বাংলাদেশের সাংবাদিকতা যেখানে দুর্বল

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার একটি বড় দুর্বলতার দিক হচ্ছে দেশের গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত বিষয়ে ফলোআপ করা এবং এ বিষয়ে শ্রোতা-পাঠক-দর্শকদের ক্রমাগতভাবে অবহিত করার ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে আগ্রহী নয়। কিন্তু সাংবাদিকতাকে এই সময়ে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে এ বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি।

ফলোআপ বলতে কী বোঝানো হয়, তা কমবেশি সবাই জানেন। তবু আমরা এর একটি সাধারণ সংজ্ঞা প্রথমেই স্মরণ করতে পারি। মেরিয়াম ওয়েবস্টার অভিধানে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ফলোআপ স্টোরির একটা সাধারণ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে—পূর্বে প্রকাশিত কোনো স্টোরির ব্যাপারে নতুন তথ্য। দ্য নিউজ ম্যানুয়াল বলে যে ওয়েবসাইট আছে, তাতে এ বিষয়ে যা বলা হয়েছে, তার সারাংশ হলো ফলোআপ হচ্ছে অতিরিক্ত বিশদ বিষয়।

সেটা হতে পারে আগে যা বলা হয়েছে, সে বিষয়ে নতুন তথ্য, ঘটনার পরবর্তী নতুন ডেভেলপমেন্ট, আগের খবরের প্রতিক্রিয়া কিংবা একেবারে নতুন বিষয়। যেকোনো গণমাধ্যমেই প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা-দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারপর এ বিষয়ে আরও তথ্য প্রকাশিত হয়, বাংলাদেশ তার থেকে ব্যতিক্রম নয়।

তারপরও আমি কেন বলছি যে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো ফলোআপ রিপোর্ট করার বিষয়ে অনাগ্রহী? বলছি কেননা গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যেগুলোর ফলোআপ জানানোর একধরনের দায়িত্ব গণমাধ্যমের ছিল, যেগুলো যথাযথভাবে পালিত হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।

সাম্প্রতিক কালের ঘটনা দিয়েই শুরু করা যেতে পারে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ভবনে আগুনের ঘটনায় ৪৬ জন মারা যান। এর প্রায় এক মাস পর রাজউকের পক্ষ থেকে ৮ এপ্রিল একটি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ ঘটনার বিভিন্ন দিক, এই অগ্নিকাণ্ড আহত-নিহত ব্যক্তিদের বিষয়ে অনেক ধরনের ফলোআপ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

কিন্তু যেটা লক্ষ করার বিষয়, তা হচ্ছে এর পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে ‘অভিযান’ চালিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে মালিকেরাই রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেন। সেই সময়ে সরকারের বাহিনী অনেককে আটক করে। এই অভিযান কয়েক দিন পর স্তিমিত হয়ে গেছে।

কিন্তু এসব অভিযানের সময় কারা আটক হলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হলো, বন্ধ রেস্তোরাঁগুলো খুলল কি না, যাঁরা অভিযান চালালেন, তাঁরা আসলে কী আবিষ্কার করলেন—এসব বিষয়ে কোনো ধরনের ফলোআপ প্রতিবেদন নেই।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে রাজউকের তদন্ত প্রতিবেদন নিজেদের ছাড়া আর সবার গাফিলতি পেয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি ঘটেছে, সেই সময় কারা দায়িত্বে ছিলেন, সেই খবর পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের জানানোর জন্য কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ভবিষ্যতে হবে, এমন আশা করা সম্ভব হচ্ছে না, কেননা অন্তত আগের চারটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কথা মনে পড়ে—২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টা, ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ার, ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম এবং ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জে হাসিম ফুডের কারখানায় আগুন।

এসব ক্ষেত্রে বছরের ওই দিনে ঘটনা ও নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ করা আর আদৌ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তাতে কী নেই, সে বিষয় ছাড়া আর কোনো ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় না। বাংলাদেশের রেস্তোরাঁ ব্যবসার দেখভালের সঙ্গে যুক্ত আছে ১২টি সংস্থা, তারা কে কী করেছে, সে বিষয়ে কোনো ধরনের খবর চোখে পড়েনি।

এর চেয়ে একটু পেছনে যাওয়া যাক, অনেকেই হয়তো বিস্মৃত হয়েছেন যে ২০১৯ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে অকস্মাৎ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা জানতে পারেন যে দেশে অসংখ্য ক্যাসিনো গড়ে উঠেছে। সরকারের আচরণে মনে হয় যে জানামাত্রই তারা এসব ‘অবৈধ ক্যাসিনো’র বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত কিছু ব্যক্তি সেই সময়ে আটক হন। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

কালেভদ্রে আমরা এখন জানতে পারি, এসব মামলা যে অগ্রসর হচ্ছে না কিংবা এই ‘ক্যাসিনো–কাণ্ডে’ যুক্ত ব্যক্তিরা দেশে ফিরেছেন কিন্তু চার বছর পার হয়ে গেছে এখনো কোনো গণমাধ্যমে এই কথিত অভিযানের কারণ কী ছিল, কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা কী, এ ধরনের আরও ক্যাসিনো এখনো আছে কি না, এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো ধরনের ফলোআপ হয়নি।

এই ফলোআপ প্রতিবেদনের ব্যাপারে আরেকটি বিষয় লক্ষ করা যায়; তা হচ্ছে কেউ আটক বা অভিযুক্ত হওয়ার পর সরকারের বা বিশেষ বাহিনীর পক্ষ থেকে যেসব তথ্য দেওয়া হয়, সেগুলোই সবিস্তার ছাপা হয়। এগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন এগুলো গণমাধ্যমের করা ফলোআপ। সরকারি ভাষ্যের বাইরে গিয়ে এসব তথ্য যাচাই–বাছাই করার আগ্রহ দৃশ্যমান হয় না। আরও লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে এসব বিষয় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের প্রশ্ন করার প্রায় কোনো উদাহরণ নেই।

বেনজীর আহমেদ সরকারি দায়িত্বে থাকার সময়ে যাঁরা তাঁকে পুরস্কৃত করেছেন, তাঁরা কেন প্রশ্নের সম্মুখীন হন না? ফলোআপ যে সব সময় বড় ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই হতে হবে, তা নয়। নাগরিকদের আগ্রহ আছে বা জানানো কর্তব্য বলে বিবেচনা করলে, এমনকি যা আমরা নিয়মিতভাবে জানি, তা নিয়েও ফলোআপ প্রতিবেদন তৈরি করা যায়।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কাউকে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা কি প্রশ্ন করেছেন? যাঁরা সেই সময়ে দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা তো ধরাছোঁয়ার বাইরে নন। এ বিষয়ে প্রতিবেদন মানে হচ্ছে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার সময় কতবার পিছিয়েছে।

একই বিষয় আমরা দেখতে পাই সাংবাদিক সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁদের হত্যাকাণ্ডের এক যুগ পেরিয়েছে। আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ ১০০ বারের বেশি পিছিয়েছে, ফলোআপ বলতে এই হচ্ছে প্রতিবেদন। তদন্ত প্রতিবেদন কেন, কোথায় আটকে আছে, সেটা সাংবাদিকেরাও জানতে চান না​?

সম্প্রতি একটি দৈনিকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও র‍্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পদের খোঁজ পাওয়ার দাবি করে তথ্যসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে। সরকারের উচ্চ মহলে এর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী বলেছেন, ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত পেলে আইন অনুযায়ী অবশ্যই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সিদ্ধান্ত নেবে।’ কিন্তু দুদকের বাইরে এ বিষয়ে ফলোআপ হিসেবে আর কাউকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তা নয়। বেনজীর আহমেদ সরকারি দায়িত্বে থাকার সময়ে যাঁরা তাঁকে পুরস্কৃত করেছেন, তাঁরা কেন প্রশ্নের সম্মুখীন হন না?

ফলোআপ যে সব সময় বড় ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই হতে হবে, তা নয়। নাগরিকদের আগ্রহ আছে বা জানানো কর্তব্য বলে বিবেচনা করলে, এমনকি যা আমরা নিয়মিতভাবে জানি, তা নিয়েও ফলোআপ প্রতিবেদন তৈরি করা যায়।

ফলোআপ প্রতিবেদন যে বড় ধরনের ঘটনার খবর বের করে আনতে পারে, তার একটি উদাহরণ হচ্ছে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি। ১৯৭২ সালের ১৭ জুন ওয়াশিংটন পোস্টের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল যে ওয়াটারগেট ভবনে ডেমোক্রেটিক পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চুরি করতে গিয়ে পাঁচ ব্যক্তি পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। এ বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন পোস্টের পুলিশ বিট কাভার করতেন যে সাংবাদিক—আলফ্রেড ই লুইস।

দিনের পর দিন আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের জন্য আদালতে হাজির করা হলে সেখানে পাঠানো হয়েছিল বব উডওয়ার্ডকে। সেখানেই জানা যায় যে ওই ব্যক্তিরা গিয়েছিলেন অফিসের ভেতরের কথাবার্তা শোনা যাবে এমন একটি যন্ত্র স্থাপন করতে। ইতিমধ্যে আরেকজন রিপোর্টার কার্ল বার্নস্টাইন নিজের থেকেই আটক ব্যক্তিদের ব্যাপারে খোঁজখবর করতে শুরু করেন।

২৬ মাস ধরে পোস্ট এই কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ক্যাথলিক চার্চে শিশুদের যৌন নিপীড়নের খবর প্রকাশ করে বোস্টন গ্লোব পত্রিকার মার্টিন ব্যারন ও তাঁর সহকর্মীরা ২০০৩ পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই অনুসন্ধানী সিরিজ প্রতিবেদন শুরু হয়েছিল একটি খবর থেকে এবং সেই খবরের ফলোআপের সূত্র ধরেই অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

আজকের দিনে ফলোআপ প্রতিবেদন প্রকাশের গুরুত্ব আরও বেশি বেড়েছে। তার কারণ ব্যাখ্যা করে সিয়াটল টাইমসের কলামিস্ট জন টালটন ২০১৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ককে বলেছিলেন, এখন খুব দ্রুত তথ্য সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়, কিন্তু প্রায়ই এটা খোঁজার চেষ্টা হয় না এরপরে কী ঘটেছিল কিংবা এ ঘটনার শেষ হলো কীভাবে। এগুলো কেবল যে পাঠকদেরই সাহায্য করে তা নয়, ভালো রিপোর্টাররা এ থেকে আরও অনেক রিপোর্টের উপাদান পেতে পারেন।

টালটন আরও বলেছিলেন, অনলাইন মিডিয়ার জন্য ফলোআপ মুদ্রিত মিডিয়ার চেয়ে সম্ভবত বেশি দরকার। বাংলাদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, এই কথাগুলো তাঁদের মনে রাখা দরকার। কিন্তু যেটা আরও বেশি দরকার, তা হচ্ছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার এই দুর্বলতার দিকে মনোযোগ দেওয়া।

চারদিকে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যেগুলোর এক দিনের বর্ণনাই যথেষ্ট নয়, সাংবাদিকতাকে এই সময়ে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের দিতে হবে আরও অনেক বেশি।

  • আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট