বিজ্ঞানকে সংবাদমাধ্যমে কীভাবে সহজ করে তোলা যায়

বাংলাদেশে বিজ্ঞান সাংবাদিকতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে গবেষণার খবরগুলো অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিকর শিরোনাম দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়।
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়বস্তু ও গবেষণা একটি বিশেষায়িত ক্ষেত্র। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, কারণ বিজ্ঞান ও গবেষণার বিষয়বস্তু প্রযুক্তির বিকাশ, মানুষের জ্ঞান ও সচেতনতা তৈরি এবং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণীতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে এ সেক্টরে কাজ করা মানুষগুলো সাধারণ মানুষদের সঙ্গে ভাষাগত যোগাযোগে পারদর্শী নন। এ কারণে বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো সহজভাবে সাধারণ মানুষদের কাছে তুলে ধরা তাঁদের কাছে দুরূহ।

আর এ কাজ করার জন্য বিশেষ মাধ্যম বা ব্যক্তির প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা বিশেষ মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারেন, যিনি বিজ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক তথ্য–উপাত্ত সঠিকভাবে সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে পরিবেশন করবেন।

আধুনিক বিজ্ঞান সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে ‘দিগদর্শন’ নামের একটি শিক্ষামূলক মাসিক পত্রিকা ছিল, যা ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর, বাংলা, ভারত থেকে প্রকাশিত হতো। ‘দিগদর্শন’ পদার্থবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদির ওপর নিবন্ধ প্রকাশ করত।

এটি বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় পাওয়া যেত। বর্তমানে বিজ্ঞান সাংবাদিকতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো উইকিলিকসে প্রকাশিত তথ্যাবলি। এ ছাড়া বিশ্বের নামীদামি অনেক পত্রিকা, জার্নাল ও ম্যাগাজিন বিজ্ঞান সাংবাদিকতার প্রয়োগ করে থাকে।

গণমাধ্যমের কাজ সঠিক তথ্য সঠিক সময়ে সঠিকভাবে তুলে ধরা। ভুল বার্তা প্রচারিত হলে জনমনে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক ছড়াতে পারে। আবার বিভ্রান্তিকর শিরোনাম বিজ্ঞান ও গবেষণাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। পারে গবেষক, গবেষণা ও প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করতে। গবেষণার বিষয়বস্তু ও ফলাফল সাংবাদিকেরা সঠিক ও সহজভাবে জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। দেশের মিডিয়াগুলোয় বৈজ্ঞানিক ও বিশেষায়িত সাংবাদিকতায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আবার যাঁরা এসব কাজে নিয়োজিত, তাঁদের সঙ্গে শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের মধ্যে যোগাযোগের ব্যবধান রয়েছে যথেষ্ট। ফলে, আমরা মাঝেমধ্যেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা এবং ভুল বার্তা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাই।

এ ক্ষেত্রে অসতর্কতায় যেমন বিভিন্ন বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে, তেমনি দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা। জনস্বার্থই যেহেতু সাংবাদিকতার মূল বিষয়, তাই সেটা নিশ্চিতে বিজ্ঞানী বা গবেষকের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করে সহজভাবে বিষয়টা বুঝে নেওয়া জরুরি।

কাজটি মোটেই সহজ নয়। কারণ, গবেষণাপত্র ও সংবাদপত্রের ভাষায় বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। সে জন্য সাংবাদিকদের যেমন বিজ্ঞান ও গবেষণার ভাষা সম্পর্কে মৌলিক ধারণা থাকা দরকার, তেমনি গবেষক ও বিজ্ঞানীরও সংবাদমাধ্যমের উপযোগী ভাষা ও ভাষ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা দরকার।

বাংলাদেশে বিজ্ঞান সাংবাদিকতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে গবেষণার খবরগুলো অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিকর শিরোনাম দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়। এটি হয়তো অজ্ঞতার কারণে ঘটে থাকতে পারে। কারণ, বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় যাঁরা আসেন, তাঁদের সাধারণত বিশেষায়িত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থাকে না। বৈজ্ঞানিক বিষয় প্রতিবেদন করা অন্যান্য প্রতিবেদন করা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাই বিজ্ঞান–সাংবাদিক হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োজন।

একদিকে যেমন মিডিয়ার দায় রয়েছে, তেমনি গবেষকদেরও দায় রয়েছে। গবেষক যখন কোনো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন, তখন সতর্ক থাকতে হবে যেন তাঁর কথায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়। সংবাদমাধ্যমই হোক আর সামাজিক মাধ্যম হোক, গবেষণার ফল প্রকাশে সাবধানতা অবলম্বন করা গবেষক ও বিজ্ঞানীদের নৈতিক দায়িত্বও।

এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী লোকদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তবে ভালো বা আকর্ষণীয় বেতন দিয়ে বিষয়ভিত্তিক বা বিজ্ঞান–সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়া অনেক মিডিয়ার জন্য সম্ভব না–ও হতে পারে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় বিজ্ঞানী বা গবেষকদের এগিয়ে আসতে হবে।

ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনেক সময় গবেষকের উপস্থিতিতে গবেষণার বিষয়বস্তু ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জনগুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয়। এ ধরনের আলোচনায় গবেষকের গবেষণার জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে তুলে নিয়ে আসার দায়িত্ব উপস্থাপকের। কাজটি অবশ্যই সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির।

এ ছাড়া এসব আলোচনায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষক বা আলোচককে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত গবেষণার বিষয়বস্তু সুন্দরভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরা। ফলাফলের ভালো–খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, গবেষণার পদ্ধতি জানা যেতে পারে বা গবেষণার উদ্দেশ্য জানা যেতে পারে।

একদিকে যেমন মিডিয়ার দায় রয়েছে, তেমনি গবেষকদেরও দায় রয়েছে। গবেষক যখন কোনো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন, তখন সতর্ক থাকতে হবে যেন তাঁর কথায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়। সংবাদমাধ্যমই হোক আর সামাজিক মাধ্যম হোক, গবেষণার ফল প্রকাশে সাবধানতা অবলম্বন করা গবেষক ও বিজ্ঞানীদের নৈতিক দায়িত্বও। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনেক সময় গবেষকের উপস্থিতিতে গবেষণার বিষয়বস্তু ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জনগুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয়। এ ধরনের আলোচনায় গবেষকের গবেষণার জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে তুলে নিয়ে আসার দায়িত্ব উপস্থাপকের। কাজটি অবশ্যই সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির।

উন্নত বিশ্বে এখন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে কথা বলতে গবেষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক দেশে একাডেমিশিয়ান ও গবেষকেরা তাঁদের প্রফেশনাল প্রোফাইলে মিডিয়ার সাক্ষাৎকার ও প্রকাশিত পপুলার আর্টিকেল যুক্ত করে থাকেন, যা তাঁদের মূল্যায়নে ব্যবহৃত হয়।

প্রত্যেক গবেষকের পপুলার আর্টিকেল (সাধারণ ভাষায়) বা সাধারণ মানুষের উপযোগী করে লেখার দক্ষতা অর্জন করা উচিত। মিডিয়ায় প্রকাশের জন্য প্রেস নোট বা সংবাদমাধ্যমের উপযোগী সারাংশ তৈরি করে তা সরবরাহ করা প্রয়োজন। অন্যথায় তথ্য পরিবর্তিত হয়ে মুখরোচক ও ভুলভাবে মানুষের কাছে চলে যাবে। গবেষকদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। তা না হলে এ রকম দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকি থেকেই যাবে।

অনেক ক্ষেত্রেই কারিগরি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা ও কাজ করা মানুষের মধ্যে সংবাদমাধ্যমে কীভাবে একটি বিষয় সহজভাবে উপস্থাপন করতে হয়, সেটির অভিজ্ঞতা থাকে না। সে ক্ষেত্রে মিডিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে আলোচনা করে পূর্বপ্রস্তুতি রাখা যেতে পারে। বিদেশে যখন একটি বিষয়ে গবেষণা প্রকাশিত হয়, অনেক প্রতিষ্ঠানই প্রস্তুতি হিসেবে সেই গবেষণার সারাংশ বা ম্যাসেজটুকু তৈরি করে রাখা হয়। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংযোগ অফিস রয়েছে এ কাজ করার জন্য।

এসব জনসংযোগ অফিসে যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রয়োজনে গবেষণার অনুষ্ঠানগুলোয় উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। শুধু বিজ্ঞান নয়, যেকোনো বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। দেশীয় গবেষণার পাশাপাশি বিদেশের কোনো গবেষণা বাংলাদেশের জন্য আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে। তবে গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জার্নালে প্রকাশিত হলে ভালো। সে ক্ষেত্রে বিতর্কিত হওয়ার সুযোগ কম। আবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক যেকোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে মিডিয়ায়।

বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। গবেষণার বস্তুনিষ্ঠ ফলাফল যত বেশি সাধারণ মানুষদের উপযোগী করে প্রকাশিত হবে, তত বেশি এর সুফল দেশ ও জাতি পাবে। দেশের পলিসি মেকার ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সহজ ও বোধগম্য উপায়ে দ্রুত পৌঁছাতে এর কোনো বিকল্প নেই। তাই আমাদের দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোকে এ সেক্টরে জোর দেওয়া জরুরি।

বিজ্ঞানবিষয়ক খবর বা প্রতিবেদন তৈরি এবং টক শোর মতো অনুষ্ঠান করতে সাংবাদিক ও গবেষক উভয়ের যথাযথ প্রশিক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসা উচিত। কমবেশি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সাংবাদিক আছেন। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলো এসব সাংবাদিকসহ আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় সাংবাদিকদের নিয়ে প্রতিনিয়ত বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। এ জন্য আলাদা বাজেট থাকতে পারে।

সাংবাদিকদের সমাজের প্রতি যেমন দায়বদ্ধতা রয়েছে, তেমনি একজন গবেষকেরও আছে। এই পারস্পরিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারির জায়গা থেকে উভয়েই সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করলে বিজ্ঞান, গবেষণা ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগের সেতুবন্ধ তৈরি হবে—এ প্রত্যাশা সবার।

  • অধ্যাপক ড. মো. সহিদুজ্জামান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্যারাসাইটোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান