‘ওটা তো শহীদ আবু সাঈদের বিশ্ববিদ্যালয়’

সম্প্রতি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে এক তরুণের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফটোগ্রাফির মাধ্যমে নিজের লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহ করে। আমি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি শুনে আমার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে বলে, ‘ওটা তো শহীদ আবু সাঈদের বিশ্ববিদ্যালয়! দেখতে যাব।’ রংপুরে নতুন আসা এক রিকশাওয়ালাকে নগরীর ধাপ এলাকায় বলেছিলাম, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব। তিনি প্রথমে চিনতে পারছিলেন না। যখন বললাম, আবু সাঈদের বিশ্ববিদ্যালয়, তখন তিনি বললেন, ‘ওওও’।

আবু সাঈদের বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। ওই সময় রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আন্দোলনে সাড়া দিয়ে রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ওই সময়ের ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই বছরের শেষে আওয়ামী লীগও সরকার গঠন করে। ২০০৯ সালের প্রথমার্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদলে দেওয়া হয়। নতুন নামকরণ হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। যদিও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কখনো নিজের নামের সামনে ‘বেগম’ লেখেননি। আংশিক ভুল নামে নামকরণ করা হয়েছে।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল রংপুর শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের পরিত্যক্ত জীর্ণশীর্ণ ভবনে ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল। ২০১১ সাল পর্যন্ত সেখানে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। প্রথম উপাচার্য লুৎফর রহমান দুই ফুট বাই দুই ফুট দুটি পরিত্যক্ত টেবিল নিয়ে তাঁর কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। ৬টি বিভাগে ৩০০ জন শিক্ষার্থী ও ১২ জন শিক্ষক ছিলেন তখন।

২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। প্রতিষ্ঠাকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক শ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। এরপর সামান্য টাকা সরকার উন্নয়নকাজে বরাদ্দ দিলেও সেই কাজ আজও আলোর মুখ দেখেনি। সমসাময়িক কিংবা এর পরে প্রতিষ্ঠিত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কম বরাদ্দ পেয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণা করছেন। দেশ-বিদেশে সম্মানের সঙ্গে চাকরি করছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে এসেছেন, অনেকে ডিগ্রি করছেন।

রংপুর অঞ্চলে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক শিক্ষার্থী উদ্যোক্তা হয়েছেন। আবু সাঈদ আল সাগর ও উম্মে কুলমুস পপি নামের দুই শিক্ষার্থী উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ নাম কুড়িয়েছেন। বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট ও প্রিমিয়াম ফ্রুটস নামে দুটি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন তাঁরা। প্রতিষ্ঠান দুটি সম্মানের সঙ্গে কাজ করছে। পপি এ কাজের পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে দেশজুড়ে খ্যাতি পেয়েছে। অনিন্দ্য রায় কম্পিউটার সায়েন্সে লেখাপড়া শেষে আলফা টেক নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর শেষে সঞ্জয় চৌধুরী গ্রিন ইকো নামের একটি সংস্থা খুলেছেন। পরিবেশবান্ধব বাণিজ্য তাঁর লক্ষ্য। তাঁরা প্রত্যেকে ভীষণ সম্ভাবনাময়। এ রকম আরও অনেকেই আছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড খুব ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এখানে বিতর্কচর্চা খুব ভালো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিজস্ব সংগঠন, বিভাগভিত্তিক সংগঠন ছাড়াও দুটি বড় সংগঠনÑবেগম রোকেয়া ইউনিভার্সিটি ডিবেট ফেরাম (বিআরইউডিএফ) এবং বেগম রোকেয়া ইউনিভার্সিটি ডিবেট অ্যাসোসিয়েশন (ব্রুডা) গড়ে উঠেছে। রণন, গুনগুন, টঙের গান, উদীচীসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন এখানে গান-কবিতা-নাচ-নাটক করছে। আরও অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। গুনগুন-রণন–এর আয়োজনে আট বছর ধরে নিয়মিত সপ্তাহব্যাপী বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন সবুজে আচ্ছাদিত। ৪ শতাধিক প্রজাতির প্রায় ৩৭ হাজার গাছ রোপণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া এত বৈচিত্র্যপূর্ণ বৃক্ষশোভিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশে আর নেই।

জুলাই বিপ্লবে গতি সঞ্চার করেছে শহীদ আবু সাঈদের বীরত্বপূর্ণ জীবনদান। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের স্নাতক (সম্মান) ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ফল প্রকাশের আগেই মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। তাঁর ফলাফল প্রকাশিত হবে শিগগিরই। এরই মধ্যে তাঁদের ব্যাচের মাস্টার্স ক্লাস শুরু হয়েছে। বন্ধুরা চোখের পানিতে ভিজে ক্লাস শুরু করেছেন। তাঁকে ছাড়াই এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও আবু সাঈদকে গভীরভাবে স্মরণ করছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন আবু সাঈদ। সেই আন্দোলন ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে পরিণত হয়েছিল। সেই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের একজন নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা। তাঁকে এ বছর প্রধান অতিথি করা হয়েছে। বিশেষ অতিথির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে শহীদ আবু সাঈদের বাবাকে। বর্তমান উপাচার্য আবু সাঈদের ছোট বোনকে তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরি দিয়েছেন।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন ড. লুৎফর রহমান। তাঁর সময়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে বিশেষজ্ঞ সদস্য ছিলেন ড. মো. শওকাত আলী। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন কোনো শিক্ষক নিয়োগ হয়নি, তখন থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধ্যাপক শওকাত আলীর একাডেমিকভাবে সংযুক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়টির নানান সংকটে নেপথ্যে থেকে কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। তিনি এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। নিজের জেলার বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তিনি অনেক উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান। আবু সাঈদ যেমন সাহসিকতার পথ রচনা করেছেন। বর্তমান উপাচার্য আবু সাঈদের স্মৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অনন্য উচ্চতায় নিতে চান।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় একটি সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান। নতুন উপাচার্য মো. শওকাত আলী তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে এ প্রতিষ্ঠানকে যথার্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে পারবেন। দেশে যে গবেষণানির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়ের শূন্যতা, সেই শূন্যতাও দূর হতে পারে। বাংলাদেশে যে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা সম্ভব, তারও দৃষ্টান্ত হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার অংশগ্রহণে সরকারের আনকূল্যে অনন্য উচ্চতায় উঠুক এ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৬ ছাড়িয়ে ১৭ বর্ষে পদার্পণের দিনে এটুকু গভীরভাবে চাওয়া। আবু সাঈদ যেমন বিশ্বের দরবারে সমাদৃত, অনুকরণীয়; তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়ে উঠুক বৈশ্বিককভাবে সমাদৃত ও অসুরণীয়।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদীরক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক