একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হলো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের ঘিরে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় শিক্ষকদের, কর্মকর্তাদের কিংবা কর্মচারীদের। তাই শিক্ষার্থীদের ‘স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট’ বিষয়গুলোকে সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আসছে। আর সেটাই মূলত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ‘মূলনীতি’।
কিন্তু আমাদের দেশে ঘটনা কিছুটা উল্টো। এখানে ‘সাধারণ’ শিক্ষার্থীদের স্বার্থের বাইরে ‘রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন’ অক্ষগুলোকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই যেমন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে শোবার জায়গা না পেলেও ‘রাজনৈতিক নেতারা’ একাধিক আসন আবাসিক হলগুলোয় দখল করে থাকে, বহিরাগতদের জায়গা দেয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ফেলা শিক্ষার্থীদের দিনের পর দিন আবাসিক হলগুলোয় রাখতে কোনো অসুবিধা হয় না।
আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন মাঝেমধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকত মূলত ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের জেরে। বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল বন্ধের ঘোষণা আসত সিন্ডিকেটের জরুরি সভা থেকে। অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণক্ষয়, ছাত্রবিক্ষোভ, সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য কৌশল অবলম্বন করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ’ করে আসছে।
শিক্ষার্থীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ‘স্বার্থের’ বনিবনা না হলে দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকে, যার কারণে শিক্ষার্থীদের সেশনজটের মিছিল কিছুটা হলেও দীর্ঘায়িত হয়।
এই ধারার সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর একক আধিপত্যের কারণে প্রতিপক্ষ শিবিরের উত্তাপ কিংবা সংঘর্ষের ঘটনা হাতে গোনার মতো হয়ে গেছে।
তবে এই তালিকায় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যেই বিপক্ষ, উপলক্ষ কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সঙ্গেই ঝক্কি-ঝামেলায় পোহাতে হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া আর যা-ই হোক, শিক্ষকদের দাবিদাওয়া আদায়কে কেন্দ্র করে ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়’ মাসখানেক ধরে বন্ধ আছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর দেখলাম। এই বন্ধের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টি দেড় যুগ পার করে উনিশে পা দিয়েছে।
আমি নিশ্চিত নই, এই ১৯ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি এভাবে বন্ধ ছিল কি না, তবে গত দুই দশকের মধ্যে এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আছে মূলত শিক্ষকদের ‘দ্বন্দ্বের’ কারণে এই কথা বলতে পারি। কী অদ্ভুত ঘটনা তাই না?
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও উপাচার্যের ক্ষমতার বলি কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। ক্লাস, পরীক্ষা বন্ধ রেখে ‘উপাচার্যের’ ক্ষমতাচর্চার এমন নজির সত্যিই বিরল। যে শিক্ষকেরা ‘শিক্ষার্থীদের নীতিনৈতিকতা’ শেখাবে, তাঁরাই কি না মারামারি-হাঙ্গামায় জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করে দিল! কিন্তু কেন এমন হবে? কী পরিস্থিতির অবতারণা হয়েছিল, যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো?
প্রথম আলোর খবর বলছে, চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈনের সঙ্গে তাঁদেরই শিক্ষকদের সংগঠনের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে কিছু দাবিও পেশ করে, যেখানে উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির নেতাদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয়। ধাক্কাধাক্কি ও মারামারির অভিযোগ তুলে থানায় যায় দুই পক্ষ। এ পরিস্থিতিতে মার্চে সপ্তাহব্যাপী ক্লাস বর্জন করে। ঈদ ছুটির পর ২১ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সপ্তাহখানেক পর ৩০ এপ্রিল উপাচার্য জরুরি সিন্ডিকেট আহ্বান করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও হল বন্ধ করে দেয়। আর এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি এই লেখা পর্যন্ত (মে ৩০) বন্ধ।
প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের জন্য উপাচার্য কেন হাঁটলেন? বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ না করলে কী পরিস্থিতি তৈরি হতো, আর এই এক মাসে সেই পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হলো? শিক্ষকেরা যে দাবি তুললেন, সেগুলো আসলে কী? দাবিদাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে শিক্ষকেরাই-বা কেন ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের পথ দেখলেন?
বিষয়গুলো যেটাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে নিজেদের ‘স্বার্থসিদ্ধি’ করার অস্ত্র রাষ্ট্র তাঁদের দেয়নি। বছরের পাঁচ মাসের মধ্যে দুই মাসের অধিক ‘অস্থিতিশীল’ পরিবেশ সৃষ্টি করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করে দেওয়ার ক্ষমতাও উপাচার্য কিংবা শিক্ষকদের দেয়নি। সাত হাজার শিক্ষার্থীদের ২৫০ শিক্ষকের বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ রেখে সমাধানের পথ দেখার সিদ্ধান্ত মূলত একপক্ষীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিষ্টাচারবহির্ভূত বটে।
আমরা চাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীপ্ত শিখার মতো জ্বলে উঠুক। শিক্ষকেরা সেখানে প্রাণ সঞ্চার করুক। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ঘরে পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ‘সুনসান’ বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার এমন হাতিয়ার আর যা হোক কোনো উপাচার্যের সফলতার গল্প হতে পারে না। তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। আবার দাবি আদায় করতে গিয়ে মারামারি করা কোনো শিক্ষক নেতাদের ‘শিক্ষকসুলভ’ আচরণও হতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবিগুলো যদি অযৌক্তিক কিংবা ন্যায়সংগত না হয়, তাহলে উপাচার্যের ক্ষমতাবলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের সাহায্য নিতে পারতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির আইন ২০০৬-এর ১১ ধারায় উপাচার্যের ক্ষমতা ও দায়িত্বের ৯ উপধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার সিদ্ধান্তের সঙ্গে উপাচার্য ঐকমত্য পোষণ না করলে, দ্বিমত পোষণের কারণ জানিয়ে ওই সংস্থা বা কর্তৃপক্ষকে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারবেন আর সেখানেও উপাচার্য ঐকমত্য পোষণ না করলে সিদ্ধান্তের জন্য চ্যান্সেলরের কাছে পাঠাতে পারবেন আর চ্যান্সেলর সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বিবেচনা করা হবে।
এই সহজ পথ না দেখে, উপাচার্য ক্ষমতাবলে জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে যে দাপট দেখিয়েছেন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চাওয়াকে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, তাতে আর কোনো আশ্চর্য না হোক, আমরা তাঁর দায়িত্বের ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে বড়ই ব্যথিত হই।
যদিও এর পরের উপধারায় ‘জরুরি পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা’ নেওয়ার অধিকার উপাচার্যকে দেওয়া হয়েছে। তবে এমন কোনো পরিস্থিতির তৈরি হয়নি, এমন কোনো জরুরি অবস্থার ক্ষেত্র হয়নি, যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ থাকতে হবে।
শিক্ষকদের ‘দ্বন্দ্ব কারণে’ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো’ শিক্ষার্থীকে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। শিক্ষকদের পাল্টাপাল্টি এ অবস্থার কারণে, শিক্ষার্থীরা যে ভোগান্তিতে পড়লেন, তা দেখবে কে? নিজেরাই মারামারি করে, তাহলে শিক্ষার্থীদের কোন নৈতিকতার শিক্ষা তাঁরা ক্লাসে দেবেন শুনি? হাতাহাতি, কনুইয়ের ধাক্কাধাক্কি যদি উপাচার্যরা করেন, শিক্ষকেরা মামলা করেন, তাহলে ‘এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের’ প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় চলে ‘শিক্ষার্থীদের’ জন্য। শিক্ষার্থীদের জন্যই শিক্ষকেরা নিয়োগ পান। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে, নিজেদের ‘মাস্তানি’ দেখানোর স্থান বিশ্ববিদ্যালয় নয়। নিজেদের সম্মান নিজেরাই খুইয়ে ফেলছেন তাঁরা। আর কত নিচে নামলে আমাদের শিক্ষকদের ‘কাণ্ডজ্ঞান’ ফিরবে?
রাগ-ক্ষোভ প্রশমনের জন্য ‘সময়ক্ষেপণ’ ভালো কৌশল, তবে সেটি যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অধিকারকে বঞ্চিত করে করা হয়, তাহলে সেটা নেহাত ‘আত্মরক্ষার’ বা স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ফেলানোর অধিকার রাষ্ট্র আপনাদের দেয়নি।
উপাচার্যের এই ক্ষমতা প্রদর্শন নতুন নয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে, বছরখানেক এই উপাচার্য দুর্নীতিকে উৎসাহ দেওয়ার বক্তব্য দেওয়ার খবর প্রকাশের জের ধরে এক সাংবাদিককে (শিক্ষার্থী) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। দুর্নীতি হচ্ছে বলেই দেশের উন্নতি হচ্ছে, এমন মন্তব্য যে উপাচার্যের মস্তিষ্ক থেকে বের হয়েছিল, সেই উপাচার্যের কাঁধে বিশ্ববিদ্যালয়টি যে নিরাপদ হয়ে ওঠেনি, তা এই ‘মামলাবাজি’ মারামারির ঘটনা মনে করে দিচ্ছে।
আমরা চাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীপ্ত শিখার মতো জ্বলে উঠুক। শিক্ষকেরা সেখানে প্রাণ সঞ্চার করুক। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ঘরে পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ‘সুনসান’ বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার এমন হাতিয়ার আর যা হোক কোনো উপাচার্যের সফলতার গল্প হতে পারে না। তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। আবার দাবি আদায় করতে গিয়ে মারামারি করা কোনো শিক্ষক নেতাদের ‘শিক্ষকসুলভ’ আচরণও হতে পারে না। প্রতিষ্ঠানটি সচল করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য কিংবা মঞ্জুরি কমিশনকেই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: nadim.ru@gmail.com