বাংলাদেশের জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বড় একটা ছাপ পড়েছে ভারতের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে। যেহেতু ভারত বড় প্রতিবেশী, ফলে সম্পর্কের চলতি টানাপোড়েন বাংলাদেশের দিক থেকেও গুরুত্বের সঙ্গে মনোযোগ পাচ্ছে। আছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও। প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে এ অবস্থা থেকে এই সম্পর্ককে আবার স্বাভাবিক ও সমমর্যাদার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়া যায়, যা উভয়ের জন্য প্রয়োজন।
দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কে মধুচন্দ্রিমা চলছিল দীর্ঘ দেড় দশক ধরে। এরপর এল চলতি ঘটনাপ্রবাহ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করলেন এবং আরও কয়েকজন সহযোগী-সহযাত্রীসহ গেলেন ভারতে। এর মধ্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন অধ্যায়ে জড়াল।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা বহুবার ভারতে গিয়েছেন। ব্যাপক সংবর্ধনা পেয়েছেন। কিন্তু এবারের যাওয়ার তাৎপর্য ও প্রতিক্রিয়া উভয় পক্ষের জন্য ভিন্ন।
শেখ হাসিনার ভারতের আশ্রয় নেওয়া বা ভারত কর্তৃক তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়া বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বিশেষ মনোযোগ পাচ্ছে। যদিও ভারতের দিক থেকে এমনও বলা হচ্ছে, তাদের ‘অপ্রস্তুত’ অবস্থায় এই ‘আশ্রয়’ দিতে হয়েছে। কিন্তু এটা নয়াদিল্লিতে স্পষ্ট নয়—বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকে ভারতীয় প্রশাসন ‘শরণার্থী’ হিসেবে আশ্রয় দিয়েছে নাকি অন্য কোন মর্যাদায় সেটা ঘটেছে। ভারতের স্পষ্ট কোনো শরণার্থী নীতি বা আইন নেই। যখন যে আশ্রয় পায়, সেটা রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই ঘটে।
শেখ হাসিনা ভারতের চলে যাওয়ার পর তাঁর পরিবারের কোন কোন সদস্য এবং তাঁর দলের বিভিন্নজনের অসন্তুষ্ট প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাচ্ছে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে। তাঁরা পরিবর্তনকে মেনে নিচ্ছেন না। নানান প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করছেন। এসব অস্বাভাবিক নয়।
বিশ্ব ইতিহাসে ক্ষমতাচ্যুত কেউই তাৎক্ষণিকভাবে অসহায় অবস্থা মেনে নিতে পারেননি বা বাস্তবতা বুঝতে চাননি। কিন্তু ভারত কি এখনো আওয়ামী লীগের সেসব বক্তব্যের দিকেই ঝুঁকে থাকবে কি না, কূটনীতির অঙ্গনে সে প্রশ্ন উঠেছে। ইতিমধ্যে কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে ভারতের শেখ হাসিনা-নীতি নিয়েও বিস্ময় তৈরি হয়েছে। অনেকের প্রশ্ন—কীভাবে এবং কেন তারা এত দীর্ঘ সময় এমন একটা দল ও সরকারকে মদদ দিয়ে গেছে, যারা জনগণের কাছে এত অজনপ্রিয় ছিল।
ভারতের বাংলাদেশ-নীতিই এই বিপর্যয় তৈরি করেছে কি না, সেই প্রশ্নও আছে মাঠে। বিশেষ করে, দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনে নয়াদিল্লি তাদের বহু চাওয়া হাসিনা সরকার দিয়ে পূরণ করে নিলেও তিস্তার পানিসহ এদিকের জনগণের নানান চাওয়া যথাযথ প্রতিদান পায়নি। এতে সরকারের অজনপ্রিয়তার কফিনে নতুন নতুন পেরেক পড়েছে কেবল।
মণিপুর ও মিয়ানমারে যেভাবে সহিংসতা ও উত্তেজনা চলছে, তাতে বাংলাদেশ-ভারত কূটনীতিক দূরত্ব এ অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে বাড়তি জটিলতাই কেবল বাড়াবে। তবে পাঁচ দশক পেরোনো অভিজ্ঞতা বলছে, সম্পর্ক সমমর্যাদা এবং অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর নীতিভিত্তিক হলেই কেবল সেটা টেকসই হতে পারে।
মাঠপর্যায়ের এসব বাস্তবতা সম্পর্কে ভারত কূটনীতিক ও গোয়েন্দা সূত্র সঠিকভাবে অবহিত ছিল কি না, সে সন্দেহ ইতিমধ্যে উঠেছে। বিষয়টি ভারতের গোয়েন্দা কাঠামো ও কূটনীতিক টিমের দিক থেকে ব্যর্থতা নাকি একগুঁয়েমি, সে কথাও ভারতের প্রচারমাধ্যম এখন খতিয়ে দেখছে। নয়াদিল্লিতে অনেকেই তর্ক না করে এটা মানছেন—ঢাকায় তাদের ‘বিপত্তি’ ঘটেছে।
বিজেপিবিরোধীরা এই ‘বিপত্তি’কে মোদি সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেও প্রচারে আনতে পারেন বলে ইঙ্গিত মিলছে। ইতিমধ্যে লোকসভায় কংগ্রেসের মনীশ তেওয়ারি বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের কাছে বিবৃতি চেয়ে নোটিশ দিয়েছেন। শিবসেনার প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দিনই দ্য হিন্দু পত্রিকায় তাঁর প্রতিক্রিয়ায় ‘বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে খারাপ নজির’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
ভারতের জাতীয় রাজনীতির এসব পাল্টাপাল্টি হিসাবের বাইরে সেখানকার স্বাধীন বিশ্লেষকেরা অনেকে এ-ও প্রশ্ন করছেন, অজনপ্রিয়তা, প্রতিবাদ এবং নির্মম হত্যাযজ্ঞের ভেতর যে সরকারের পতন হলো, তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে ভারত বাংলাদেশের পরিবর্তনকামী জনতাকে কী বার্তা দিতে চাইছে? দীর্ঘমেয়াদি কূটনীতিক বিবেচনায় ভারতের জন্য এসব কতটা বুদ্ধিদৃপ্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে? এই পুরোনো ভুলগুলো শোধরানোর বদলে বাড়িয়ে তুলবে কি না?
শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পর বাংলাদেশে ইতিমধ্যে পুরোনো সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় বসেছে। যে সরকার মূলত একটা নির্বাচনকালীন অদলীয় সরকারমাত্র। কিন্তু সাময়িক সময়ের সরকার হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য-সহযোগিতা তার দরকার। এ ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা ও সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ এবং দরকারি। বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, সেসবও অবজ্ঞা করার মতো নয়।
শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানান বিষয়ে নিয়মিত ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় বহু বাংলাদেশি নাগরিকের। ভারতেরও এসব থেকে বিস্তর আয়রোজগার হয়। মোটকথা উভয় দেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক উভয়ের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন দিক থেকে উত্থাপিত মনোভাব বাংলাদেশের নতুন সরকারের জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠছে এই মুহূর্তে। দুই দেশের মধ্যে ট্রেন সার্ভিসও বন্ধ হয়ে আছে। স্থলবন্দরগুলোতে ট্রাকের চাকাও ঘুরছে না বলে সংবাদ বেরিয়েছিল।
এর মধ্যেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় গত শনিবার রয়টার্সকে বলছেন, তাঁর মা ‘ভারতে যাওয়ার আগে পদত্যাগ করেননি। তিনি এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।’ অথচ কিছুদিন আগে চলতি ঘটনাবলির প্রথম প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘মা আর রাজনীতি করতে চান না।’ তাঁর নতুন দাবির পরোক্ষ মানে দাঁড়ায় ভারত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে।
এ সব বক্তব্য সঙ্গত কারণে বাংলাদেশের পরিবর্তনের শক্তিসমূহের মাঝে অসন্তোষ তৈরি করছে। যা ক্রমে শান্ত হতে থাকা অবস্থায় উত্তেজনা ছড়াতে পারে বলে শঙ্কা আছে। প্রতীয়মান হচ্ছে, জয়ের বক্তব্যের সঙ্গে সংগতি রেখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী যদি ভারত থেকে কোনো রাজনৈতিক-প্রশাসনিক তৎপরতা চালাতে চান, তাহলে সেটা বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো ভালোভাবে নেবে না। উদীয়মান এসব শক্তি ভারতের ভূমিকাকে তীক্ষ্ণভাবে নজরে রাখছে।
ভারত কোনোভাবে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং নতুন সরকারকে অবমূল্যায়ন করছে কি না, সে সন্দেহ এরই মধ্যে স্থানীয় জনসমাজে আছে। এ রকম সন্দেহ উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বিপুল চাপ তৈরি করছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনক্রমে চ্যালেঞ্জে পরিণত হচ্ছে। আবার এ অবস্থা বাংলাদেশে সমাজে আন্তসাম্প্রদায়িক সম্পর্কে একটা অপ্রয়োজনীয়-অনাকাঙ্ক্ষিত চাপও তৈরি করছে। পুরো পরিস্থিতি তাই নয়াদিল্লির দিক থেকে গভীর পুনর্বিবেচনা দাবি করে।
রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা বলছেন, বাংলাদেশের সমাজে ও রাজনীতিতে এমন এক ‘পরম ব্যতিক্রমী অবস্থা’ তৈরি হয়েছে, যা ভারতে সর্বাগ্রে নির্মোহভাবে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। একে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই।
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের নির্বাচনগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক হলে এবং সচেতন উদাসীনতার বদলে ভারতের নীতিনির্ধারকেরা তাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলে হয়তো চলতি অবস্থা হতো না। প্রশ্নবিদ্ধ ওই কৌশল বাংলাদেশের জনসমাজের মনস্তত্ত্বে দ্রুতগতিতে যে পরিবর্তন ঘটাচ্ছিল, তারই ফল ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলি। নতুন এই বাংলাদেশকে গতানুগতিক পুরোনো কূটনীতিক মন দিয়ে সঠিকভাবে বোঝা যাবে না। বরং কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর বদলে ভারতের উচিত দ্রুত বাংলাদেশের জনমানসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার যেভাবে বিগত বছরগুলোতে ভারতের কংগ্রেস-বিজেপি-জনতা দলীয় সরকারের সঙ্গে কাজ করতে অভ্যস্ত ছিল, ভারতকেও একইভাবে প্রতিবেশী দেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চলতে অভ্যস্ত হওয়া জরুরি। বিশেষত এখানকার তরুণসমাজের চাওয়া-পাওয়াকে বুঝতে চেষ্টা করা, মর্যাদা দেওয়া। এটাই হলো নয়াদিল্লির দিক থেকে ইতিমধ্যে ঘটে যাওয়া ‘বিপত্তি’ থেকে বের হওয়ার আপাতরাস্তা।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন সরকারকেও তাদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে সব উপায়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। প্রায় আড়াই হাজার মাইল দীর্ঘ সীমান্ত আছে, এমন প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার বিকল্প নেই। এ নিয়ে হাল ছাড়ারও সুযোগ নেই।
উভয় দিকের এ রকম বাস্তবতার মধ্যে ৯ আগস্ট ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে শুভেচ্ছা জানালেন, সেটা একটা ভালো লক্ষণ। ভবিষ্যৎ ঘটনাবলি এই পারস্পরিক শুভকামনার আলোকেই এগোবে বলে সবার প্রত্যাশা। কারণ, বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য দরকারি।
মণিপুর ও মিয়ানমারে যেভাবে সহিংসতা ও উত্তেজনা চলছে, তাতে বাংলাদেশ-ভারত কূটনীতিক দূরত্ব এ অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে বাড়তি জটিলতাই কেবল বাড়াবে। তবে পাঁচ দশক পেরোনো অভিজ্ঞতা বলছে, সম্পর্ক সমমর্যাদা এবং অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর নীতিভিত্তিক হলেই কেবল সেটা টেকসই হতে পারে।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক