যাঁরা ভাবেন ‘ঢাকাই বাংলাদেশ’, তাঁরা যেভাবে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি ও সমাজকে দেখেন, ঢাকার বাইরের মানুষগুলোর চিন্তাভাবনা তাঁদের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। ঢাকায় কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা তোলপাড় করি, পত্রিকায় কিংবা টিভি টক শোতে ঝড় তুলি কিন্তু গ্রামগঞ্জে থাকা মানুষের কাছে এসব সামান্যই রেখাপাত করে। তাঁরা রাজধানীকেন্দ্রিক নেতাদের মুখস্থ কথায় বিশ্বাস করেন না। এমনকি নির্বাচনী ঢাকও তাঁদের কাছে দূরের বাদ্য বলে মনে হয়।
বৃহস্পতিবার একটি পারিবারিক কাজে গিয়েছিলাম শরীয়তপুরের ডামুড্যার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। এলাকাটি আওয়ামী লীগের এককালীন প্রভাবশালী নেতা আব্দুর রাজ্জাকের। তাঁর ছেলে নাহিম রাজ্জাক এখন সেখানকার সংসদ সদস্য। পদ্মা সেতু পার হয়ে এক্সপ্রেস সড়ক সোজা চলে গেছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত। আর বাঁ দিকের ২৭ কিলোমিটার সরু সড়কটি শরীয়তপুরের দিকে। এক্সপ্রেস সড়কের পাশে এটি মনে হবে উজ্জ্বল আলোর পাশে ‘আবছা অন্ধকার’। খানাখন্দে ভরা এ সড়কে দুটি গাড়ি পাশাপাশি যেতেও বেগ পেতে হয়। কিছু দূর যেতেই আমাদের থামতে হলো। সামনে অনেক গাড়ি আটকা পড়েছে। খবর নিয়ে জানলাম, রাতে একটি ট্রাক রাস্তার পাশে পড়ে গিয়েছিল, সেটি তোলার চেষ্টা হচ্ছে। স্থানীয় তরুণেরা পরামর্শ দিলেন গঙ্গানগর হয়ে ঘুরপথে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। আমরা তা-ই করলাম। শরীয়তপুরে বাস টার্মিনালের পাশে একটি রেস্তোরাঁয় চা খেতে খেতে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তাঁরা বললেন, রাজধানী থেকে আমরা যত দূরে আছি, উন্নয়ন থেকেও তত দূরে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও লোডশেডিং আমাদের ভীষণ বিপদে ফেলেছে। প্রতিদিন শহরে তিন থেকে চার ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। গ্রামাঞ্চলে আরও বেশি।
শরীয়তপুরে যেতে সড়কের দুই পাশে আড় বেঁধে পাট শুকানোর দৃশ্য দেখলাম। বৃহত্তর ফরিদপুরের প্রতিটি জেলায় প্রচুর পাট হয়। স্থানীয় কৃষকেরা জানান, গত দুই বছর তাঁরা পাটের ভালো দাম পেয়েছেন। তাই চাষও হয়েছে বেশি। তাঁরা জমিতে তিনটি ফসল ফলান। জমিতে পানি থাকতে পাট চাষ করেন। পাট ওঠার পর ধান চাষ হয়। আর ধান উঠে গেলে শীত মৌসুমে সবজি চাষ করেন তাঁরা।
সেখানেই কথা হলো আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন, এ রকম তৃণমূলের এক নেতার সঙ্গে। একবার ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনও করেছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, দলের অবস্থা কী? উত্তরে জানান, এখানে তো আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপ। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নাহিম রাজ্জাক, আরেক গ্রুপের সংরক্ষিত আসনের সদস্য পারভিন হক সিকদার। ১৫ আগস্ট তাঁরা শোক দিবসও পালন করেছেন আলাদাভাবে। পাশের জেলা মাদারীপুরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিভাজনের কথা সবাই জানেন। একদিকে শাজাহান খান, অন্যদিকে বাহাউদ্দিন নাছিম। এখন দেখা যাচ্ছে, দলীয় কোন্দল থেকে শরীয়তপুরও মুক্ত নয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ওই গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারের কেউ না কেউ বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। একজন গেলে তিনি আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে যান। এখন কেউ কেউ আমেরিকা-ইউরোপ যাওয়ারও চেষ্টা করছেন।
পথে যাঁদের সঙ্গেই কথা হয়েছে, তাঁরা কেউ জাতীয় রাজনীতি বা নির্বাচন নিয়ে খুব ভাবেন না। তাঁরা ভাবেন নিজেদের জীবন-জীবিকা নিয়ে। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাঁরা জানতে চান, এ বছর ধান রোপণ করতে কত টাকা বেশি খরচ করতে হবে। ধান বিক্রি করে সেই টাকা উঠে আসবে কি না। তাঁরা জানতে চান, পরিবারের যে ছেলেটি বিদেশে গেছে, তার পাঠানো টাকায় সংসার চলবে কি না।
আরেকজন সাংবাদিককে শরীয়তপুরের হালহকিকত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে বললেন, বৃহত্তর ফরিদপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া মন্ত্রিসভায় যে দ্বিতীয় সদস্য আছেন, তিনি শরীয়তপুরের এনামুল হক শামীম। অথচ শরীয়তপুর বরাবরের মতোই অবহেলিত।
দুই পাশাপাশি জেলার পার্থক্যটি সহজেই চোখে পড়ে। মাদারীপুরের সড়কগুলো ঝকঝকে। আর শরীয়তপুরের সড়কগুলো বেহাল। পথে পথে আরেকটি বিষয় খেয়াল করলাম, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের, তাঁদের বাবা-দাদার নামে বিরাট বিরাট ফলক, পোস্টার। সবাই ইতিহাসে নিজেদের নাম খোদাই করতে তৎপর। তাঁরা জানেন না মানুষের হৃদয় জয় করতে পারলে এভাবে পথে ও পাথরে নাম খোদাই করার প্রয়োজন হয় না।
আমার সফরসঙ্গী আগেই বলে রেখেছিলেন, তিনি ফেরার পথে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি দেখে আসবেন। গোপালগঞ্জে প্রথম আলো বন্ধুসভার সভাপতি ও কাশবন পত্রিকার সম্পাদক মিন্টু হককে টেলিফোন করলাম। তিনি জানালেন, শরীয়তপুর থেকে মাদারীপুর হয়ে দুই ঘণ্টার মধ্যে গোপালগঞ্জ পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু যাত্রা শুরু করতেই মুষলধারে বৃষ্টি। আমাদের পৌঁছাতে সাতটা বেজে গেল। সন্ধ্যা সাতটার পর গোপালগঞ্জ ক্লাবে পৌঁছালে সেখানকার কর্মকর্তারা বলেন, পাঁচ দিন ধরে ক্লাবে পানি নেই। তবে লোডশেডিং শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের তুলনায় কম।
পথে যাঁদের সঙ্গেই কথা হয়েছে, তাঁরা কেউ জাতীয় রাজনীতি বা নির্বাচন নিয়ে খুব ভাবেন না। তাঁরা ভাবেন নিজেদের জীবন-জীবিকা নিয়ে। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাঁরা জানতে চান, এ বছর ধান রোপণ করতে কত টাকা বেশি খরচ করতে হবে। ধান বিক্রি করে সেই টাকা উঠে আসবে কি না। তাঁরা জানতে চান, পরিবারের যে ছেলেটি বিদেশে গেছে, তার পাঠানো টাকায় সংসার চলবে কি না।
মিন্টু হক আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবার বেশি রাতে ঢাকায় যাবেন না। ওই দিন মাওয়া-ঢাকা সড়কে মারাত্মক ট্রাকজট লেগে যায়। কিন্তু আমাদের তো না এসে উপায় নেই। রাত নয়টায় গোপালগঞ্জ থেকে রওনা হই। গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকার দূরত্ব ১৫১ কিলোমিটার। আসতে সময় লাগার কথা আড়াই ঘণ্টা। রাতের পথ যদি তিন ঘণ্টাও ধরে নিই, ১১টার মধ্যে পৌঁছার কথা। কিন্তু ফিরতে লাগল পাক্কা পাঁচ ঘণ্টা। আবদুল্লাহপুর পার হতেই ট্রাকজট টের পেতে শুরু করি। বুড়িগঙ্গা সেতু পার হতে ভয়াবহ পরিস্থিতি। শত শত গাড়ি, ট্রাক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ১২টায় হানিফ উড়ালসড়ক হয়ে গুলিস্তান আসতে রাত ১টা। যাঁরা উড়ালসড়কে না এসে নিচ দিয়ে এসেছেন, তাঁদের গুলিস্তান পৌঁছাতে কয় ঘণ্টা লেগেছে, অনুমান করা কঠিন নয়।
ঢাকা থেকে আমরা যত দূরে যাই, উন্নয়নের রং তত ফিকে হতে থাকে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি