মিয়ানমারের বড় অঞ্চলজুড়ে প্রতিরোধযোদ্ধারা লড়াই করে যাচ্ছেন
মিয়ানমারের বড় অঞ্চলজুড়ে প্রতিরোধযোদ্ধারা লড়াই করে যাচ্ছেন

মতামত

মিয়ানমারের বিপ্লবে চীন যেখানে সফল, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ব্যর্থ

ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত ও আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গৃহদাহ—এসব ইস্যুর কারণে ২০২৩ সালের বেশির ভাগ সময়জুড়েই মিয়ানমার বিশ্বের মনোযোগ পায়নি। কিন্তু অক্টোবর মাসের শেষটাতে এসে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যেতে শুরু করে। এ সময় জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো (ইএওএস) অভিযান-১০২৭ শুরু করে।

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি সেনাচৌকিতে তারা একযোগে হামলা করে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। অস্ত্র ও গোলাবারুদের বিরাট মজুত তারা নিজেদের আয়ত্তে নেয়। জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর এই হামলার ফলে মিয়ানমার বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম হয় এবং বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের নিষ্ক্রিয়তাতে ঝাঁকুনি দেয়।

আরাকান, কারেননি, সাগায়িং, চীন স্টেটসহ অন্যান্য অঞ্চলে লড়াই ছড়িয়ে পড়ায় মিয়ানমারের থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের (৩বিএ) প্রতিরোধযুদ্ধের বিজয়ের ব্যাপারে বড় আশাবাদ তৈরি হয়। অভিযান ১০২৭ নামের অভিযানটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে যে মিয়ানমারের বর্তমান জামানার জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ অচলাবস্থায় আটকে নেই। প্রতিরোধযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁদের জয় করা এলাকার ওপর সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

মিয়ানমারের যুদ্ধক্ষেত্রে বিপ্লবীদের এই অগ্রগতির বিপরীতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে পদক্ষেপ, সেটা ধারাবাহিকভাবে কোনো প্রভাব রাখতে পারছে না। ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর আশা তৈরি হয়েছিল, বিশ্ব এবার মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের সহায়তা করবে, কিন্তু সেটা হয়নি। ২০২২ সালে জাতিসংঘের অবস্থান ঘিরে ক্ষোভ জন্ম হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বছর যেসব প্রচেষ্টা নেয়, তার সবটাই ছিল দুর্বল।

কিন্তু ২০২৩ সালে মিয়ানমারেরর প্রতিরোধযোদ্ধারা দৃঢ় আত্মনির্ভরতা, সংকল্প, আত্মবিশ্বাস দেখাতে শুরু করেন। বাইরের বিশ্ব থেকে তাঁদের বিপ্লবে কোনো ধরনের সহায়তা আসবে, মিয়ানমারের বিপ্লবীরা সেই প্রত্যাশা করেননি। অনেক তরুণ বিপ্লবী পশ্চিমাদের মানবিক সহায়তা ও জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা শিগগিরই বুঝতে পারেন, এটা নিছক প্রতিশ্রুতি। মিয়ানমারের বিপ্লবীদের একলাই পথ চলতে হবে।

মিয়ানমারের ক্ষেত্রে চীন আন্তর্জাতিক পরিসরের সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়। মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাবকে স্পষ্টভাবে আলাদা করা যায়। তিন বছর ধরে একটি চিৎকারই প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে যে মিয়ানমারের প্রতিরোধ আন্দোলনে বাইরে থেকে অস্ত্র দরকার। একটা ভুল আশা ছড়িয়ে পড়েছিল যে থাইল্যান্ডের মাধ্যমে ইউক্রেনের মতো মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমারের প্রতিরোধযোদ্ধাদের নীরবে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে চীন। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের ওপর চীনের কৌশলগত সমর্থন না থাকলে অপারেশন ১০২৭ সম্ভবপর হতো না।

মিয়ানমারের বিপ্লবীরা সেনাশাসনের অবসান এবং নতুন প্রগতিশীল রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে চলেছেন। আর তাঁরা পশ্চিমাদের সহযোগিতা কিংবা আশীর্বাদের জন্য বসে নেই।

পশ্চিমা বিশ্ব অথবা আসিয়ানকে ‘কৌশলে পরাস্ত’ করছে না চীন। তারা খুব স্বাভাবিকভাবে মিয়ানমারের বিষয়ে একটু বেশি মনোযোগ দিয়েছে এবং আরও বেশি কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে। ১২ জানুয়ারি কুনমিংয়ে অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে চীন। এই চুক্তির ফলে মিয়ানমারের সংঘাত থেমে যাবে অথবা মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে রক্ষা করা যাবে, তা নয়। কিন্তু এই চুক্তির মাধ্যমে চীনের প্রভাবটা স্পষ্ট হয়েছে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্য থাইল্যান্ড মিয়ানমারের সঙ্গে কারসাজির সম্পর্ক বজায় রাখার নীতিতে চলেছে। আর ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকা ছিল একেবারেই হতাশাজনক। বড় একটা আশা তৈরি হয়েছিল যে থাইল্যান্ডে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি সরকার গঠন করলে থাইল্যান্ড মিয়ানমারের প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ নীতি নেবে। কিন্তু বাস্তবে সবাইকে হতাশ হতে হয়েছে।

আর পশ্চিমারা মিয়ানমার প্রশ্নে তিনটা বড় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্রথম ব্যর্থতা হলো, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় তারা মিয়ানমার ইস্যু নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ জরুরি ত্রাণ সংস্থার প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস মিয়ানমারে তাঁর বিশেষ দূত নোলিন হাইজারকে সরিয়ে নেন। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরি কাউকে নিয়োগ করা হয়নি।

মিয়ানমারের বাস্তবতায় খাটে, এমন নতুন কোনো কিংবা ভালো কোনো ধারণা জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিম; বরং তারা বেশ কিছু বাজে উদ্যোগের জন্ম দিয়েছে। জান্তা সরকারের কর্মকর্তাদের গোপন একটি বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানায় ফিনল্যান্ড। সুইজারল্যান্ড জান্তা সরকারের কর্মকর্তা এবং মিয়ানমারের গুরুত্বহীন ও নামমাত্র অস্তিত্ব আছে, এমন গোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করে।

এ দুটি ঘটনারও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে মিয়ানমারের নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো। গণনৃশংসতার স্পষ্ট ও চাক্ষুষ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা নীরব থেকেছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে অধিকার প্রচারের ক্ষেত্রে তাদের প্রশংসনীয় ভূমিকা থাকলেও বিচার নিয়ে প্রচারণার ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা দেশগুলো তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে মিয়ানমারকে অগ্রাধিকার প্রদান করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের অতি আশাজাগানো বার্মা অ্যাক্ট আক্ষরিক অর্থে কিছুই জন্ম দিতে পারেনি। একটা ব্যাপার হচ্ছে, ত্রাণসহায়তা বা মানবিক কার্যক্রম যখন প্রধান হয়ে ওঠে, তখন কূটনৈতিক তৎপরতা টোকেনসর্বস্ব হয়ে ওঠে, আর সরকারের সমর্থনও মাঠে মারা যায়।

তৃতীয়ত, মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকার বা এনইউজি আন্তর্জাতিক পরিসরে যাতে কার্যকরভাবে ভূমিকা পালন করে, সে জন্য তাদের সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব।

মিয়ানমারজুড়ে প্রতিরোধযোদ্ধারা যে শক্তি, উদ্যম ও আত্মত্যাগের নজির স্থাপন করে চলেছেন, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপগুলো বিসদৃশভাবে মিলছে না। এমনকি মিয়ানমারের বিভিন্ন জায়গায় বাস্তব যে লড়াই চলছে, তার সঙ্গে দেশটির নির্বাসিত (সীমান্ত দেশগুলোতে হোক আর দূরের কোনো দেশে হোক) নাগরিকদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে মেলবন্ধন হচ্ছে না।

মিয়ানমারের বিপ্লবীরা সেনাশাসনের অবসান এবং নতুন প্রগতিশীল রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে চলেছেন। আর তাঁরা পশ্চিমাদের সহযোগিতা কিংবা আশীর্বাদের জন্য বসে নেই।

  • ডেভিড স্কট ম্যাথুসন, সংঘাত, মানবিক সহায়তা ও মানবাধিকার বিষয়ে স্বাধীন বিশ্লেষক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত