অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিচ্ছে ড মুহাম্মদ ইউনূস
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিচ্ছে ড মুহাম্মদ ইউনূস

বর্তমান সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা কেমন

বর্তমান সরকার কীভাবে একই সঙ্গে সাংবিধানিক ও বৈধ, তা ব্যাখ্যা করাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য। সাংবিধানিকতার বিষয়টি হলো সংবিধানের রীতিনীতি মেনে চলা। অন্যদিকে বৈধতার উৎস একাধিক। সাধারণ ও এমনকি আইনি বিচারেও বৈধতা বিষয়টি একটি বিস্তৃত ধারণা, যা সাংবিধানিকতার চেয়ে ব্যাপক।

সাংবিধানিকতা

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া, তার সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্নতা এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁর অনুপস্থিতি, এ বিষয়গুলো একটি সাংবিধানিক শূন্যতা ও সংকট তৈরি করেছিল।

৫ আগস্ট থেকেই এই শূন্যতা ও সংকট চলছিল এবং এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করা বা না করার কোনো সম্পর্ক নেই। এমন সংকট মোকাবিলার জন্য, বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইনের আওতায় কিছু নীতি ও মতবাদ রয়েছে। সুতরাং বর্তমান সরকারের সাংবিধানিকতা এই সাংবিধানিক সংকট থেকেই উদ্ভূত হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র দিয়ে থাকুক বা না থাকুক সংকটটি সৃষ্টি হয়েছিল।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন শুধু সংবিধানের লিখিত শব্দাবলি নয়, বরং এটি বিভিন্ন ধরনের নীতি ও মতবাদকেও অন্তর্ভুক্ত করে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাংবিধানিক চর্চার মাধ্যমে এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। একটি পরিচিত উদাহরণ হলো মৌলিক কাঠামো মতবাদ (বেসিক স্ট্রাকচারাল ডকট্রিন)। এই মতবাদ অনুযায়ী, সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামো রয়েছে এবং কোনো ধরনের সংশোধনীর মাধ্যমে তা পরিবর্তন করা যায় না।

অনেক পাঠক হয়তো জানেন, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বেশ কয়েকটি সংবিধান সংশোধনী এই মৌলিক কাঠামো মতবাদের ভিত্তিতে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এমনকি ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই মূল কাঠামো ধারণাটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগেই তা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই মৌলিক কাঠামো মতবাদ সংবিধানে লিখিতভাবে যুক্ত হওয়ার আগে থেকেই তা বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইনের অংশ।

যদিও সংবিধানে লিখিত না, সংবিধানিক আইনের আরেকটি মতবাদ রয়েছে, যা বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত অংশ। এটা প্রয়োজনীয়তার নীতি (ডকট্রিন অব নেসেসিটি) হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট অনেক ক্ষেত্রেই এই নীতিটির স্বীকৃতি দিয়েছেন। যার সর্বশেষ নজির হচ্ছে ২০১১ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় এবং ২০১৭ সালের ষোড়শ সংশোধনীর রায়।

এই মতবাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক শৃঙ্খলার ওপরে ভয়াবহ বিপর্যয় এড়ানো, যা সাংবিধানিক সংকট বা অন্য কোনো কারণে উদ্ভূত হতে পারে। এই মতবাদের মূলকথা হলো, যদি কোনো কাজ, সংবিধান দ্বারা অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও সদ্বিশ্বাসে ও সৎ উদ্দেশ্যে সংবিধান, জনগণ ও রাষ্ট্র বা সমাজ রক্ষার উদ্দেশ্যে করা হয়, তা সংবিধানসিদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই অন্তর্বর্তী সরকার স্বাধীনতার পর সবচেয়ে গভীর এক সাংবিধানিক সংকটের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইনে এই সরকার পুরোপুরি সাংবিধানিক।

এ ছাড়া সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদের ভিত্তিতেও এই সরকারের সাংবিধানিকতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। বলার অপেক্ষা রাখে না, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার জনগণের অভূতপূর্ব দাবির মুখে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে।

বৈধতা

বৈধতা কেবল সাংবিধানিকতা ও আইনি ভিত্তির মাধ্যমেই অর্জিত হয় না, বরং বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি ও উপাদান থেকে উদ্ভূত হতে পারে। সাধারণ বিবেচনায় কোনো কিছুকে তখনই বৈধ বলা যায়, যখন তা যুক্তি ও ন্যায্যতা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। এই যুক্তি ও ন্যায্যতা কেবল আইন ও সংবিধান থেকে নয়, বরং অন্যান্য উৎস থেকেও আসতে পারে।

এই নিবন্ধের লক্ষ্য হচ্ছে সাংবিধানিকতাবাদের আলোকে সরকারের বৈধতা ব্যাখ্যা করা। সাংবিধানিকতাবাদ (কনস্টিটিউশনালিজম) হচ্ছে গণপ্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক জবাবদিহি, যা কোনো নির্দিষ্ট একটি দেশের সাংবিধানিক আইনের চেয়ে ব্যাপক।

সাংবিধানিকতাবাদের দিক থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই অন্তর্বর্তী সরকার বৈধ, কারণ এটি একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে। এ ধরনের সরকার গঠনের লক্ষ্যে পুরোনো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হয়। তা করতে গিয়ে জনগণকে যে ত্যাগ ও সংগ্রাম করতে হয়, তার মধ্য দিয়ে এ ধরনের সরকার বৈধতা অর্জন করে।

এই প্রক্রিয়ায় বৈধতা অর্জন করেছে এমন অনেক সরকারের নজির দেওয়া যায়, যেমন মার্কিন ও রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হয়েছিল, সেগুলো এই প্রক্রিয়ায় বৈধতা অর্জন করেছে। আরও সাম্প্রতিক উদাহরণ দিতে গেলে আরব বসন্ত উত্তর যেসব সরকার গঠিত হয়েছে, সেগুলোর কথা বলা যায়।

আরেকটি উপায়ে বৈধতা অর্জন করা যায়। সেটা হলো, সরকারের কার্যকারিতা। সমাজ ও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে এটা অর্জন করা সম্ভব। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে এবং এরপর পুরো দেশ এক বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিপতিত ছিল। এই সরকার শপথ নিয়েছে গত ৮ আগস্ট। শপথ গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। নিশ্চিতভাবে এই সরকার কার্যকারিতার মাধ্যমে বৈধতা অর্জন করেছে।

আরও একটি কারণে এই সরকার বৈধ। সেটা হলো, একাধিক অসাংবিধানিক ও জাল ভোটের নির্বাচনের মাধ্যমে সাবেক সরকার মানুষকে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করেছিল। একনায়কতান্ত্রিক ও সমগ্রতাবাদী চরিত্রের কারণে এবং নিজের জনগণকে গণহারে হত্যার মধ্য দিয়ে পতিত সরকার সাংবিধানিক অধিকার ও বৈধতা হারিয়ে ফেলেছিল। এর বিপরীতে বর্তমান সরকার বিপ্লব ও গণদাবির মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে, সে কারণে এই সরকার বৈধ।

  • শরীফ ভূঁইয়া পিএইচডি, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী।