ইউক্রেনকে যে কারণে ন্যাটোর সদস্য করতে হবে

ভিলনিয়াসে ন্যাটো সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিসহ অন্যরা।
ছবি: এএফপি

চলতি সপ্তাহে লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসের দিকে সমস্ত ইউক্রেনীয় নাগরিকের দৃষ্টি থাকবে। কারণ এখানেই ন্যাটোর নেতারা সম্মেলনে বসছেন। আমরা ইউরোপ তথা পশ্চিমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি কিনা তা এই সম্মেলনেই নির্ধারিত হবে।

যদিও ইউক্রেনের সব বাসিন্দা দৃশ্যত ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করছেন; তবে ১৮ মাস আগে রাশিয়ার হামলা আমাদের যে ভয়ংকর যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে, সেই যুদ্ধের বাস্তবতা আমাদের অনেক কঠিন কিছু শিক্ষা দিয়েছে। বাস্তব অবস্থা থেকে নেওয়া সেই শিক্ষার আলোকে বলতে পারি, ন্যাটোর সদস্য হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করা খুব সহজ হবে না।

২০০৮ সালে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য ন্যাটোর মহাসচিব বরাবরে পাঠানো আবেদনপত্রে আমি সই করেছিলাম। মাঝখানে এতগুলো বছর চলে গেল। কিন্তু এখনো মহাবিপর্যয় মাথায় নিয়ে ইউক্রেন ন্যাটোর বাইরেই পড়ে আছে।

যতক্ষণ আমাদের ভূখণ্ডে যুদ্ধ চলছে, ততক্ষণ আমাদের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে, এমনটি কেউ আশা করে না। কারণ ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করলে এই জোট তার প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তির ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই সংঘাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য। আর ন্যাটো ও পরমাণু অস্ত্রধারী রাশিয়ার মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের ধারণা যে কোনো লোকের কাছে একটি অপরাধের পর্যায়ে পড়া খামখেয়ালি বলে গণ্য হবে। এমনকি ইউক্রেনীয় নাগরিকেরাও এই বিধ্বংসী ধারণা সমর্থন করবে না।

কিন্তু এটি মনে রাখতে হবে, এই যুদ্ধ চিরকালের জন্য স্থায়ী হবে না। সে কারণে আমাদের সৈনিকদের দক্ষতা ও সাহসিকতা এবং ন্যাটো সদস্যদের বাইরেও আমাদের যেসব বন্ধু রাশিয়াকে আমাদের ভূখণ্ড থেকে উৎখাত করতে সহায়তা করে যাচ্ছে, তাদের কথা আমাদের মনে রাখতে হবে।

ন্যাটোর সদস্যপদ ইউক্রেনের জন্য কী সুবিধা বা ফল বয়ে আনবে তা আসলে এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরের আলাপ। আপাতত ইউরোপে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং তা ধরে রাখাই এই সম্মেলনের প্রধান বিষয় হবে। সেটি করতে পারলেই ন্যাটোর মৌলিক উদ্দেশ্য সফল হবে।

তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, ন্যাটোর মধ্যেই অনেক সদস্য দেশ আছে যাদের মধ্যে ইউক্রেনকে সদস্যপদ দেওয়া নিয়ে সংশয় আছে। তাদের বিষয়ে কিছু বলা দরকার।
কারও কারও মনে এই চিন্তা কাজ করছে যে, ইউক্রেন সদস্য হলে তারা ফ্রি রাইডারের মতো ন্যাটোর ঘাড়ে চেপে বসবে এবং মাথাব্যথা ছাড়া আর কিছুই তারা ন্যাটোকে দিতে পারবে না। কিন্তু তাদের এই ধারণা যে একেবারেই ঠিক নয় তা যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের কার্যকর প্রতিরোধ-এবং রাশিয়ার পরাজয়ই প্রমাণ করে।

আমাদের পরীক্ষিত যোদ্ধা ও পরম আত্মবিশ্বাসী সামরিক বাহিনী আগামী কয়েক দশক ধরে ট্রান্সআটলান্টিক নিরাপত্তার জন্য প্রধান সম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে একটি নতুন ধারার যুদ্ধের জন্ম হয়েছে। এই যুদ্ধে রাশিয়ার যোদ্ধারা নয় বরং ইউক্রেনের যোদ্ধারা নতুন ও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল দেখিয়েছে।

একবিংশ শতাব্দীতে ন্যাটোর প্রায় সব সদস্য দেশেরই বড় ধরনের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা কম। সেখানে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সদ্য তালিকাভুক্ত সেনা থেকে শুরু করে প্লাটুন স্তর পর্যন্ত সবার সামরিক অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। এই অভিজ্ঞতা সামনের দশকগুলোতে ন্যাটোর সামরিক সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের এমন এক নতুন মডেলের সেনাবাহিনী আছে যা ইউরোপীয়রা অনুকরণ করতে চাইবে।

২০১৪ সালে যখন রাশিয়া প্রথম আমাদের ভূখণ্ডে অভিযান চালায় তখন আমরা অপ্রস্তুত থাকার কারণে আমাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হয়েছিল। তারা আমাদের ক্রিমিয়া দখল করেছিল। সেটা আর হবে না। আমরা ন্যাটোতে যোগদানের প্রথম দিন থেকেই ন্যাটো অঞ্চলের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করতে প্রস্তুত থাকব।

প্রকৃত সত্য হলো ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত সেরা যুদ্ধশক্তি যা ভবিষ্যৎ ইউরোপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হতে পারে। ন্যাটো এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে যে, ইউক্রেনের বাহিনীকে সর্বদা সর্বোচ্চ প্রস্তুতিতে রাখা হবে।

২০১৪ সালে যখন রাশিয়া প্রথম আমাদের ভূখণ্ডে অভিযান চালায় তখন আমরা অপ্রস্তুত থাকার কারণে আমাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হয়েছিল। তারা আমাদের ক্রিমিয়া দখল করেছিল। সেটা আর হবে না। আমরা ন্যাটোতে যোগদানের প্রথম দিন থেকেই ন্যাটো অঞ্চলের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করতে প্রস্তুত থাকব।

আজকে ইউরোপে যে পারমাণবিক হুমকি এসে পড়ছে তা ইউক্রেনকে ন্যাটোর বাইরে রাখার কারণেই হচ্ছে। ইউক্রেন ন্যাটোর বাইরে থাকার কারণেই ক্রেমলিন ইউক্রেনের ঘাড়ের ওপর পরমাণু অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখাচ্ছে। আজ ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয় বলেই রাশিয়া বারবার ইউরোপের নাকের ডগায় এসে পরমাণু হামলার হুমকি দিতে পারছে।

এ কারণে যত দ্রুত সম্ভব ইউক্রেনকে ন্যাটোতে সদস্য করে নেওয়া উচিত।

  • সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
    ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত
    যুলিয়া তিমোশেঙ্কো ইউক্রেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী