেটি হলো হিরো আলম একটি ‘ভাইরাল ক্যারেক্টার’। তাঁর সমস্ত কনটেন্টের ‘লাইক’, ‘শেয়ার’, ‘ভিউ’ অনেক।

এই ‘ভিউ’ তাঁকে জনপ্রিয়তা (এটি ‘জনপ্রিয়তা’ নাকি ‘জন পরিচিতি’ সেটিও তর্কসাপেক্ষ) দিয়েছে। শিল্পবোদ্ধা জগতে তাঁর ভিডিও কনটেন্টগুলোকে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ ও সামাজিক অবক্ষয়ের বড় নিদর্শন বলেও বলা হয়ে থাকে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে যেটি দাঁড়িয়েছে, সেটি হলো হিরো আলম নিয়ত পরিবর্তনশীল ও আলোচনায় থাকা একটি প্রপঞ্চে পরিণত হয়েছেন।

কিছুদিন আগে রবীন্দ্রসংগীত বিকৃত করে গাওয়ার পর ডিবি কার্যালয়ে হিরো আলমকে ডেকে নেওয়া হলো। হিরো আলমের ভাষ্যমতে, এক পুলিশ কর্মকর্তা তখন তাঁকে জেরার মুখে বলেছিলেন, ‘তোর চেহারা কি হিরোর মতো? আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছিস? হিরোদের চেহারা কেমন হয় সিনেমায় দেখিস না? তোর হিরো আলম নাম পাল্টে ফেলবি।’

সে দফায় তিনি আর কখনো রবীন্দ্রসংগীত গাইবেন না বলে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন। সেই খবর ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি প্রকাশ করার পর বহু দেশের বহু ভাষায় হিরো আলমকে নিয়ে খবর-ফিচার ছাপা হয়েছিল। তাঁকে দমাতে গিয়ে উল্টো ‘আন্তর্জাতিক’ চরিত্র বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

উইকিপিডিয়া বলছে, হিরো আলমের জীবনী অবলম্বনে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার স্নাতক মহেশ রূপরাও ঘোদেশ্বর নির্মিত ও পরিচালিত একটি মঞ্চনাটক ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি ভারতের আহমেদাবাদে এবং এই বছরেরই মে মাসে মুম্বাইতে মঞ্চস্থ হয়েছে।

বনানীতে ভোটকেন্দ্রে নৌকার সমর্থকদের হামলার শিকার হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর নিজের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেন হিরো আলম।

দেখা যাচ্ছে, সেই হিরো আলমকে বনানীতে মারধর করার পর তিনি আরেক দফা ‘আন্তর্জাতিক’ হয়ে উঠেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে তাঁর কথা আলোচিত হয়েছে। এমনকি তাঁর ওপর হামলার ঘটনায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম জাতিসংঘ পর্যন্ত উদ্বেগ জানিয়েছে

অনেকে বলছেন, হিরো আলম যদি ‘হিরো আলম’ হয়ে থাকতেন তাহলে তাঁকে মার খেতে হতো না। তিনি হতে চাচ্ছেন ‘আশরাফুল আলম’; এমপি আশরাফুল আলম। তাঁর এই চাওয়া যে অনেকের জন্য অসহনীয় অপমানের বিষয় তা তিনি ধরতে পারেননি।

‘হিরো আলম’কে সামনে রেখে আশরাফুল আলম ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বগুড়া-৪ আসন থেকে দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানে জামানত হারানোর পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একই আসনে উপনির্বাচনে জিততে জিততে হেরে যান (জনশ্রুতি আছে, তাঁকে ওই ভোটে কারসাজি করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল) তিনি। ওই সময় তাঁর সমর্থকেরা তাঁকে ‘জনতার এমপি’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

হিরো আলম বলেছিলেন, এমপি নির্বাচিত হলে প্রটোকল অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তাদের তাঁকে ‘স্যার’ ডাকতে হবে বলেই তাঁকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ওই সময় ক্ষমতাসীন দলের প্রথম সারির একজন নেতাকে তিনি তাঁর সঙ্গে ভোটে লড়ার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। এটিকে অনেকেই তখন চরম ঔদ্ধত্য হিসেবে দেখেছিলেন।

এমপি হতে চাওয়া হিরো আলম যে শিক্ষিত ও রুচিশীল সমাজের ইগোকে নানাভাবে সরাসরি আঘাত করেছেন, তা স্পষ্ট। হিরো আলমের এই মার খাওয়া সেই ইগো বা অহমেরই একটি প্রত্যাঘাত।

তবে যাঁরা হিরো আলমকে মেরেছেন, তাঁরা সম্ভবত তাঁকে এমপি প্রার্থী আশরাফুল আলম মনে করে মারেননি। তাঁদের অহং ও আত্মশ্লাঘা এতটাই ওজনদার যে, তাঁরা রাজনীতিক কিংবা এমপি প্রার্থী হিসেবে আশরাফুল আলম নামের কাউকে স্বীকৃতিই দেননি। তাঁরা চেনেন একজন হিরো আলমকে, যাঁকে ‘আজেবাজে লোক লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে’ এবং সেই ‘ছোটলোক’ এখন ‘ছোটমুখে বড় কথা’ বলতে শুরু করেছেন। এ কারণে সম্ভবত কারও কারও কাছে মনে হচ্ছে ‘এই মার ঠিকই আছে’।

পুরো ঘটনা দেখে মনে হয় না, অতি উৎসাহী কর্মীদের নেহাত ‘হাতের সুখ’ নেওয়ার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটি ঘটে গেছে। বরং এটিকে কিছুটা পরিকল্পিত বলে মনে হয়। এটি আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য পরিবেশ নিয়ে যে পূর্বাভাস দিচ্ছে তা হিরো আলমের কথাতে খানিকটা বোঝা যাবে।

হিরো আলমের প্রতি দেখানো এই মনোভঙ্গি মূলত প্রান্ত থেকে উঠে আসতে চাওয়া মানুষের প্রতি কেন্দ্রে থাকা মানুষের দমনমূলক আচরণের স্থূল প্রকাশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, হিরো আলমকে একাধিক পুলিশ সদস্য নিরাপত্তা দেওয়ার মতো করে ধরে সামনে এগিয়ে গেলেন।

পরে হামলাকারীরা একযোগে ছুটে এল এবং পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে সরে গেলেন। তখন হিরো আলমকে চড়-থাপ্পড়, লাথি দেওয়া শুরু হলো। সরে যাওয়া একজন পুলিশ সদস্যকে একজন সাংবাদিক যখন জিজ্ঞাসা করলেন, হিরো আলমের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে, আপনারা কী করছেন? তখন সেই পুলিশ সদস্য বললেন, ‘আমরা ইনার কর্ডনে। আউটার কর্ডনের বিষয় আমাদের না।’

পুরো ঘটনা দেখে মনে হয় না, অতি উৎসাহী কর্মীদের নেহাত ‘হাতের সুখ’ নেওয়ার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটি ঘটে গেছে। বরং এটিকে কিছুটা পরিকল্পিত বলে মনে হয়। এটি আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য পরিবেশ নিয়ে যে পূর্বাভাস দিচ্ছে তা হিরো আলমের কথাতে খানিকটা বোঝা যাবে।

মার খাওয়ার পর হিরো আলম বলেছেন ‘এ রকম পরিবেশ হলে নির্বাচন করার দরকারই নেই’। তাঁর কথা শুনে ভাবছি, এই কথা কি শুধু হিরো আলমের কথা?

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    sarfuddin2003@gmail.com