বিএনপির কোনো কোনো নেতা যখন আওয়ামী লীগ সরকার তিন মাসও টিকবে না বলে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, তখনই দলের ভেতরে মধ্যরাতের ঝড় কী ইঙ্গিত দেয়? এটা কি বিএনপির পুনর্গঠনপ্রক্রিয়ার নামে ঘুরে দাঁড়ানো, না অন্য কিছু? বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি নিয়ে বিএনপিতে কোন্দল–হানাহানি শুরু থেকেই ছিল। খালেদা জিয়া যত দিন সক্রিয় ও জেলের বাইরে ছিলেন, তখন প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতেন না। সবাই তাঁর সিদ্ধান্ত মানতেন। কিন্তু যেদিন থেকে দলে ‘দ্বৈতশাসন’ শুরু হলো, সেদিন থেকে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও অস্বস্তি বাড়তে থাকল।
বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণেই বিএনপি নেতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায়ে এই রদবদল আনা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে, আন্দোলন ব্যর্থ হলে সেই দায় সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ওপরই পড়ে। যেমন আন্দোলন সফল হলে তাঁর কৃতিত্বও তাঁরা নিতেন।
সমস্যা হলো, নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতৃত্ব আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প রাখেননি। তাঁরা এক দফাকে সামনে রেখে আন্দোলন করেছেন—নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। এই এক দফার আন্দোলন করে শেখ হাসিনা দুবার জয়ী হয়েছেন। বিএনপি নেতারা ভেবেছেন, শেখ হাসিনা পারলে আমরা পারব না কেন? কিন্তু আওয়ামী লীগ যেভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দলকে একত্র করতে পেরেছিল, বিএনপি সেটা পারেনি। সেই সময়ে প্রশাসন অনেকটা নিরপেক্ষ ছিল। এবারে তাদের পক্ষপাত স্পষ্ট।
একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবি নিয়ে বিএনপি যে আন্দোলন করেছে, তার প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল, এখনো আছে। কিন্তু তারা সেই দাবি পূরণ করতে রাস্তায় নামেনি। দ্বিতীয়ত, সরকার দাবি না মানলে বিএনপি কী করবে, সেটা তারা জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে পারেনি। বিএনপি নেতাদের একাংশ ভেবেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এসে নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন করে দিয়ে যাবে। মার্কিন কর্মকর্তা ও কূটনীতিকদের কথাবার্তা তাঁদের অতিমাত্রায় আশাবাদী করে থাকতে পারে।
বিএনপির পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া দেখে মনে হবে, দেশের ভেতরে তাদের কোনো সমস্যা নেই। সব সমস্যা বিদেশবিষয়ক কমিটি নিয়ে। ঢাউস আকারে দুটি কমিটি করা হয়েছে—বিএনপির চেয়ারপারসনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি এবং স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি। প্রথমটি তারেক রহমানসহ ১১ জন এবং দ্বিতীয়টি ১৮ জনকে নিয়ে। বলা হয়েছে, বিদেশ বিষয়ক আগের কমিটি বৃহৎ দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারেনি বলেই এই পুনর্গঠন। তাহলে আগের কমিটির লোকদের তো এখানে জায়গা পাওয়ার কথা নয়।
নির্বাচনের আগে বিএনপির যেসব নেতার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তাঁরা বলেছেন, সরকার বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না। তার আগেই সরকারের পতন হয়ে যাবে। কিন্তু গত বছর ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে এ রকম একটি অঘটন ঘটতে পারে, তা হয় বিএনপির নেতারা অনুধাবন করতে পারেননি অথবা অনুধাবন করলেও পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিএনপির প্ল্যান ‘এ’ যখন ব্যর্থ হলো, দলটির নেতৃত্ব দেশবাসী দূরে থাক, নিজ দলের কর্মী-সমর্থকদেরও কোনো নির্দেশনা দিতে পারলেন না। বিএনপির বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার একতরফা নির্বাচন করে ফেলল। আর বিএনপি নেতৃত্ব নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে দায়িত্ব শেষ করল।
নেতৃত্বের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কেবল নেতা-কর্মীদের বিচলিত করেনি, আন্দোলনের সহযাত্রী গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২–দলীয় জোট ইত্যাদিকেও হতাশ করেছে। গণতন্ত্র মঞ্চের একাধিক নেতা বলেছেন, নির্বাচনের পর বিএনপির নেতাদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জেল থেকে বেরিয়ে যখন সমমনাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন, তত দিনে মেঘনা-পদ্মা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বিএনপির নেতারা যে বিদেশি শক্তির সহায়তায় রাজনীতির গতিপথ বদলের চিন্তা করেছিলেন, তারা এসে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে নতুন হিসাব–নিকাশে বসল।
বিএনপির কমিটির ভাঙা–গড়া ও নেতাদের দায়িত্ববদল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, না ঝড়ের পূর্বাভাস? বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেছেন, এটা দলের ‘নেতৃত্বের সমন্বয়’। সমন্বয় কথাটি শুনলে সরকারের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির দামের কথা মনে পড়ে। সরকার যখনই এসব পরিষেবার দাম বাড়ায়, ঘোষণা দেয় সমন্বয় করা হয়েছে। সরকারের দামের সমন্বয়ে গ্রাহকদের কষ্ট বাড়ে। বিএনপির নেতৃত্বের সমন্বয় দলকে কতটা সংহত ও আন্দোলনমুখী করবে, সময়ই বলে দেবে।
বিএনপির শক্তি নেতৃত্বে নয়, তৃণমূলের নেতা-কর্মী। দলটি ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে। ক্ষমতাসীনেরা দল ভাঙার নানা কসরত করেও সফল হননি। তৃণমূল বিএনপি কিংবা কিংস পার্টি কোনো কাজে আসেনি। বিএনপির নেতাদের দাবি, বৈরী পরিবেশে তাঁরা দলের সম্মেলন করতে পারছেন না, শেষ সম্মেলন হয় ২০১৬ সালে। কিন্তু যখন নির্দিষ্ট সময় পরপর সম্মেলন হতো, তখনো কি কাউন্সিলরদের ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচিত হতো? হতো না। সবকিছু হয় ওপরের নির্দেশে। নেতাদের পকেটে কমিটি থাকে।
একসময় ছাত্রদল ও যুবদল বিএনপির মূল শক্তি ছিল। বিশেষ করে এরশাদের সামরিক শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদলের প্রাধান্য ছিল। ডাকসুতে ছাত্রলীগকে জিততে হয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন, বাকশাল ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগের সহায়তায়। ছাত্রদল এককভাবে জয়ী হয়েছে। অথচ ২০১৯ সালে যে ডাকসুর নির্বাচন হলো, তাতে ছাত্রদলের অবস্থান ছিল তৃতীয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চতুর্থ। এর কারণ ছাত্রদল নতুনদের তেমন আকৃষ্ট করতে পারছে না। এ কারণেই ‘বুড়ো খোকাদের’ নিয়ে ছাত্রদলের কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তা–ও পারিবারিক কারণে যাঁরা ছাত্রদল করে এসেছেন তাদের নিয়ে। ছাত্রদলের দুরবস্থার কারণে যুবদলও সাংগঠনিকভাবে শক্ত অবস্থানে আসতে পারেনি।
ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম—এই চারটি কমিটি গত বৃহস্পতিবার বিলুপ্ত করা হয়। এর আগে গত ১ মার্চ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। ছাত্রদলের নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন রফিকুল ইসলাম ও নাছির উদ্দীন। একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কমিটিও ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক নেতার সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, দলের রদবদল সম্পর্কে তাঁরা কিছু জানতেন না। সবকিছু ওপরের নির্দেশে হয়েছে। কিন্তু নির্দেশটি যৌক্তিক কি না, সে প্রশ্ন করার সাহস কারও নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, যাঁরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করেন, তাঁরাই গণতন্ত্র অনুশীলন করেন না। এই ‘ব্যাধি’ শুধু বিএনপিতে নয়, আওয়ামী লীগসহ সব দলেই।
বিএনপির কমিটির রদবদল দেখে এটা স্পষ্ট যে অনেকের পদাবনতি ঘটেছে, বিশেষ করে নেতৃত্ব যাঁদের নিষ্ক্রিয় মনে করেছেন। অনেকে সক্রিয় পদ থেকে নিষ্ক্রিয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে বরিত হয়েছেন। উপদেষ্টারা জানেন না, তাঁরা কাদের উপদেশ দেবেন এবং কে তাঁদের উপদেশ নেবেন। আবার যাঁরা বেশি সরকারের দমন–পীড়নের শিকার হয়েছেন, তাঁরা পুরস্কৃতও হয়েছেন। তবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সুইডেন প্রবাসী মহিউদ্দিন আহমদ ওরফে ঝিন্টু কীভাবে জায়গা করে নিলেন, দলের জন্য তার কী অবদান সেই প্রশ্নও উঠেছে। তিনি ছিলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। বিএনপির আমলে সুইডেন থেকে দেশে এসে আদালতে আত্মসমর্পণের পরই তার দণ্ড মওকুফ হয়ে যায়।
বিএনপির পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া দেখে মনে হবে, দেশের ভেতরে তাদের কোনো সমস্যা নেই। সব সমস্যা বিদেশবিষয়ক কমিটি নিয়ে। ঢাউস আকারে দুটি কমিটি করা হয়েছে—বিএনপির চেয়ারপারসনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি এবং স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি। প্রথমটি তারেক রহমানসহ ১১ জন এবং দ্বিতীয়টি ১৮ জনকে নিয়ে। বলা হয়েছে, বিদেশ বিষয়ক আগের কমিটি বৃহৎ দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারেনি বলেই এই পুনর্গঠন। তাহলে আগের কমিটির লোকদের তো এখানে জায়গা পাওয়ার কথা নয়।
বিএনপি নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছেন, দেশের জনগণের সমর্থন খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিদেশিদের সমর্থন নিতে পারলেই ক্ষমতায় ফিরে আসা যাবে?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com