ট্রাম্পের বিচার যুক্তরাষ্ট্রে বিভক্তি বাড়াবে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আইন লঙ্ঘন করে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠার পর ১৯৭৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ টিভি উপস্থাপক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ বিষয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় স্বার্থে কোনো বেআইনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে নিক্সন বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট যখন এটি করেন, তখন তা আর বেআইনি থাকে না।’ ডেভিড ফ্রস্ট তখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এটা কি আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞার মধ্যে পড়বে?’ নিক্সনের জবাব ছিল, ‘অবশ্যই’।

এটি ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া কিছু ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এসব বলেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে নিক্সনের প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালনের খুঁত ধরা পড়ে। তাঁর সেই বক্তব্য এটিও ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করেছিল যে কীভাবে তিনি আমেরিকান গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রকে বৈধ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন।

আফসোস! নিক্সনের কোনো বিচার হয়নি। গদি থেকে সরে যাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে চলা একটি ফৌজদারি তদন্ত প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রম করার আগেই প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড (যিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে নিক্সনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন) তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

মূলধারার আলোচনায় জেরাল্ড ফোর্ডের সেই সিদ্ধান্তটিকে এখনো একটি ন্যায়সংগত, এমনকি সাহসী অবস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মার্কিন রাজনীতিকেরা মনে করেন, জেরাল্ডের এই ক্ষমা যুক্তরাষ্ট্রকে তাঁর নিজের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করার মতো বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাঁচিয়েছিল।

কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুত ধারাবাহিকভাবে চার চারটি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে রীতিমতো ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন। লক্ষ করার বিষয় হলো, এই চার অভিযোগের একটিও প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক দায়িত্বের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়।

বামপন্থীরা তাঁর কঠোর বিচারের পক্ষে থাকলেও ইতিমধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়া মার্কিন সমাজে ট্রাম্পের এই বিচার অনেক প্রভাব ফেলবে। এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের যে জনসমর্থন দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে তাঁর বিচারে কাজ বিভক্তিকে আরও গভীর করবে। এতে ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হবে, তা মার্কিন রাজনীতির ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।

মার্কিন কিংবা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে কোনোখানে ড্রোন হামলা চালানোর নির্দেশ দেওয়ায় তাঁর বিচার হচ্ছে না। কোথাও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সাধারণ মানুষকে দুর্দশায় ফেলে দেওয়ার জন্য তাঁর বিচার হচ্ছে না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কুৎসিত আলাপচারিতার জন্যও (যে কারণে তাঁর অভিশংসন করা হয়েছিল) তাঁকে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। বরং ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলকে নস্যাৎ করার চেষ্টা, গোপন নথি সরানো এবং নির্বাচনী প্রচারণা বিধি লঙ্ঘন করে এক নারীকে উৎকোচ দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিচার হচ্ছে।

একজন সাবেক নেতাকে আইনের আওতায় আনা আপাতত কূটনৈতিকভাবে আমেরিকার জন্য বিব্রতকর হতে পারে। তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রকে আইনের শাসনের প্রতি ন্যায়নিষ্ঠ ও নিবেদিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এই বিচার করতে যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হলে সেটি তাৎক্ষণিক মেয়াদে মার্কিনিদের মুখরক্ষা করবে বটে; কিন্তু প্রজাতন্ত্রের ভাবমূর্তির জন্য একটি ধ্বংসাত্মক আঘাতের প্রতিনিধিত্ব করবে।

বিশ্বজুড়ে কার্যকর গণতন্ত্রগুলো প্রায়ই তাদের সাবেক নেতাদের এবং এমনকি গদিতে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করে। অবশ্য তাঁদের মধ্যে খুব কম লোকই জেল খেটেছে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় তাঁদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে তাদের ক্ষমা করা হয় এবং কেউ কেউ কম শাস্তি পান। নিক্সনের মতো তাঁদের গদি থেকে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাঁদের জেলে রাখা অনেক দুরূহ ব্যাপার।

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প এখনো রিপাবলিকান পার্টির অতুলনীয় নেতা এবং দক্ষিণপন্থী অনেকের কাছে ত্রাণকর্তা। ট্রাম্পের সমর্থকদের একটি বড় অংশ মনে করেন, ট্রাম্প যা করেছেন তা একদম ঠিক ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থেই তিনি তা করেছেন।

বামপন্থীরা তাঁর কঠোর বিচারের পক্ষে থাকলেও ইতিমধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়া মার্কিন সমাজে ট্রাম্পের এই বিচার অনেক প্রভাব ফেলবে। এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের যে জনসমর্থন দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে তাঁর বিচারে কাজ বিভক্তিকে আরও গভীর করবে। এতে ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হবে, তা মার্কিন রাজনীতির ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।

 আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

 আলী আহমাদি নিষেধাজ্ঞা এবং অর্থনৈতিক রাষ্ট্রকৌশল বিষয়ের একজন পণ্ডিত