রাজনীতিতে টান টান উত্তেজনা ছিল কয়েক দিন ধরেই। নানা শঙ্কা ও গুঞ্জন ছিল। কী হয় কী হয় একটা পরিস্থিতি এখনো বিরাজ করছে। সবাই ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছিল ও নিচ্ছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সম্ভবত আর অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না। ক্রিকেটে ধৈর্যহারা ব্যাটারদের নানাভাবে বিভ্রান্ত করেন বোলাররা। আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে বিএনপি রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থানের নামে গুগলি ছুড়ে। আদতে এটা ছিল বিএনপির রাজধানী অবরোধের কর্মসূচি।
আওয়ামী লীগও বিএনপির গুগলিতে বিভ্রান্ত হয়ে স্কয়ার ড্রাইভ খেলতে গিয়ে সম্ভবত ধৈর্য বিসর্জন দিল। তাই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই প্রথম আঘাতটা এল। গত শনিবার বিএনপির রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে তাই হামলা ঘটনা ঘটে। পুলিশের সঙ্গে দলের কর্মীরাও ছিলেন সেই হামলায়। বিএনপি পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু শুরুটা আওয়ামী লীগের দিক থেকেই শুরু হলো। সম্ভবত বিএনপির গুগলি আওয়ামী লীগ বুঝতে পারেনি। বিভ্রান্ত হয়ে আওয়ামী লীগ গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমানউল্লাহ আমানকে আপ্যায়ন করে যে বাউন্সার দিল, তাতে আজ সোমবার কর্মসূচি ঘোষণা করে দুর্দান্ত হুক করল বিএনপি। বিএনপি জানিয়েছে, রোববার কর্মসূচি ঘোষণার পরিকল্পনা থাকলেও আওয়ামী লীগ আগেই কর্মসূচি ঘোষণা করায় তারা তাদের কর্মসূচি সোমবারে নিয়ে গেছে।
অথচ এর আগে আওয়ামী লীগ বরাবরই বিএনপির কর্মসূচির দিন পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এমনকি বিএনপির তারিখ পরিবর্তন করে পেছানোর পর আওয়ামী লীগও পরিবর্তন করে একই দিন নিয়ে গেছে। কিন্তু বিএনপি এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে অনুসরণ করেনি।
পক্ষান্তরে বিএনপি কয়েক বছর ধরেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে। নানা উসকানিতেও ফাঁদে পা দেয়নি। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সহিংসতার আশঙ্কা করছিলেন অনেকেই। কিন্তু দেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সারা বিশ্বের দৃষ্টি বাংলাদেশের ওপর নিবদ্ধ থাকায় কেউই ধৈর্যের সীমা লঙ্ঘন করতে চায়নি। এ ক্ষেত্রে বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল।
আপাতত শনিবারের ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর খাতায় কিছু নেতিবাচক পয়েন্ট যুক্ত হলো। এই পরিস্থিতি বরং বিএনপিকে নিজেদের নির্যাতিত ও নিপীড়িত হিসেবে উপস্থাপিত করার সুযোগ করে দেবে। রাজনীতিতে কোনো ধরনের সহিংসতাই কাম্য নয়। কিন্তু বিএনপি এখন পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলেও তার দায় বর্তাবে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ওপর। কারণ, বিএনপি তার বিভিন্ন কর্মসূচিকে এখন আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ বলে প্রচার করবে। এমন একটি পরিস্থিতি কিন্তু বিএনপির জন্য আওয়ামী লীগই তৈরি করে দিল।
বিরোধী অবস্থানে থেকে লাগাতার বড় বড় সমাবেশ করছিল। গত শুক্রবারও তারা ঢাকায় বড় জমায়েত করেছে। জমায়েত থেকে বিএনপি ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। বিএনপির দিক থেকে বারবার বলা হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে তারা কর্মসূচি পালন করবে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও পুলিশ ধৈর্য ধরে রাখতে পারল না। বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে একযোগে হামলা করল তারা। কয়েকজনকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কর্মীদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়িয়েছে দিনভর। পুরান ঢাকার নয়াবাজারে হামলার সঙ্গে সঙ্গেই ভিডিও ফুটেজ ত্বরিত গতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
নয়াবাজারে বিএনপির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে পিটিয়ে আহত করেছে পুলিশ। ওই সময় গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দলীয় নেতা-কর্মীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি হাত দিয়ে কর্মীদের আটকে রাখছিলেন যেন কোনো ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। কিন্তু পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্য করে ঢিল ছুড়ছিল। একপর্যায়ে হামলাও করে। পরবর্তী সময় বিএনপির নেতা-কর্মীরা এর উত্তর দিয়েছেন পাল্টা হামলা করে। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের খবর আমরা পেয়েছি।
বিএনপির সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চলাকালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পুলিশের প্রহরায় লাঠি নিয়ে মিছিল করেছেন। বিএনপির কর্মীদের ধাওয়া খেয়ে ডিবি পুলিশ আওয়ামী লীগ নেতার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কারণ, ধাওয়া খাওয়ার সময় আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী ছিলেন না। এ ছাড়া পুলিশ কাছে থাকার পর মাতুয়াইলে বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। পুলিশ থামাতে বা নেভাতে আসেনি।
শনিবারের ঘটনা কি আওয়ামী লীগ বা পুলিশের জন্য ভালো হলো? কারণ, সারা দিনের ঘটনার প্রমাণাদি বিভিন্ন মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে চলে যাবে। তাঁরা বাংলাদেশের পরিস্থিতির দিকে বিশেষ নজর রাখছে।
এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র র্যাবসহ কয়েকজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। নতুন করে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। দিনভর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংঘর্ষের সংবাদ প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, রয়টার্স, এএফপি, এপি, ভয়েস অব আমেরিকা, আল-জাজিরা, ডয়চে ভেলে সবাই সরকার বিরোধী আন্দোলন নিয়ে সংবাদ প্রচার করেছে।
যদিও পুলিশি হামলা ও পেটানোর পর আওয়ামী লীগ সৌজন্য দেখানোর চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কর্মকর্তারা আমানউল্লাহ আমানকে ফল নিয়ে হাসপাতালে দেখতে যান। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ডিবি অফিসে ধরে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজনের ছবি ও ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। ছবি ও ভিডিও দেখে এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব ছবি ও ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। এটা বরং আওয়ামী লীগের জন্য হিতে বিপরীত হওয়ারই কথা। সকালে পিটিয়ে, হামলা করে দুপুরে খাইয়ে ছবি প্রচারের মধ্যে কোনো সৌজন্যের প্রতিফলন নেই। বরং এর মধ্যে আছে রাজনীতি।
এই রাজনীতি খুব বেশি সুরুচির নিদর্শন না মোটেও। আওয়ামী লীগের মতো অভিজ্ঞ ও পুরোনো দলের কাছে মানুষ আরও পরিপক্বতা আশা করে। এসব ছবি প্রচার করে আলোচনার মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার যে কৌশল আওয়ামী লীগ নিয়েছে তা কাজে দিয়েছে বলে মনে হয় না।
আপাতত শনিবারের ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর খাতায় কিছু নেতিবাচক পয়েন্ট যুক্ত হলো। এই পরিস্থিতি বরং বিএনপিকে নিজেদের নির্যাতিত ও নিপীড়িত হিসেবে উপস্থাপিত করার সুযোগ করে দেবে। রাজনীতিতে কোনো ধরনের সহিংসতাই কাম্য নয়।
কিন্তু বিএনপি এখন পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলেও তার দায় বর্তাবে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ওপর। কারণ, বিএনপি তার বিভিন্ন কর্মসূচিকে এখন আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ বলে প্রচার করবে। এমন একটি পরিস্থিতি কিন্তু বিএনপির জন্য আওয়ামী লীগই তৈরি করে দিল।
ড. মারুফ মল্লিক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক