জুন মাসের ৭ তারিখ, ২০২৪। প্রজ্ঞাপন জারি হলো, তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব হিসেবে একজন সম্পাদককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষুদ্র কলামলেখক তা দেখে তাঁর পত্রিকার বার্তাকক্ষে সহকর্মীদের উদ্দেশে একটা ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেন, ‘হাসিনা সরকারের পতনের আর দেরি নেই।’ সাংবাদিক সহকর্মীরা বললেন, ‘এটা কেন বলছেন?’
‘বলছি, তার কারণ আছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারকে বলেছিলেন, “যদি কোনো বিপদ আসে, প্রথম ফোনটা করবে তোমাদের মোশতাক চাচাকে।” খন্দকার মোশতাক বিদূষক হিসেবে ছিলেন সবচেয়ে এগিয়ে। এমন নয় যে এই নতুন প্রেস সচিব খন্দকার মোশতাকের মতো ষড়যন্ত্র করবেন। কিন্তু তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একটিমাত্র যোগ্যতায়। আর তা হলো, তিনি তোষামোদি করতে পারেন সবচেয়ে বেশি। তার মানে প্রধানমন্ত্রী তোষামোদি ছাড়া অন্য কোনো কিছু গ্রহণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি শুধু তা-ই শোনেন, যা তিনি শুনতে চান। তিনি শুধু তা-ই দেখেন, যা তিনি দেখতে চান। এই অন্ধত্ব ও বধিরতা পতন ডেকে আনে।’
ওই নিয়োগের দুই মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই জনতার বিক্ষোভের প্রবল তরঙ্গ-অভিঘাতে শেখ হাসিনা ও তাঁর ১৫ বছরের শাসনের লৌহদুর্গ খড়কুটোর মতো ভেসে যায় এবং তার উপলক্ষটা হয়, ওই প্রেস সচিব সঞ্চালিত একটা সাংবাদিক সম্মেলনে দুই সাংবাদিকের মোসাহেবি মার্কা দুটো প্রশ্ন।
একেকটা বিদেশ সফর শেষে গণভবনে তখনকার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের নামে যা হতো, তা চরম লজ্জাজনক প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। এই সব দেখা মানে ছিল নির্মল বিনোদন আর চরম উষ্মার উদ্রেক করা।
এই রকম একটা সংবাদ সম্মেলনে কতিপয় সাংবাদিকের তৈলায়নের প্রতিযোগিতা দেখে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম: এই দেশের বিদূষকেরাই এখন শ্রেষ্ঠ (প্রথম আলো ৩১ মার্চ ২০২৩)। তাতে লিখেছিলাম, ‘এঁরা রাজারাজড়াদের তুষ্ট করেন। এটাই তাঁদের নেশা-পেশা এবং অহোরাত্রির সাধনা। কিন্তু অভিধানে এঁদের কেন নিন্দাকারী আর কামুক ও লম্পট বলে চিহ্নিত করল, তা-ও একটু বিশেষভাবে ভাববার বিষয়ও বটে।
‘এঁরা রাজাকে হাসান। একবার রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “গোপাল ভাঁড়, বলো তো, আমার রাজ্যের লোকেরা এই মুহূর্তে কী ভাবছে?” গোপাল ভাঁড় বলল, “এরা সবাই ভাবছে, মহারাজার মঙ্গল হোক!” রাজা একে শুধান, ওকে শুধান, “তুমি কি ভাবছ যে মহারাজার জয় হোক?” সবাই একবাক্যে বলে উঠল, “আজ্ঞে মহারাজ, আমরা তা-ই ভাবছি।”’
সরকার আসবে, সরকার যাবে। কিন্তু গণমাধ্যম থেকে যাবে। যে সরকার গণমাধ্যমে প্রকাশিত সমালোচনা, সরকারের ভুলত্রুটি, জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বিবেচনায় নেবে, প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করবে, সেই সরকার জনপ্রিয় হবে। আর যারা উল্টো গণমাধ্যমের ওপরে চড়াও হবে, তারা হবে গণধিক্কৃত।
শেখ হাসিনা সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলতেন, ‘আপনারা খবরের কাগজ কেন পড়েন? খবরের কাগজ পড়বেন না। আমি তো খবরের কাগজ পড়ি না।’ [পড়তে পারেন বাংলা ট্রিবিউনের খবর: কিছু পত্রিকা একদিন ভালো লিখলে ৭ দিন লেখে খারাপ: প্রধানমন্ত্রী, ১৭ মে, ২০২২]
একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি দেশের মানুষের অবস্থা জানার জন্য খবরের কাগজের ওপরে নির্ভর না করে তাঁর মোসাহেব ও সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, তাহলে তিনি যে বোকার স্বর্গে থাকবেন, তাতে আর সন্দেহ কী।
১৭৮৬ সালের দিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন বলেছিলেন, ‘একটা দেশে সরকার আছে, সংবাদপত্র নেই, আর একটা দেশে সংবাদপত্র আছে, সরকার নেই, এই দুটোর যেকোনো একটাকে বেছে নিতে হলে আমি দ্বিতীয়টা বেছে নেব।’ অর্থাৎ সংবাদপত্র থাকবে, সরকার না-ও থাকতে পারে।
অথচ আমাদের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন স্বাধীন সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে। একটার পর একটা মামলা দিয়ে সম্পাদক ও সাংবাদিকদের জীবন তছনছ করে দেওয়া হয়েছিল। একই বিষয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে একটার পর একটা মামলা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো, আর তা করা হতো বিশেষ সংস্থার মাধ্যমে। প্রথম আলো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দেওয়ার নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন বেসরকারি বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানে। গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার-এর সাংবাদিকের প্রবেশ ছিল নিষেধ।
একজন সম্পাদক অনেক আগে এক প্রধানমন্ত্রীকে বলে এসেছিলেন, ‘সরকার আসবে, সরকার যাবে। তবে সংবাদমাধ্যম থেকে যাবে। আমাদের ইতিহাস বলে যে সংবাদমাধ্যমের খড়্গহস্ত হয়ে কোনো সরকার শেষ পর্যন্ত টিকতে পারে না।’
এই সব কথা এখন কেন লিখছি? কারণ, আবারও একই কথা, সরকার আসবে, সরকার যাবে। কিন্তু গণমাধ্যম থেকে যাবে। যে সরকার গণমাধ্যমে প্রকাশিত সমালোচনা, সরকারের ভুলত্রুটি, জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বিবেচনায় নেবে, প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করবে, সেই সরকার জনপ্রিয় হবে। আর যারা উল্টো গণমাধ্যমের ওপরে চড়াও হবে, তারা হবে গণধিক্কৃত।
সেই যে অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, যে দেশে গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। কারণ, কোনো অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিলে সংবাদপত্রে তা লেখা হবে। আর সরকারকে যেহেতু ভোটের জন্য জনগণের দরজায় যেতে হবে, কাজেই সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। আগেও লিখেছি, আবারও লিখছি, আমাদের সমস্যা ছিল, কোনো অভাব বা ত্রুটির কথা লিখলে সরকার ব্যবস্থা নিত ওই সমস্যার সমাধানের জন্য নয়, এই সংবাদপত্রের কণ্ঠ চেপে ধরার জন্য। কারণ, ভোটের জন্য জনগণের কাছে যাওয়ার ঝামেলা সরকার দূর করে ফেলেছিল।
গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে কী পরিণতি হতে পারে, তার আরও একটা করুণ উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা হলো। ভবিষ্যতের সরকারগুলো এ থেকে কিছু শিখবে কি না, ভবিষ্যৎই কেবল তা বলতে পারে। তবে সবাইকে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ৪ আগস্ট ২০২৪-এর প্রথম আলোর লেখাটা থেকে একটা অংশ স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
‘একটা আধুনিক রাষ্ট্রে পুলিশ, সীমান্তরক্ষী, সেনাবাহিনী—এমন অনেক কিছুই থাকে। এদের শক্তিও অনেক। কিন্তু এদের চেয়ে শক্তিমান একটা জিনিস থাকে প্রতিটি জাতির জীবনে। তার নাম জনগণ। এর চেয়ে শক্তিমান কেউ নয়।...আমরা যেন না ভুলি যে স্বৈরাচারীরা ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে ধ্বংস হন আর গণতন্ত্রী সবাইকে ভালোবাসা দিয়ে জয়লাভ করেন।’
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক