বিসিএস লিখে গুগলে একটু সার্চ দিলেই চলে আসবে বেশ কিছু লিংক, যেমন বিসিএস সাফল্যের গল্প, স্বপ্নগাথা, এক চান্সেই বাজিমাত, ব্যাকবেঞ্চার হয়েও বিসিএস ক্যাডার, বিসিএস সাফল্যে অভিজ্ঞদের পরামর্শ ইত্যাদি। স্বপ্ন, সাফল্য, বাজিমাত, পরামর্শ—সবকিছু এখন বিসিএস ক্যাডারে গিয়ে ঠেকেছে। অথচ বিসিএস বলে গুগলের কাছে হয়তো জানতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস) সম্পর্কে। গুগলের আর দোষ কী! গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে সে–ও যে বাজিমাতের বিসিএসকেই ওপরে রাখবে।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন ২৬টি ক্যাডার পদের জন্য তিন স্তরবিশিষ্ট বিসিএস পরীক্ষা পরিচালনা করে থাকে। নৈর্ব্যক্তিকমূলক প্রশ্নে ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। সেখানে কৃতকার্যদের জন্য দ্বিতীয় স্তরে ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষায় কৃতকার্যদের জন্য ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা। অতএব শুধু ইতালির মুদ্রার নাম মুখস্থ করে বিসিএস পাস করে ফেলা যায় না।
৪০তম বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে আবেদন পড়ে চার লাখের কিছু বেশি। সব পরীক্ষা শেষে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন ১ হাজার ৯৬৩ জন। গড়ে প্রতি ২১০ আবেদনকারীর মধ্যে মাত্র ১ জন সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। বয়সের দিক বিবেচনায় নিলে, ৪০তম বিসিএসে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্তদের ১৬ শতাংশের বয়স ২৯ বছরের বেশি এবং ৩৯ শতাংশ সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীর বয়স ২৫ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। সাম্প্রতিক ৪৫তম বিসিএসে ২ হাজার ৩০৯ পদের বিপরীতে আবেদন জমা পড়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ।
বর্তমানে প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের অনেকেই তাঁদের জন্য নির্ধারিত কারিগরি পেশার ক্যাডার ছেড়ে প্রশাসন, পুলিশ বা পররাষ্ট্র ক্যাডারের চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। অনেকেই বলছেন, বিশেষ পেশার জনবল তৈরি করতে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়, তারা যদি সে পেশায় থাকবেনই না, তাহলে সে বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে কী লাভটা হচ্ছে! প্রশ্নটি অযৌক্তিক নয়। তবে উত্তরটিও সহজ নয়।
এখানে একটি জিনিস পরিষ্কার করা খুব জরুরি, বিসিএস ক্যাডার বা বিশেষ বিশেষ ক্যাডাররা কেন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, প্রশ্ন কিন্তু সেটি নয়; মেধার প্রতিযোগিতায় এত এত প্রার্থীর মধ্যে কৃতকার্য হয়ে তাঁরা বিশেষ অবস্থান পাবেন, সেটিই বরং স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে, অন্যান্য পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে বা ধরে রাখতে সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি আছে কি না, তাঁদের জন্য উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা যাচ্ছে কি না, সামাজিকভাবে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরায় কার্পণ্য আছে কি না, সে জিনিসগুলো খতিয়ে দেখা।
একটি চাকরি মানে শুধু ৯টা-৫টার অফিস করা আর মাস শেষে বেতন পাওয়া নয়। একটি চাকরি বা একটি ক্যারিয়ারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সামাজিক স্বীকৃতি, সম্মান, অবস্থান। জড়িয়ে আছে সে চাকরির নিরাপত্তা, অবসরোত্তর বাস্তবতা, পদে পদে নিগৃহীত না হওয়ার নিশ্চয়তা। ফলে একটি পেশা মানে শুধু বেতন নয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেখানে আরও কিছু হিসাব–নিকাশ যুক্ত হয়ে পড়েছে। যদি বলা হয়, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি–ঘোড়ায় চড়ে সে’, পড়াশোনার শেষে এ প্রজন্ম সে প্রত্যাশিত গাড়ি-ঘোড়ার কৈফিয়ত চাইবে।
এ প্রজন্ম দেখে, কোন পেশার মানুষকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুমতি নিচ্ছে আর কোন পেশার মানুষকে গলির মোড় থেকে গ্রেপ্তার করে ফেলছে। তারা দেখে, কোন পেশার মানুষ নিয়োগ পেলে সব সমাজ ফুলের তোড়া হাতে দৌড়ে আসে, ফেসবুক ভরিয়ে ফেলে সেলফি দিয়ে। আরও দেখে, মঞ্চের কোন আসনটি কোন পেশার মানুষের জন্য বরাদ্দ।
সবচেয়ে বড় কথা, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এ বয়সে অনেকেরই দেখার সুযোগ হয় না, সারা পৃথিবী কীভাবে চলছে। দেখার সুযোগ হয় না, গোটা পৃথিবীতে যে বিজ্ঞানীর সম্মান আছে, প্রকৌশলীর স্বস্তি আছে, উদ্ভাবকের কদর আছে, চিকিৎসকের সমাদর আছে, উদ্যোক্তাদের খ্যাতি আছে। তারা শুধু দেখেতে পাচ্ছে, একই মেধা, একই যোগ্যতা, ক্ষেত্রবিশেষে বেশি যোগ্যতা নিয়েও অন্যরা শুধু একটি পাবলিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে, বিশেষ কিছু ক্যাডারে সুযোগ পেয়ে, সামাজিক স্তরবিন্যাসের উঁচুতে অবস্থান করছে। যদিও এ মনোভাব পোষণ সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়, এটি ব্যক্তিনির্ভর।
কিন্তু যদি সে মনোভাব পোষণ করে থাকে, তাহলে কিসের ঘাটতি আছে মেধাবী এই প্রকৌশলী, চিকিৎসক বা উদ্ভাবকের? একটা পরীক্ষাই তো? জীবনের প্রতিটি ধাপে এ রকম কত কত পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েই তো তাঁরা প্রকৌশলী হয়েছেন, চিকিৎসক হয়েছেন? সেখানে আরও একটি বেশি পরীক্ষা আর এমন কী! ৪০তম বিসিএসে শুধু প্রশাসন ক্যাডারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ৫০ জন স্নাতক। অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদেরও আছেন অনেকেই।
এটি অত্যন্ত আনন্দের বিষয়, দেশের মেধাবীরা বিসিএসের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। বিসিএস ক্যাডাররা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হবেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মেধাবীদের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এখানে একটি জিনিস পরিষ্কার করা খুব জরুরি, বিসিএস ক্যাডার বা বিশেষ বিশেষ ক্যাডাররা কেন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, প্রশ্ন কিন্তু সেটি নয়; মেধার প্রতিযোগিতায় এত এত প্রার্থীর মধ্যে কৃতকার্য হয়ে তাঁরা বিশেষ অবস্থান পাবেন, সেটিই বরং স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে, অন্যান্য পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে বা ধরে রাখতে সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি আছে কি না, তাঁদের জন্য উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা যাচ্ছে কি না, সামাজিকভাবে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরায় কার্পণ্য আছে কি না, সে জিনিসগুলো খতিয়ে দেখা।
একজন উদ্ভাবক, একজন গবেষক, একজন বিজ্ঞানী একটা দেশ পরিবর্তন করে ফেলতে পারেন। সব পেশার মানুষের জন্য সাম্যাবস্থার একটি সমাজ তৈরি করা জরুরি। তা না হলে আগামীর পৃথিবীতে এগিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়বে; আরও দীর্ঘ হয়ে পড়বে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে গ্রন্থাগারের গেটে শিক্ষার্থীদের প্রবেশসারি।
একা একা খুব বেশি উঁচুতে ওঠা যায় না। ওপরে ওঠার জন্য যে মজবুত সিঁড়ি প্রয়োজন, তার দক্ষ প্রকৌশলী যদি প্রশাসক হয়ে বসে থাকেন, তখন অর্বাচীনের বানানো নড়বড়ে সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে তো পড়তেই হবে। হোঁচট খেয়ে পড়া যাবে, কিন্তু চিকিৎসা সেবাটা পাওয়া যাবে না; ডাক্তার মশাইও যে পুলিশ হয়ে বসে আছেন।
ড. বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই–মেইল: bmmainul@du.ac.bd