রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন বন্ধ করা হচ্ছে না

বিগত সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া অলাভজনক ও অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ রকম ৩৫টি প্রকল্পের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যেগুলো বাতিল, অর্থায়ন স্থগিত অথবা ব্যয় কাটছাঁট করা হবে। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় এক লাখ কোটি টাকার বেশি।

যে ৩৫টি প্রকল্প বাতিল অথবা স্থগিত হতে যাচ্ছে, সেগুলোর কোনোটির কাজ মাঝামাঝি পর্যায়ে, কোনোটির কাজ মাত্র শুরু হয়েছে, কোনোটির কাজ এখনো শুরু হয়নি আর কিছু প্রকল্প অনুমোদনের পর্যায়ে আছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিগত সরকারের সময়ে নেওয়া প্রকল্পগুলো তিনটি দিক বিবেচনা করে বাতিল করা হচ্ছে। এগুলো হলো—এক. প্রকল্পটি কতটা মানুষের প্রয়োজনে নেওয়া হয়েছে। দুই. প্রকল্প থেকে সুফল কেমন আসবে। তিন. প্রকল্পটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কি না। (প্রথম আলো, ১০ নভেম্বর ২০২৪)।

অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক অপ্রয়োজনীয়, অলাভজনক ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রকল্প বাতিলের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে যে তিনটি বিবেচনায় নির্মাণাধীন বা পরিকল্পনাধীন প্রকল্প বাতিল করা হচ্ছে, সেই বিবেচনা ইতিমধ্যে চালু হয়ে যাওয়া প্রকল্পের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা দরকার বলে মনে করি।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। গত ১৯ আগস্ট পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, চলমান প্রকল্প হলেই রেখে দিতে হবে, তা নয়। বাকি অর্থ খরচ হলে লাভ হবে নাকি ক্ষতি হবে, তা বিবেচনায় আনতে হবে। এটাই অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা। ক্ষতি হলে বাদ দেওয়া ভালো। 

এই বিবেচনায় কোনো প্রকল্প যদি অপ্রয়োজনীয় হয়, যদি পরিবেশগত বিবেচনায় ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়, তা নির্মাণ হয়ে যাওয়ার পরও বাতিল করা প্রয়োজন। কারণ, ক্ষতিকর প্রকল্পটি যত দিন চালু থাকবে, ক্ষতি তত বেশি হবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এ রকমই একটি প্রকল্প, যা একদিকে অপ্রয়োজনীয়, অন্যদিকে এটি সুন্দরবনের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে, তার অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব অপরিমেয়।

দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর জন্য রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র অপরিহার্য নয়। দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতার প্রায় ৪০ শতাংশ অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান করা হয়। তা ছাড়া কারিগরি ত্রুটি ও কয়লাসংকটে প্রায়ই আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। সুন্দরবনের ক্ষতি করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ যে অপ্রয়োজনীয়, তা তেল–গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির পাশাপাশি আরও অনেকেই বলেছিলেন, যাঁদের মধ্যে বর্তমান সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও রয়েছেন।

তিনি ও তাঁর সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০১২ সাল থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করেছিল। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, দেশে বিদ্যুতের ওভার ক্যাপাসিটি হওয়ার পরও কেন রামপালের মতো দূষণকারী কয়লাভিত্তিক প্রকল্প প্রয়োজন। (ডেইলি স্টার অনলাইন বাংলা, জুলাই ৬, ২০২১) 

কাজেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য কতটা ক্ষতিকর, তা পরিবেশ উপদেষ্টা স্পষ্টভাবেই বোঝেন। এখন প্রয়োজন হলো সুন্দরবন রক্ষায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দ্রুত বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া। ইতিমধ্যেই সুন্দরবনের ওপর সেটির ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বর্জ্য পানি সুন্দরবনের মাইদারা ও পশুর নদে নির্গত হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যায়ে সম্পন্ন সিইজিআইএসের এই প্রতিবেদন অনুসারে, কয়লা ঠিকমতো না ঢেকেই পরিবহন করা হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুসারে কয়লা রাখার শেড, কোল স্ট্যাক ইয়ার্ড ও অ্যাশ সাইলো নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। ফলে সুন্দরবনের পরিবেশ দূষণ হচ্ছে এবং নদীর পানিতে দূষণকারী পারদ, নাইট্রেট ও ফসফেটের পরিমাণ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। (নিউ এজ, ২ নভেম্বর ২০২৪; ডেইলি স্টার, ১০ নভেম্বর ২০২৪)

এই সিইজিআইএস-ই কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশ সমীক্ষা করে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পরিবেশসম্মত হিসেবে রায় দিয়েছিল। ফলে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দূষণের প্রকৃত চিত্র কতটা উঠে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এরপরও প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে, তা যথেষ্ট দুশ্চিন্তার। 

পতিত স্বৈরাচার ও তার দোসর ছাড়া সে সময় দেশের সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মহল থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করা হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে রয়েছে তেল–গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি, বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এবং বহু দেশি–বিদেশি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং ২০–দলীয় জোটের পক্ষ থেকেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করার দাবি জানানো হয়েছিল। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৬ সালের আগস্টে সংবাদ সম্মেলন করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নেতিবাচক প্রভাব পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সর্বোপরি সুন্দরবনের ওপর কতটা পড়তে পারে, তার একটা চিত্র তুলে ধরেছিলেন। (বিবিসি বাংলা, ২৪ অাগস্ট ২০১৬)

জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেসকোও সরকারকে সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার সমর্থনের বিনিময়ে ভারতের কৌশলগত স্বার্থরক্ষায় মরিয়া সরকার স্বৈরাচারী কায়দায় সব জনমত উপেক্ষা করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছিল। এ বিষয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একবার বলেছিলেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে নেই, এটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ (প্রথম আলো, ১০ জুলাই ২০২০)

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র যে সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর, সে বিষয়ে দেশের ভেতরে একধরনের ঐকমত্য হয়েই আছে। আগের সরকারের মতো বর্তমান সরকারের ভারতের স্বার্থ দেখারও কোনো দায় নেই। কাজেই সুন্দরবনের আরও ক্ষতি হওয়ার আগেই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা।

কল্লোল মোস্তফা লেখক ও বিশ্লেষক