মতামত

স্কুলশিক্ষার সংস্কার কি পথ হারিয়েছে

বিদ্যালয়শিক্ষা—প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক—শিক্ষাব্যবস্থার ভিত। এই ভিত শক্ত না হলে শিক্ষা ভেঙে পড়ে, এর সুফল পাওয়া যায় না। বিদ্যালয়শিক্ষা হতে হবে সব শিশুকে সমান সুযোগ দিয়ে গ্রহণযোগ্য মানের। তবে মান, সমতা ও অন্তর্ভুক্তি এসব ক্ষেত্রেই আছে বহু সমস্যা। সম্প্রতি শিক্ষাক্রম, পাঠক্রম ও পাঠদান সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগের পরিধি, লক্ষ্য ও কৌশল কি যথার্থ? এ–সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া নিয়েও আছে প্রশ্ন। নতুন উদ্যোগ আরেক ব্যর্থ সংস্কারের তালিকায় যুক্ত না হোক তা-ই কাম্য।

উচ্চমাধ্যমিক প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়ার অভিযোগ, সুপরিচিত সাহিত্যিক সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য, পরীক্ষার হলে ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণ ইত্যাদি কাণ্ড সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যোগ্যতা ও দায়িত্বশীলতা আলোচিত বিষয়ে পরিণত করেছে।

অন্যদিকে পত্রিকান্তরে খবরের শিরোনাম ‘নতুন শিক্ষাক্রমেও পরীক্ষানির্ভরতা হবে সব বিষয়েই’। (জনকণ্ঠ, ১৭ নভেম্বর ২০২২)। তাই সংস্কার বাস্তবায়নে একাগ্রতা ও সক্ষমতা এবং সংস্কার কোন পথে, সেসব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

২০১৭ সালে সেই সময়ের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের আগ্রহে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিছু শিক্ষাবিদ এবং বিদ্যালয়শিক্ষায় সংশ্লিষ্ট প্রবীণ শিক্ষকদের এক বিশেষজ্ঞ দলকে কিছু বহুল আলোচিত সমস্যা নিয়ে ‘দ্রুত পর্যালোচনার’ মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শদানের অনুরোধ করা হয়। পর্যালোচনার বিষয়ের মধ্যে ছিল স্কুলশিক্ষার পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন এবং শ্রেণিকক্ষের কাজকর্মকে কার্যকর সংস্কারের বিষয় চিহ্নিত করে কাজ শুরু করা।

কয়েক সপ্তাহ ধরে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের আমন্ত্রণে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনেকগুলো বৈঠক এবং দলের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ শিক্ষামন্ত্রীর জন্য সুপারিশ তৈরি করা হয়। খসড়া সুপারিশ নিয়ে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে বিভিন্ন বিষয়ের নির্বাচিত বিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়।

শিক্ষাবিদদের সুপারিশ ছিল আশু করণীয় ও দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। আশু সিদ্ধান্তের বিষয় ছিল পাবলিক পরীক্ষাসংক্রান্ত। প্রাথমিক সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা প্রধান দক্ষতার বিষয় যথাক্রমে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সমাজ পাঠে সীমাবদ্ধ রাখতে বলা হয়। অন্য সব বিষয়ের মূল্যায়ন বিদ্যালয়ের দায়িত্বে রেখে এসব বিষয়ের চর্চা ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন পাঠদানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়। পাবলিক পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে একটি পরীক্ষা নমুনা জরিপের আদলে বিষয়বস্তুর জ্ঞান পরিমাপ করা হবে। তাতে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষা শেষ করা সম্ভব হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া ও পদ্ধতি এমন যে এসব ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে অগ্রগতি হয়নি। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে ২০১৯ সালে। সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কয়েক দফা রদবদল হয়েছে। সংস্কারের উদ্যোগ হারিয়ে যায়। যে প্রতিবেদন শিক্ষামন্ত্রীর হাতে দেওয়া হয়েছিল, তা হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

গাইড বই, নোট বই মুখস্থ করা, কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট শিক্ষকনির্ভরতা এবং এ জন্য ক্লাসের বাইরে বা ক্লাস বাদ দিয়ে দীর্ঘ সময় ব্যয়ের সমস্যা উঠে আসে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ দলের বক্তব্য—এসবই রোগের লক্ষণ, আসল রোগ বর্তমান পরীক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষকের যোগ্যতা-দক্ষতা, অভিভাবকদের মানসিকতা এবং শিক্ষার ব্যবস্থাপনা। তা ছাড়া পাবলিক পরীক্ষায় প্রকৃত দক্ষতা-পরিমাপক প্রশ্নপত্র তৈরি–মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ দ্বারা হওয়া উচিত।

এ জন্য ধারাবাহিক নিরীক্ষা ও গবেষণা প্রয়োজন। ‘সৃজনশীল’ প্রশ্ন শিক্ষকেরা তৈরি করতে পারেন না, এই অভিযোগ অর্থহীন। অন্তত পাবলিক পরীক্ষার জন্য এ ধরনের প্রশ্নপত্র তৈরির যথার্থ কারিগরি ও পেশাগত দক্ষতা থাকতে হবে। এসব ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিশেষজ্ঞ সক্ষমতা তৈরি করায় মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। ধারাবাহিক বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়নের জন্য শিক্ষকদের তৈরি করা ও বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরিবেশ ও সক্ষমতা নির্মাণ করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক সংস্কারের যে কাজ শুরু হওয়ার কথা, তার অংশ হিসেবে এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া ও পদ্ধতি এমন যে এসব ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে অগ্রগতি হয়নি। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে ২০১৯ সালে। সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কয়েক দফা রদবদল হয়েছে। সংস্কারের উদ্যোগ হারিয়ে যায়। যে প্রতিবেদন শিক্ষামন্ত্রীর হাতে দেওয়া হয়েছিল, তা হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ইতিমধ্যে কোভিড মহামারির কারণে আপত্কালীন ব্যবস্থা হিসেবে প্রাথমিক সমাপনী ও নিম্নমাধ্যমিক পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা সীমিত করা হয়। এসব কোনোটিই সংস্কারের অংশ হিসেবে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত ছিল না। কোভিডের কারণে দুই বছরের বেশি স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা যে পিছিয়ে পড়ল, সে ব্যাপারটি একেবারেই আমলে না নিয়ে কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক রুটিনে ফিরে যাওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হলো।

২০১৯ সাল থেকে শিক্ষাক্রম-পাঠক্রম-পাঠ্যপুস্তকের নবায়নের কাজের সূচনা কোভিডের কারণে বিলম্বিত হয়। ২০২২ সালে স্বল্প পরিসরে নতুন পাঠক্রম ও পাঠ্যবইয়ের পাইলটিং শুরু হয়েছে। এ–সংক্রান্ত আলোচনায় জানানো হয়েছিল, মূল্যায়ন সংস্কার ও বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়ন বিবেচনায় থাকবে।

কিন্তু সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, শিক্ষকদের ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবির মুখে সংস্কারের পথে না গিয়ে পূবর্তন ব্যবস্থা বজায় রাখা হবে। অর্থাৎ আগের মতো সব বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা থাকবে। বিদ্যালয়ে ও শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা-শিখনে কোনো পরিবর্তন আনবে কি না, তা-ও বলা যাচ্ছে না। ২০১৭ সালেও শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন সংস্কারে আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞ দলের সুপারিশ ছিল, সংস্কার দুরূহ হলেও এদিকেই এগোতে হবে। তা না হলে একই আবর্তে আমরা আবদ্ধ থাকব। তবে শিক্ষক, বিদ্যালয় ও অভিভাবকদের সংস্কারপ্রক্রিয়ার অংশীদার বানাতে হবে। এ জন্য সুপরিকল্পিত ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা ও বিশেষজ্ঞ সক্ষমতা তৈরি করতে হবে এবং তা কাজে লাগাতে হবে। শিক্ষার বিপর্যয় এড়ানোর অন্য কোনো উপায় নেই।

বাস্তবতা নিরীক্ষণ করে মহামারিজনিত শিক্ষা-ক্ষতি কাটিয়ে শিক্ষা পুনরুদ্ধারে এখন অধিকতর উদ্যম প্রয়োজন। শিক্ষাক্রমের যথার্থ ও কার্যকর নবায়নের জন্যই তা জরুরি। শিক্ষক সমাবেশে মতামত সংগ্রহ করে মন্ত্রী বা সচিবের জনতোষণমূলক তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শিক্ষা সংস্কার হয় না। যতই তাঁদের সদিচ্ছা থাকুক।

শিক্ষকের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়া শিক্ষার্থী মূল্যায়নে চলমান পদ্ধতির পরিবর্তন করতে অভিনব সব প্রক্রিয়া একসঙ্গে চালু করলে জটিল সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

  • ড. মনজুর আহমদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। বাংলাদেশ ইসিডি নেটওয়ার্কের সভাপতি ও গণসাক্ষরতা অভিযানের সহসভাপতি