মতামত

কোনটা সংঘর্ষ, কোনটি হামলা– সাধারণ মানুষ জানেন

নয়াপল্টনে সভা বাতিল হলেও সেখানেই তিন শ পুলিশ পাহারায়। অর্থহীন এই বিপুল যজ্ঞের পেছনে জনগণের টাকারই ব্যবহার আছে।
ছবি : প্রথম আলো

বিএনপির সাধারণ কয়েকটা সভা ঠেকাতে সরকার গত কিছুদিনে যতটা মনোযোগ দিয়েছে, হায়, এ দেশের সাম্প্রতিক জটিল সমস্যাগুলো সমাধানে যদি ততটা মনোযোগ দিত! কত ভালো হতো, যদি সরকার এভাবেই সব বাহিনীসহ নেমে পড়ত বিদেশে পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনতে, অবৈধ কায়দায় গুদামজাতকৃত পণ্য উদ্ধারে, বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে স্থিতিশীলতা আনতে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিচারকাজ সমাধা করতে, শহর থেকে মশা তাড়িয়ে অপমৃত্যু ঠেকাতে...আরও কত সমস্যা যে আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে জীবনের হুমকি হয়ে উঠেছে, তাদের সরকার একবার বিএনপির মতো প্রতিপক্ষ ভাবতে পারত যদি! এদের সরানোর মিশনে সরকার সোয়াট নামাত, গাদা গাদা পুলিশ নামাত একবার...সেই তৎপরতা আর কৃতিত্ব দেখলে কে আর ফিরে তাকাত অন্য কোনো দলের দিকে?

চারদিকে সমস্যা ঘিরে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার পরও সরকারের নজর কেবল বিএনপির গতিবিধির দিকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাকালে বিএনপির অস্তিত্বের প্রমাণের চেয়ে বড় হুমকি সরকার আর কিছুকেই মনে করে না। বিচিত্র প্রশ্রয়ে সব সমস্যাকে জিইয়ে রেখে কেবল বিএনপির জেগে ওঠাকেই তাবৎ দেশের মূল সমস্যা মনে করে। সংসদে নামমাত্র উপস্থিতি ছিল বিএনপির, অথচ তাদের কল্পিত ‘বিরোধী দল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বস্তুত কিছু বাস্তব-অবাস্তব মামলা, হয়রানি, গ্রেপ্তার ও গুমের ঘটনার পর সরকার হয়তো ধরেই নিয়েছিল যে বিএনপির অস্তিত্ব বিলীন করা গেছে। ওদিকে বেকায়দায় পড়ে বিএনপিও ছিল দীর্ঘ শীতনিদ্রায় নিমজ্জিত। নির্বাচন সামনে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নিয়মিত সভা-সমাবেশের আয়োজনের মাধ্যমে বিএনপির জেগে ওঠা আকস্মিক কোনো বিষয় নয়, কিন্তু সরকার তা মেনে নিতে নারাজ।

অন্যদিকে বিএনপির বিভিন্ন ব্যর্থতাও তাদের নজর এড়ায় না। কিছু সভা-সমাবেশের সফলতার ওপরে ভিত্তি করে তাদের ওপর কতটা নির্ভর করা যায়, সে ব্যাপারেও সাধারণ মানুষ নিশ্চিত হতে পারেন না। মূলত ক্ষমতায় কে থাকে আর কে থাকে না, তাতে অতি সাধারণের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। শুধু ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চাওয়া, এই দুই দলের ক্ষমতার সংগ্রাম ও জটিলতায় তাঁদের জীবন হয় দুর্বিষহ কিংবা জীবনই যায় হারিয়ে। বিএনপি-আওয়ামী লীগের সমাবেশ বা সমাবেশস্থল নির্ধারণের বাগ্‌বিতণ্ডা থেকে সাধারণ মানুষের পাওয়ার কিছুই নেই, কেবল জানা ছাড়া যে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত পোড়া শহরটিতে এখনো ১২টি মাঠ আছে!

ঘটনাচক্রে ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের দিন (১০ ডিসেম্বর) ছিল বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘সবার জন্য মর্যাদা, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার’। প্রাসঙ্গিকভাবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানায়, সভা-সমাবেশে যোগ দেওয়া অপরাধ নয়, সাংবিধানিক অধিকার। সরকারের তরফ থেকে দিবসটি উপলক্ষে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জনগণের মানবাধিকার সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর। দেশে যখন গায়েবি মামলা, অহেতুক গ্রেপ্তার-হয়রানি, সমাবেশ সংগঠনে বাধা ইত্যাদি ঘটনা মানুষের চোখের সামনে ঘটছে, তখন মানবাধিকার দিবস পালন ও গৎবাঁধা বাণী সাধারণ মানুষের মধ্যে হাস্যরসের উদ্রেক করে বৈকি।

বিএনপির গত মাস তিনেকের কার্যক্রম যাচাই করলে দেখা যায় নয়াপল্টনের কার্যালয় ঘিরে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে অন্তত ১১টি সমাবেশ নির্বিঘ্নে আয়োজিত হয়েছে। সেখানে পুলিশের বা সরকারের কোনো মাথাব্যথা ছিল না, তাই দেশব্যাপী তার কোনো প্রচারও হয়নি। মূলত সরকারের অতি নজরদারি ও হস্তক্ষেপে এবারের সমাবেশ বহুল প্রচারিত ও আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠতে পেরেছে। কয়েক দিন ধরে সভাস্থল নিয়ে প্রস্তাব-প্রত্যাখ্যান কষাকষিতে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সরকারের আচরণে দেখা যায়, তাদের প্রতিনিধি যদিও বারবার বলেন, ‘খেলা হবে’ কিন্তু প্রতিপক্ষকে খেলার উদ্দেশ্যে মাঠেই নামতে দেন না। যখন যে শহরে সমাবেশ হবে, সেখানেই চলাচলসহ নানান নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। আর এই আচরণের মোকাবিলা করতে গিয়েই বিএনপি সুপ্ত দলের মোড়কের ভেতর থেকে নতুন আত্মপ্রকাশের প্রয়াস পায়।

সরকারি দলের ক্রমাগত হম্বিতম্বিতে ১০ ডিসেম্বর শহরজুড়ে হরতালের মতো পরিবেশ বিরাজ করছে, শ্রমিকেরা কাজ পাচ্ছেন না, রিকশাওয়ালা যাত্রী পাচ্ছেন না, বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, এই পরিস্থিতিতে কি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা হচ্ছে না? শহরে  ২০ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। নয়াপল্টনে সভা বাতিল হলেও সেখানেই তিন শ পুলিশ পাহারায়। অর্থহীন এই বিপুল যজ্ঞের পেছনে জনগণের টাকারই ব্যবহার আছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমেরিকা যেমন ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে’ তাদের ঘোষিত ‘অশান্ত’ স্থানে হামলা করে, হাজার হাজার পুলিশকে সে রকম ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার’ জন্য লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে বিএনপির শান্তিপূর্ণ সভাগুলোর পেছনে। এখন তাই পুলিশ রাস্তায় নেমে যা খুশি তাই করতে পারে। যে কারণে গত কিছুদিন তাদের নাটকে অভিনয় করা চরিত্রের মতো দেখাচ্ছে বললে হয়তো বেশি বলা হবে না।

গত কয়েক দিনে সিসিটিভি ও নানা ক্যামেরার সহায়তায় পুলিশকে গণমাধ্যমের সামনে গায়ের জোরে কল্পিত অভিযোগের কথা বলতে দেখা গেছে, সাদা ব্যাগ হাতে বিএনপি কার্যালয়ে ঢুকতে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ‘আধা ঘণ্টা পরে আরও দুটো বোমা ফুটবে’ জাতীয় ভবিষ্যদ্বাণী করতে দেখা গেছে, পুলিশ নিজেই সারি বাঁধা মোটরবাইক ভাঙচুর করছে, পথচারীকে মারধর করছে—এমন দৃশ্য দেখা গেছে। পুলিশ মানুষের মুঠোফোনের ব্যক্তিগত কল লিস্ট ও মেসেজ খতিয়ে দেখছে, এমনটাও দেখা গেছে। সাধারণ মানুষের ফোন খতিয়ে দেখা পুলিশের দায়িত্বের মধ্যে পড়তে পারে না, বরং মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হয় তাতে।

নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে না দেওয়ার পেছনে সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানতম কারণ ছিল রাস্তায় মানুষের চলাচল বিঘ্নিত হবে। এই আচরণ যে কতটা অবাস্তব, তা আওয়ামী লীগ নিজেই গত কয়েক দিনে প্রমাণ করেছে। গত সপ্তাহে কুমিল্লায় জনসভা করতে গিয়ে তারা সেখানে ছয় ঘণ্টা রাস্তা বন্ধ রেখেছে, এসএসসি পরীক্ষার তিনটি কেন্দ্র পরিবর্তন করেছে, কয়েকটি বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করেছে। অন্যদিকে দুদিন আগে গুলিস্তানে জনসভা করতে গিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঢাকার দক্ষিণ দিক অচল করে রেখেছে তারা। আইন ও বিবেচনা কি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য আলাদা?

ওদিকে গ্রেপ্তার করতে করতে হয়তো পুলিশ বাহিনী ক্লান্ত হয়ে থাকবে। রাজনীতির মঞ্চে নেতাকে গ্রেপ্তার করলে সারিতে অবস্থানরত পরবর্তী জন নেতৃত্ব দেন, কর্মীকে গ্রেপ্তার করলে নতুন কর্মী গজিয়ে যান। সফলভাবে একের পর এক সমাবেশ করে বিএনপি সে রকম কিছুই প্রমাণ করতে পারছে।  

এদিকে আনন্দের বিষয় এই যে চোখ-কান খোলা রাখলে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ ক্ষমতাসীনের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারসাজিগুলো ধরতে পারেন। কোনটা সংঘর্ষ, কোনটি হামলা বা আক্রমণ, মানুষ তার কতটুকু বোঝেন, তা রাস্তায় রাস্তায় মানুষের আলাপ শুনলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। কার্যালয় থেকে যখন চাল আর পানি জব্দ করা হয়, তখন সাধারণ মানুষ জানেন সেগুলো কেন এনে রাখা হয়েছিল। সরকারের এসব নিরুপায়, ভিতু, মরিয়া আর অযৌক্তিক আচরণ তাদের নেতৃত্বে সুষ্ঠু নির্বাচন যে আগের মতোই দুরাশা, তা-ও সাধারণ মানুষ অনুধাবন করেন।  

অন্যদিকে বিএনপির বিভিন্ন ব্যর্থতাও তাদের নজর এড়ায় না। কিছু সভা-সমাবেশের সফলতার ওপরে ভিত্তি করে তাদের ওপর কতটা নির্ভর করা যায়, সে ব্যাপারেও সাধারণ মানুষ নিশ্চিত হতে পারেন না। মূলত ক্ষমতায় কে থাকে আর কে থাকে না, তাতে অতি সাধারণের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। শুধু ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চাওয়া, এই দুই দলের ক্ষমতার সংগ্রাম ও জটিলতায় তাঁদের জীবন হয় দুর্বিষহ কিংবা জীবনই যায় হারিয়ে। বিএনপি-আওয়ামী লীগের সমাবেশ বা সমাবেশস্থল নির্ধারণের বাগ্‌বিতণ্ডা থেকে সাধারণ মানুষের পাওয়ার কিছুই নেই, কেবল জানা ছাড়া যে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত পোড়া শহরটিতে এখনো ১২টি মাঠ আছে!

  • আফসানা বেগম কথাসাহিত্যিক