ফিলিপাইনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার সম্পর্ক গভীরতর করার প্রয়াসে গত সপ্তাহে দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তিটিকে ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে (ইন্দো–প্যাসিফিক) চীনের সামরিক সম্প্রসারণবাদ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের বাধাদানের একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ বলা যেতে পারে।
দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় জোট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাফল্য থাকলেও এ মুহূর্তে এই অঞ্চলে বেইজিংয়ের প্রভাব বিস্তার নিয়ে অন্য দেশগুলোর মধ্যে যে উদ্বেগ ও চিন্তা আছে, তা প্রশমনে বাইডেনকে আরও বেশি কিছু করতে হবে।
ঐতিহ্যগতভাবেই যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত কোনো জোট গড়েনি—এমন ছোট দেশগুলোর অনেক নাগরিক এই দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে চিড়ে–চ্যাপটা হওয়ার আশঙ্কা করছেন এবং সম্ভবত তাঁরা চান তাঁদের সরকারগুলো কোনো পক্ষের সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধুক। কারণ, প্রশান্ত মহাসাগরের দখল নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান প্রতিযোগিতা তাদের কাছে শীতল যুদ্ধের সময়কার অস্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে।
দক্ষিণ চীন সাগরের বেশির ভাগ এলাকায় চীন এমন রূঢ় ও অত্যুগ্রভাবে নিজের সার্বভৌমত্ব দাবি করে থাকে, যা তার প্রতিবেশীদের কোণঠাসা করে ফেলে। এটি গোটা অঞ্চলে নৌচলাচলের স্বাধীনতা, বিতর্কিত দ্বীপের মালিকানা ও জ্বালানি সংস্থান নিয়ে দ্বন্দ্ব উসকে দিয়েছে। তাইওয়ানকে চীনের নিরবচ্ছিন্ন ভীতিপ্রদর্শন, বেইজিংয়ের দ্রুত বিশাল সামরিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, মহামারি মোকাবিলায় অন্য দেশগুলোকে যথার্থ সহযোগিতা না দেওয়া এবং রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধকে সমর্থন দেওয়া চীনের অহংকারী ও আধিপত্যবাদী আচরণকে খোলাসা করেছে।
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং প্রায়ই সরল–সোজা ভাষায় বলে থাকেন, চীনের শুধু চাওয়া এমন একটি স্থিতিশীল ও উন্নত বহুমুখী বিশ্ব, যেখানে দেশগুলো বাইরের কারও হুমকি–ধমকির তোয়াক্কা না করে নিজ নিজ নিয়মকানুন অনুযায়ী চলবে এবং যে বিশ্ব হবে পশ্চিমাদের বেঁধে দেওয়া সংজ্ঞার ‘সর্বজনীন’ গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধারণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। সি এসব কথা মুখে বললেও বাস্তবে চীন যে আমেরিকাকে সরিয়ে বৈশ্বিক নেতৃত্বের জায়গায় নিজেকে বসানোর তালে আছে, তা অনেকটাই স্পষ্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা এই গোটা অঞ্চলে অবরুদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত করতে চান। সেই সূত্রেই গত এপ্রিলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ভিয়েতনামের নেতাদের উষ্ণ অভিবাদন জানিয়েছেন। এ মাসেই বাইডেন হিরোশিমায় জি-৭ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পর কোয়াডের বৈঠকে যোগ দিতে অস্ট্রেলিয়া সফর করেন। ভারত ও জাপানকে অন্তর্ভুক্ত করা এই কোয়াড গঠনের মূল উদ্দেশ্যই চীনের প্রভাবের রাশ টেনে ধরা।
পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা ভুল করে সি চিন পিংকে কৌশলগত মাস্টারপ্ল্যানের দিক থেকে বিশাল প্রতিভাধর নেতা বলে অভিহিত করে থাকেন। আদতে সে ধরনের প্রতিভা তাঁর মধ্যে নেই। মাও সে–তুংয়ের মতো তিনি বড় প্রতিভা নন। এ কারণেই তিনি বড় ধরনের ভুল করতে থাকেন। তাঁর নীতিগুলো বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণকে প্রসারিত করে দেশটির সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় অদূরদর্শী লকডাউন এবং আবাসন বাজারের ঋণসংকটও ছিল তাঁর নিজের হাতের বানানো সংকট।
সর্বোপরি সি একজন সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ, যিনি সব সময় নিজের ক্ষমতার ওপর দৃষ্টি মেলে রাখেন। তিনি সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ‘সিকিউরিটাইজেশন’ বা ‘সুরক্ষাবাদ’ বলে যে নতুন কথাটি বারবার বলে থাকেন, সেটি আসলে তাঁর নিজের এবং দলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী আধিপত্য ধরে রাখার বিষয়ে জোর দিতে গিয়ে বলে থাকেন।
সির আক্রমণাত্মক কূটনীতি তাঁর বড় ভুলগুলোর একটি। বিশ্বকে চীনের ‘যুদ্ধংদেহী’ ভাব দেখানোর জন্য তাঁর নির্দেশমতো চীনা কূটনীতিকেরা কখনো মৌখিকভাবে, এমনকি কখনোবা শারীরিকভাবে আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, যা চীনের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতি করেছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা দুর্বল হয়ে পড়া, বাণিজ্য উত্তেজনা এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন সি গত শরৎ মৌসুমে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করার পর নিজের কূটনীতিকদের চড়া গলাকে আগের চেয়ে খানিকটা নমনীয় করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তা সত্ত্বেও সির নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং আক্রমণাত্মক কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। ম্যানিলায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত তাইওয়ানে কর্মরত ফিলিপিনো কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে দৃশ্যত যে হুমকি দিয়েছেন, তাকে সেই আক্রমণাত্মক নীতির অংশ বলেই ভাবা হচ্ছে। গত সপ্তাহে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মারকোস যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে চুক্তি করেছেন, তার বলে যুক্তরাষ্ট্র এখন ফিলিপাইনে চারটি সামরিক ঘাঁটি গড়তে পারবে। এটি চীনের ক্ষোভকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
মারকোস আসলে ‘মারামারিতে লিপ্ত দুই শিশু’র সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য করতে চান। সেই সুবাদে গত জানুয়ারিতে মারকোস বেইজিং সফর করেছেন। ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর এবং অন্যান্য প্রতিবেশীর মতো ফিলিপাইনও চীনের আধিপত্যের ভয়ে থাকে। এ অঞ্চলে দল ভারী করতে দুই পরাশক্তি ছোট ছোট দেশগুলোকে টানছে। এতে এই দেশগুলো সংকটে পড়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা এই গোটা অঞ্চলে অবরুদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত করতে চান। সেই সূত্রেই গত এপ্রিলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ভিয়েতনামের নেতাদের উষ্ণ অভিবাদন জানিয়েছেন। এ মাসেই বাইডেন হিরোশিমায় জি-৭ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পর কোয়াডের বৈঠকে যোগ দিতে অস্ট্রেলিয়া সফর করেন। ভারত ও জাপানকে অন্তর্ভুক্ত করা এই কোয়াড গঠনের মূল উদ্দেশ্যই চীনের প্রভাবের রাশ টেনে ধরা।
চীনও বলছে, এই অঞ্চলে তারা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে চায়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলো এক পরাশক্তির পক্ষ নিয়ে অপর পরাশক্তির রোষানলে পড়তে চায় না।
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
সিমোন টিসডাল দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার বিদেশবিষয়ক সম্পাদক