আগামী মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে, ছড়িয়ে পড়বে গোটা দেশে

একটা সময় ডেঙ্গু শুধু ঢাকার রোগ ছিল, এখন সারা বাংলাদেশে বিস্তৃত হচ্ছে।
ফাইল ছবি

বছরের শুরু থেকেই চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি। কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন ৬০০–এর কাছাকাছি মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যদিও এ হিসাব ঢাকার ৫৩টি হাসপাতাল ও বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য। এই হাসপাতালগুলো ছাড়াও ছোট–বড় অনেক বেসরকারি ক্লিনিক ও বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন আরও অনেক রোগী। যেসব ক্লিনিক বা হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তথ্য পাঠায় না, সেই রোগীদের হিসাব ডেঙ্গু পরিসংখ্যানে যুক্ত হয় না। হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের তথ্য মতে, চলতি মাসের ৬ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছেন।

বাংলাদেশে মোট ভর্তি রোগীর প্রায় ২৯ শতাংশ ঢাকার বাইরের। একটা সময় ডেঙ্গু শুধু ঢাকার রোগ ছিল, এখন সারা বাংলাদেশে বিস্তৃত হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে এডিস মশার ঘনত্ব আমরা বেশি পাচ্ছি, ডেঙ্গুও ঊর্ধ্বমুখী। বিভিন্ন জেলার এডিস মশার ঘনত্ব ও ডেঙ্গু রোগীর তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এ বছর চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে অন্যান্য বছরের তুলনায় ডেঙ্গু বেশি হওয়ার ঝুঁকি আছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ হবে।

উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা। উপযুক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। সব মিলিয়ে ঢাকা যেন মশার স্বর্গরাজ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। বর্ষার শুরুতে ডেঙ্গুর আগ্রাসী ভাব আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে নগরবাসীকে।

বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে। তখন এটিকে ‘ঢাকা ফিভার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি হয় ২০০০ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব মতে, ৫ হাজার ৫০০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ৯৩ জন মারা যান। বাংলাদেশে ডেঙ্গু সবচেয়ে বড় আঘাত হানে ২০১৯ সালে। ওই বছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং সারা বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসাব মতে, ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ৬২ হাজার ৩২১ ও ২৮১।

ডেঙ্গু এমন একটি সমস্যা যেটিকে সিটি করপোরেশন একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আগামী মাসে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়বে। শুধু ঢাকায় নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও পৌরসভায় সবারই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত কারণ ডেঙ্গু সংক্রমণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জনসংখ্যার ঘনত্ব, মানুষের যাতায়াত, ব্যবহারযোগ্য পানির স্বল্পতা ও বিভিন্ন পাত্রে পানি সংরক্ষণ এডিস মশার ঘনত্ব ও ডেঙ্গু বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত খাবার ও বোতলজাত পানীয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এসব বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারার কারণে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা পরিবর্তিত পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাসের সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা না থাকলেও এটি অনুমান করা যায় যে করোনাভাইরাসের মতো এটিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে পরিবর্তন করে নিতে সক্ষম।

এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায় আর এই মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্যান্য মশার তুলনায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণও সহজ, কারণ, এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে বংশবিস্তার করে। জমা পানির পাত্র অপসারণ কঠিন কোনো কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। অন্যান্য মশার চেয়ে এডিস মশা কীটনাশক সহনশীল, তাই কীটনাশক দিয়েও এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ।

আমরা মাঠপর্যায়ে এডিস মশার ঘনত্ব পাচ্ছি অনেক বেশি এবং বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ঘনত্ব আরও বাড়বে এবং ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে সমানতালে। এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুমে, বিশেষ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু ভয়াবহ হতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম পদক্ষেপ নিতে হবে। এই আগাম পদক্ষেপের অন্যতম হলো এডিস মশার প্রজননস্থল অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণ করা। ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশের হাসপাতালগুলো থেকে ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে সেই রোগীর বাড়ির আশপাশে মশকনিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম করা জরুরি। ক্রাশ প্রোগ্রাম করে উড়ন্ত মশা মেরে দিতে পারলে ওই এলাকায় সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। ডেঙ্গু রোগীটি যেখান থেকে আক্রান্ত হচ্ছে সেই জায়গাতে ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা আছে। ভাইরাসবাহিত এডিস মশাটি যত দিন বেঁচে থাকবে, তত দিন সে জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু রোগ ছড়াতে থাকবে। তাই ডেঙ্গু রোগীর বাড়িকে কেন্দ্র করে ক্রাশ প্রোগ্রাম করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ডেঙ্গু এমন একটি সমস্যা যেটিকে সিটি করপোরেশন একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আগামী মাসে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়বে। শুধু ঢাকায় নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও পৌরসভায় সবারই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। নিজ পরিবারের সুরক্ষার জন্য নগরবাসীকে বাসাবাড়ি ও আঙিনায় মশা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হতে হবে। জনসাধারণকে নিশ্চিত করতে হবে যেন তাদের বাড়ি বা বাড়ির আঙিনায় কোথাও পানি জমে এডিস মশার জন্ম না হতে পারে। জনগণ, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও গণমাধ্যম সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে পারলে হয়তো আমরা এ সমস্যাটাকে মোকাবিলা করতে পারব।

  • অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক। ই–মেইল: professorkabirul@gmail.com