তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে যা করতে হবে

নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ করার পর আফগানিস্তানের অধিকারকর্মীদের প্রতিবাদ
ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তানের ভয়াবহ মানবিক সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য গত সপ্তাহে দোহায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিশেষ দূতদের একটি বৈঠক হয়েছে।

দুই দিনের ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, পাকিস্তানসহ ২৫টি দেশের প্রতিনিধিরা ছিলেন। এর পাশাপাশি ইউরোপের বড় বড় দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তবে ২০২১ সালের আগস্ট মাস থেকে আফগানিস্তানের কার্যত ক্ষমতাসীন তালেবান নেতাদের কাউকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

জাতিসংঘে তালেবানের দূত সুহায়েল শাহিন বৈঠকে তালেবান সরকারের কোনো প্রতিনিধি না রাখার সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছেন। তিনি এ সিদ্ধান্তকে ‘বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য’ বলে দাবি করেছেন। তবে বৈঠকে তালেবানের কাউকে ডাকা না হলেও মানবাধিকারকর্মীদের যৌক্তিক আশঙ্কা ছিল, বৈঠকে তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচিত হতে পারে। বলা বাহুল্য, তালেবান কর্তৃপক্ষকে আফগানিস্তানের বৈধ সরকার বলে এখনো কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি।

মানবাধিকারকর্মীদের ভয় দূর করতে বৈঠকের পর গুতেরেস বলেছিলেন, এ বৈঠকের উদ্দেশ্য ‘কার্যত শাসক তালেবান কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি সম্পর্কে নয়’ বরং আফগানিস্তানের ভয়াবহ পরিস্থিতির বিষয়ে একটি ‘সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি’ গড়ে তোলাই এর মূল লক্ষ্য।

পুনরায় ক্ষমতা দখল করার পর থেকে তালেবান কর্তৃপক্ষ নারী ও মেয়েদের অধিকারকে দমন করে আসছে; কর্মসংস্থান ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের নিষিদ্ধ করেছে; পর্দার একটি কঠোর নিয়ম বলবৎ করেছে এবং পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ছাড়া তাদের দূরদূরান্তের ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে। গত মার্চ মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার অফিসের একটি বিবৃতিতে আফগান নারীদের ওপর চালানো দমন-নিপীড়নকে ‘মর্যাদা, সমতা এবং মানবতার সব মানদণ্ডের অবমাননা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

জাতিসংঘের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো তালেবানের গত বছর আন্তর্জাতিক এনজিওতে কাজ করা নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করেছে এবং অতিসম্প্রতি জাতিসংঘের সংস্থাগুলোতেও নারীদের কাজ করা নিষিদ্ধ করেছে। আফগানিস্তানের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যক্লিষ্ট। এর মধ্যে তাদের এ সিদ্ধান্ত বিদ্যমান মানবিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেবে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২ কোটি ৮০ লাখের বেশি আফগান নাগরিক মানবিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তার আওতায় রয়েছেন।

তালেবানের নিষেধাজ্ঞা সমগ্র আফগানিস্তানের নারী ও মেয়েদের কাছে অতিপ্রয়োজনীয় ত্রাণসহায়তা পৌঁছাতে দিচ্ছে না। তালেবানের কঠোর শাসনের কারণে পুরুষ ত্রাণকর্মীরা নারীদের কাছে খাবার, পানীয় ও ওষুধ নিয়ে যেতে পারছেন না। গত সপ্তাহের বৈঠকে গুতেরেস আফগানিস্তানের সংকট মোকাবিলায় তহবিল ঘাটতির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘ প্রধানের ভাষ্যমতে, সেখানে ৪৬০ কোটি ডলার সহায়তার তহবিলের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও এ পর্যন্ত ‘মাত্র ২৯ কোটি ৪০ ডলার’ পাওয়া গেছে।

তালেবানের জন্য এ প্রস্তাবে রাজি হওয়ার সুবিধা হলো, এতে তাদের শাসন একধরনের বৈধতার রূপ পাবে এবং তালেবানকে এটি দেখানোর সুযোগ দেবে যে তারা দেশটির মানবিক সংকট সমাধানে আগ্রহী ও সক্ষম। তবে এ ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। তালেবান কর্তৃপক্ষের হাতে মানবিক সহায়তার ত্রাণ তুলে দিলে তা সত্যিকারের গরিব মানুষের হাতে না পড়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ভুল লোকের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।

গত মাসে জাতিসংঘ তালেবানকে সতর্ক করেছিল, তাদের ‘সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা লাখ লাখ আফগানকে (যাঁদের বেশির ভাগই নারী) জরুরি সহায়তা পাওয়াকে আরও বাধাগ্রস্ত করবে।’ এতেই বোঝা যাচ্ছে, আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে জাতিসংঘ কতটা পিছিয়ে আছে।

দোহার বৈঠকেও আশ্চর্যজনকভাবে সবাই একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। বৈঠকের পরে গুতেরেস বলেছেন, ‘আফগান জনগণকে অগ্রাধিকার দিয়ে জাতিসংঘ তার আহ্বায়ক ক্ষমতা ব্যবহার করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।’

আগামী কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পথ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একটি কঠোর পরীক্ষার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, তালেবান শাসনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি আপাতদৃষ্টে আলোচনার টেবিলের বাইরে থাকলেও তালেবানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাজ করার একটি বিকল্প খোলা রাখা হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবানকে মানবাধিকারবিষয়ক বাধ্যবাধকতা মেনে নেওয়ার বিনিময়ে তাদের বহুপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নিতে দেওয়ার এবং কিছু সহায়তা তহবিল পাওয়ার লোভ দেখাতে পারে।

তালেবানের জন্য এ প্রস্তাবে রাজি হওয়ার সুবিধা হলো, এতে তাদের শাসন একধরনের বৈধতার রূপ পাবে এবং তালেবানকে এটি দেখানোর সুযোগ দেবে যে তারা দেশটির মানবিক সংকট সমাধানে আগ্রহী ও সক্ষম। তবে এ ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। তালেবান কর্তৃপক্ষের হাতে মানবিক সহায়তার ত্রাণ তুলে দিলে তা সত্যিকারের গরিব মানুষের হাতে না পড়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ভুল লোকের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।

তালেবান বারবার দাবি করে আসছে, নারীদের বিষয়ে তাদের অবস্থান ইসলামের কঠোর ব্যাখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের এ অবস্থান পরিবর্তন করা অনেক কঠিন হতে পারে এবং তা করতে গেলে দেশটির মধ্যপন্থী ও কট্টর গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হতে পারে।

ফলে দেশটির মানবিক সংকটের সমাধানের পথ খুঁজতে হলে অর্থনীতির পুনর্গঠনের পাশাপাশি নারীসহ সব নাগরিকের সমান মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। সেটা করতে না চাইলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাওয়া তালেবানের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি আদায় ও তা পূরণে তালেবান সরকারকে চাপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • ক্রিস ফিটজেরাল্ড মেলবোর্নভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, যিনি রাজনীতি, মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনের ওপর বেশ কয়েকটি অনলাইন প্রকাশনার জন্য নিয়মিত লেখেন