অবাধ্য বা নিষিদ্ধ বেলুন ও পুলিশের অসতর্কতা

আইন না মেনে গোটা দেশের অলিগলিতে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস ভরে বেলুন বিক্রি করা হচ্ছে
ছবি: সংগৃহীত

শিরোনাম দেখে পাঠক হয়তো ভাবছেন, বেলুন নিষিদ্ধ হতে পারে, বাধ্য কিংবা অবাধ্য কী করে হয়। একটি সিনেমার কথা বলি। মূলত ৩৪ মিনিটের বিখ্যাত একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র—দ্য রেড বেলুন। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া অস্কারজয়ী এ সিনেমার মূল চরিত্র হচ্ছে এক বালক। পরিচালক আলবার্ট লামোরিসেরই ছেলে। একদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে একটি লাল বেলুন খুঁজে পায় বালক।

এরপর থেকে সেই বেলুনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। তার এই বেলুনপ্রীতিতে ঘর বা স্কুলের সবাই অতিষ্ঠ। এ কারণে বাইরেই রাখতে হয় বেলুনটিকে। সেটিও কোথাও আর উড়ে যায় না। ‘বাধ্য ছেলের মতো’ বালকের কথা শোনে। ডাকলেই কাছে আসে, তার কাছে ধরা দেয়। সিনেমার বাকি গল্প হয়তো অনেকের জানা।

এবার আসা যাক ‘অবাধ্য’ এক বেলুনে। সেই বেলুনের দেখা পাই ১৬ সেপ্টেম্বর গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, অনুষ্ঠান উদ্বোধনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে দেওয়া হয় কয়েকটি বেলুন। কিন্তু বারবার চেষ্টাতেও বেলুনগুলো উড়ছিল না।

‘অবাধ্য’ বেলুনগুলোকে পরে কয়েকজন পুলিশ সদস্য মঞ্চের পাশে নিয়ে যান। বেলুনগুলো না ওড়ায় বেলুন বিক্রেতাকে ডেকে বকাঝকা করেন তাঁরা। বেলুন বিক্রেতাও বুঝতে পারছিলেন না কী ঘটনা। তিনিও চেষ্টা করলেন, উড়ল না বেলুনগুলো। দ্য রেড বেলুন সিনেমার বালকের মতো কথা শুনল না। একপর্যায়ে বিক্রেতা আগুন জ্বালিয়ে বেলুনগুলো ওড়ানোর চেষ্টা করলেন।

তখনই ঘটল বিস্ফোরণ। এ সময় পাশেই থাকা ‘মীরাক্কেল’খ্যাত কৌতুক অভিনেতা আবু হেনা রনিসহ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তা দগ্ধ হন। রনির দগ্ধ হওয়া ছবি দেখে সন্দেহ নেই, কী ভয়াবহ ছিল সেই বিস্ফোরণ! হওয়ারই কথা, কারণ বেলুনগুলো শুধু ‘অবাধ্যই’ ছিল না, ছিল নিষিদ্ধও। বেলুনের ভেতরে দাহ্য গ্যাসীয় পদার্থ থাকার কারণেই বিস্ফোরণ ঘটে। আইন অনুসারে, এ ধরনের গ্যাস বেলুন নিষিদ্ধ।

দ্য রেড বেলুন সিনেমায় বালক ও তার খেলার সাথী বেলুন। হিলিয়াম গ্যাস বেলুন হওয়ার কারণে সেটি বিপজ্জনক ছিল না।

এভাবে গ্যাস বেলুন বিস্ফোরণের ঘটনা নজিরবিহীন। এর আগে গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের অনেকগুলো ঘটনা আমরা দেখতে পাই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরাই হতাহত; যেহেতু বেলুনের প্রতি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয় তারাই। গত জুন মাসে মাদারীপুরের রাজৈরে ইউপি নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রের পাশে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারা যায় এক শিশু ও বেলুন বিক্রেতা।

জন্মদিনের এক দিন আগেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় শিশুটি। এ বছর জানুয়ারিতে কক্সবাজারের মহেশখালীর এক স্কুলে তেমনি এক বিস্ফোরণে নিহত হয় এক শিশু। একই মাসে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলায় আরেক ঘটনায় আহত হয় প্রায় ৪০ শিশু।

মেলা উপলক্ষে বেলুন বিক্রেতা বেলুনে গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০১৯ সালের অক্টোবরে রাজধানীর রূপনগর এলাকার ঘটনা। সেখানে গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিল অন্তত আট শিশু। একসঙ্গে এত শিশুর মৃত্যু গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।

অন্যান্য দেশে গ্যাস বেলুনে ব্যবহার করা হয় হিলিয়াম গ্যাস। কারণ, এ গ্যাস থেকে আগুন ধরে না, বিস্ফোরণ হওয়ার আশঙ্কাও নেই বললেই চলে। দ্য রেড বেলুন সিনেমার বেলুনটিও ছিল হিলিয়াম বেলুন। ফলে পাড়ার ছেলের দল যখন সেটির দিকে ঢিল ছোড়ে, ধীরে ধীরে সেটি চুপসে যেতে থাকে। বিস্ফোরিত হয় না। কিন্তু হিলিয়ামের দাম অনেক বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশে বেলুনে ব্যবহার করা হয় হাইড্রোজেন গ্যাস।

বিস্ফোরক আইন ১৮৮৪–এর অধীনে সিলিন্ডার বিধিমালা ১৯৯১ অনুযায়ী, কোনো সিলিন্ডারে গ্যাস তৈরি, এক সিলিন্ডার থেকে আরেক সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা, বেলুনে গ্যাস ভরা এমনকি বিক্রি করাও নিষিদ্ধ। এর জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমতি লাগবে। কিন্তু গোটা দেশের অলিগলিতে অসংখ্য বেলুন বিক্রেতা আইন না মেনে সেটিই করে যাচ্ছেন।

যার ফলে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। রূপনগরের ঘটনায় এ নিয়ে বেশ আলোচনা তৈরি হলে তখন বিস্ফোরক অধিদপ্তর জানিয়েছিল, সিলিন্ডার ব্যবহার করে বেলুনে গ্যাস ভরে বিক্রি করা অবৈধ। এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সব থানায় বিভিন্ন সময় চিঠি পাঠানো হয়েছে। পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অন্যদিকে, পুলিশের বক্তব্য ছিল, এর দায়দায়িত্ব মূলত বিস্ফোরক অধিদপ্তরের। তাদেরকেই সিলিন্ডার ব্যবহারকারী বেলুন বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে, এ ক্ষেত্রে তাদের পুলিশ সহযোগিতা করবে।

এ বিষয়ে আমরা কথা বলি উপপ্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. আবদুল হান্নানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরক অধিদপ্তর তো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়। রাস্তায় রাস্তায় অভিযান চালিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া বা জরিমানা করার ক্ষমতাও আমাদের নেই। এ–সংক্রান্ত কোনো আইনও নেই। আর সীমিত কয়েকজন কর্মকর্তা দিয়ে তো এমনিতেই গোটা দেশে অভিযান চালানো সম্ভব নয়। এ কাজ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের।

আমরা বরং তাদের সহযোগিতা করতে পারি।’ বিস্ফোরক অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা বলেন, এভাবে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার ও বেলুন বিক্রি অবৈধ ও নিষিদ্ধ, তা সব জেলা প্রশাসককেও বলা আছে। বিষয়টি পুলিশও জানে। জানে না—এমন কেউ নেই। এরপরও এভাবে বেলুন বিক্রির বিষয়টি বন্ধ হচ্ছে না শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বহীনতার কারণে।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের অনুষ্ঠানে গ্যাস বেলুন বিস্ফোরণে পাঁচজন দগ্ধ হন। দগ্ধ আবু হেনা রনিকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। বলতে গেলে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। এখন অনেকটা আশঙ্কামুক্ত রনি।

সাধারণত, অন্যান্য দেশে গ্যাস বেলুনে ব্যবহার করা হয় হিলিয়াম গ্যাস। কারণ, এ গ্যাস থেকে আগুন ধরে না, বিস্ফোরণ হওয়ার আশঙ্কাও নেই বললেই চলে। দ্য রেড বেলুন সিনেমার বেলুনটিও ছিল হিলিয়াম বেলুন। ফলে পাড়ার ছেলের দল যখন সেটির দিকে ঢিল ছোড়ে, ধীরে ধীরে সেটি চুপসে যেতে থাকে। বিস্ফোরিত হয় না। কিন্তু হিলিয়ামের দাম অনেক বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশে বেলুনে ব্যবহার করা হয় হাইড্রোজেন গ্যাস।

আর যেখানে–সেখানে খুব সহজে হাতের কাছে নানা জিনিস দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস বানিয়ে ফেলা যায়। হিলিয়াম বেলুন বলা হলেও আদতে সেগুলো হাইড্রোজেন বেলুন। হাইড্রোজেন গ্যাস যেহেতু অতি দাহ্য পদার্থ, এ কারণে একটু এদিক–সেদিক হলেই ঘটে সর্বনাশ। যেমনটি আমরা দেখলাম জিএমপির অনুষ্ঠানে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হয়েও তারা কি আইনভঙ্গ করল না? এটা কি পুলিশের অসতর্কতা বা অজ্ঞতা নয়?

শিশুদের আকৃষ্ট করতে নানা ফুল, পশুপাখি ও কার্টুন চরিত্রের আকার-আকৃতির গ্যাস বেলুন দেদার বিক্রি হচ্ছে রাস্তাঘাটে। বিয়েশাদি, পুনর্মিলন, নবীনবরণ বা যেকোনো আনন্দঘন অনুষ্ঠানে অন্যতম অনুষঙ্গ এখন গ্যাস বেলুন।

পুলিশ বাহিনীর অনুষ্ঠানেই যখন গ্যাস বেলুনের ব্যবহার আমরা দেখি, তাহলে সাধারণ মানুষকে কীভাবে এ থেকে নিবৃত্ত রাখা যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাস বেলুন হচ্ছে একধরনের ‘গ্যাস বোমা’। এখন এ ‘গ্যাস বোমা’ উৎপাদন ও বিক্রি কি বন্ধ হবে না? জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং পুলিশের কেন এখানে কোনো ভূমিকা থাকবে না?

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক