অনেকটা অসুস্থ শরীর নিয়ে গত শনিবার আওয়ামী লীগের ২২তম সম্মেলনে গিয়েছিলাম। এর আগেও বিভিন্ন দলের সম্মেলনে গিয়েছি। অন্যের মুখে ঝাল না খেয়ে নিজেই সরেজমিন দেখে ও কথা বলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মনোভাব জানার চেষ্টা করেছি। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
আমন্ত্রণপত্রে বলা হয়েছিল, সকাল ১০টার মধ্যে সম্মেলনস্থলে হাজির হতে হবে। পৌনে ১০টায় মৎস্য ভবনের মোড়ে গিয়ে দেখি রাস্তা বন্ধ। বাকিটা পথ হেঁটেই যেতে হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব দিকের গেট দিয়ে ঢুকতে হবে। কিন্তু গেট তখন বন্ধ হয়ে গেছে।
গেটের একেবারে সামনে দেখলাম একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা গেট খুলছেন না। বাইরে ও ভেতরে তখন নেতা-কর্মীদের দীর্ঘ সারি। কয়েক মিনিট পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এলে পুলিশ গেট খুলে দিল, সেই সুযোগে আমরাও ভেতরে ঢুকলাম।
গেট থেকে সম্মেলনস্থলে হেঁটে যেতে ১০টা বেজে যায়। দ্বিতীয় ধাপের রক্ষীরা বললেন, অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় এখন কেউ যেতে পারবেন না। আপনারা পেছনে ডেলিগেটদের জন্য নির্ধারিত স্থানে চলে যান। আমার সঙ্গে দুই সম্পাদক ছিলেন। তঁারা বিষয়টি কোনোভাবে মানতে পারছিলেন না। আমি সুবোধ বালকের মতো পেছনে সারিতে গিয়ে বসলাম। ফলে ভিভিআইপিদের সঙ্গে দেখা না হলেও তৃণমূল থেকে আসা ডেলিগেট ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলে তঁাদের মনোভাব জানা গেল। ক্ষোভ, মনোবেদনা, আশা।
আওয়ামী লীগের সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছিল বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই। কিন্তু গেটের বিশৃঙ্খলা ও ভেতরের অব্যবস্থাপনা দেখে মনে হলো, নেতারা ফটোসেশনে যতটা ব্যস্ত ছিলেন, সম্মেলন সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে ততটাই আগ্রহী ছিলেন না। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হতেই ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘আমাদের যদি ভেতরেই ঢুকতে না দেবে, তাহলে অতিথি কার্ড দেওয়া হলো কেন?’ অনেক অতিথি ভেতরে ঢুকতে না পেরে চলে গেছেন। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক উপাচার্য রাগে-ক্ষোভে তাঁর আমন্ত্রণপত্রটি ছিঁড়ে ফেলেছেন। ওই শিক্ষক আরও বললেন, আমরা দলের সমর্থক বলে কিছু বলতে পারি না; আপনারা লিখুন।
আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলীয় ঐক্য ও শান্তির আওয়াজ যত তীব্র হোক না কেন, রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের কোনো ইঙ্গিত নেই। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) মোহাম্মদ আবু হেনা সম্প্রতি বলেছেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে সেটা অর্থহীন হবে। আওয়ামী লীগকে কেবল নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলে হবে না, গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে।
ইতিমধ্যে মঞ্চ থেকে ঘোষণা এল, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঞ্চে এসে উপস্থিত হয়েছেন। বাইরে থেকে আসা নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। তাঁরা দূর থেকে নেত্রীকে একবার দেখার চেষ্টা করলেন। যদিও সম্মেলনস্থলের মোড়ে মোড়ে বড় টিভি স্ক্রিন বসানো ছিল, যাতে দূর থেকেও নেতা-নেত্রীদের ছবি দেখা যায়।
সম্মেলনস্থলেই চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, জামালপুর, টাঙ্গাইল, বরিশাল ও ঢাকার বেশ কয়েকজন ডেলিগেট ও কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা হলো। নিজ নিজ এলাকার সম্মেলনের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। তাঁরা বললেন, জেলা সম্মেলনে হাজিরা দেওয়া ছাড়া তাদের কিছু করণীয় ছিল না। কেননা নেতৃত্ব বাছাই হয় ওপর থেকে। উপজেলা, জেলা কিংবা মহানগর—কোনো স্তরেই নির্বাচন হয়নি। কেন্দ্র থেকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
জামালপুরের জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে দল থেকে অব্যাহতি পাওয়া ডা. মুরাদ হাসানের দলে ফেরাকে তিনি কীভাবে দেখছেন। তিনি বললেন, ‘যাঁর জন্য দলের বদনাম হয়েছে, তাঁকে আবার দলে নেওয়া উচিত নয়।’ তৃণমূলের এই মনোভাব কি কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে পৌঁছাবে? পৌঁছালেও তাঁরা ভোটের হিসাবনিকাশের কথা বলবেন।
এ ধরনের বড় আয়োজনে যা হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগের সম্মেলনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নেতা-নেত্রীরা বক্তৃতা দিচ্ছেন, আর পেছনের সারিতে বসা দলীয় ডেলিগেটরা খোশগল্প করছেন। বক্তৃতার প্রতি তঁাদের তেমন নজর নেই। তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মী সম্মেলন উপলক্ষে দেওয়া ব্যাগ ও খাবার না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন।
এর মধ্যে দেখলাম এক সাংবাদিক বন্ধু গলায় ডেলিগেট কার্ড ঝুলিয়ে মাঠে ঘুরছেন। জিজ্ঞেস করার আগেই বললেন, বিকেলের কর্ম অধিবেশনে ঢুকতে হবে। সাংবাদিক কার্ড নিয়ে তো ঢুকতে দেবে না।
তাই ডেলিগেট কার্ড নিয়েছি। কিন্তু আওয়ামী লীগের কর্ম অধিবেশনে নেতৃত্বের পছন্দ নয়, এমন কোনো কথা কেউ বলেননি। কেবল একজন ডেলিগেট বলেছেন, অনেক কর্মী আওয়ামী লীগ করতে গিয়ে সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। আবার অনেকে আখের গুছিয়েছেন।
এই আখের গোছানো নেতাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘কাউয়া’ ও ‘হাইব্রিড’ বলে উপহাস করেছিলেন। কিন্তু কাউকে বাদ দিয়েছেন বলে জানা যায় না।
বরং সম্মেলনের আগমুহূর্তে দেখলাম, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে যঁারা বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তঁাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ ক্ষমার বাইরেও কেউ কেউ আছেন। ফরিদপুর আওয়ামী লীগের একসময়ের মহাপ্রতাপশালী নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কথা বলা যায়। অনেক আগেই তিনি মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন।
এবারে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যপদ থেকেও বাদ পড়লেন। একটি পত্রিকায় দেখলাম, তিনি অবসর নিয়েছেন। এই অবসর কি স্বেচ্ছায় নাকি বাধ্য হয়ে? ২০২০ সালের ৭ জুন পুলিশ তাঁর বাড়িতে অভিযান চালায় ও সহযোগীদের গ্রেপ্তার করে। এখন তাঁরা কেউ আওয়ামী লীগে নেই। কিন্তু তঁারা যে ক্ষত তৈরি করেছেন, সেটি সারতে অনেক সময় লাগবে। এ রকম ঘটনা শুধু ফরিদপুরে ঘটেনি। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালী আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল একসময় ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ ছিল। এখন দুই পক্ষই ‘যুদ্ধবিরতিতে’ আছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আগামী নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে দলের ঐক্য ও সংহতির ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু দলের ঐক্য ও সংহতি যে এখনো ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সম্মেলনে দলীয় সভানেত্রীর বক্তৃতার প্রতিই সবার আগ্রহ ছিল। তিনি আগামী নির্বাচন, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিয়ে কী নতুন দিকনির্দেশনা দেন, তা–ই ছিল সবার আগ্রহের কেন্দ্রে। কিন্তু দেখা গেল, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে যাওয়ার প্রত্যয় ছাড়া তাঁর ভাষণে নতুন কিছু ছিল না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন না হওয়ার পক্ষে বড় যুক্তি হলো আগামী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা।
কিন্তু নির্বাচনটি কীভাবে হবে, সেই নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচন নিয়ে দেশে যে একটা সমস্যা চলছে, সেটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে স্বীকার করতে হবে। অস্বীকারের সংস্কৃতি কী ভয়াবহ বিপদ আনতে পারে, অতীতে আমরা একাধিকবার দেখেছি। আওয়ামী লীগের দাবি, বর্তমান সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। বিএনপি ও এর সহযোগীদের কথা হলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।
আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলীয় ঐক্য ও শান্তির আওয়াজ যত তীব্র হোক না কেন, রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের কোনো ইঙ্গিত নেই। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) মোহাম্মদ আবু হেনা সম্প্রতি বলেছেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে সেটা অর্থহীন হবে। আওয়ামী লীগকে কেবল নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলে হবে না, গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, তঁাদের আমলেই দেশের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান আশাতীতভাবে বেড়েছে। তাহলে আওয়ামী লীগ একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে ভয় পাবে? কেন সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন করার চ্যালেঞ্জ নেবে না আওয়ামী লীগ?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com