কন্যার নাম ‘ফুলপরী’। অপার্থিব নাম বলেই কি না কে জানে, পার্থিব মানুষের মতো ভয়ে-শঙ্কায় মাথা নিচু করে চলতে পারেননি তিনি। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন, ছাত্রলীগের নেত্রীরা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করাতে তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করে বসেছেন।
অভিযোগ করেছেন এমন একটা পরিস্থিতিতে, যখন কিনা তাঁদের নিয়মিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে মৌখিক অভিযোগ করতেও কেউ সাহস পায় না। এখানে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ফুলপরীকে আবারও মর্ত্যে, অর্থাৎ তাঁর ক্যাম্পাসে ফেরত আসতে হবে। তখন তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে?
ফুলপরী তাঁর ছবি ও নাম প্রকাশে দ্বিধা বোধ করেন না। কারণ, তিনি ঘোষণা দেওয়ার সৎসাহস রাখেন যে তিনি কোনো অন্যায় করেননি। তিনি হয়তো বোঝাতে চান, অন্যায় না করলে লুকিয়ে থাকতে হবে কেন? আর অভিযোগ যেহেতু করেছেন, তা সবার দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অতি অল্প বয়সে তাঁর সোচ্চার ভূমিকাকে আমরা নিশ্চয়ই অভিবাদন জানাব, স্বাগত জানাব। কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্ট যা-ই হোক, আমাদের বাহবাকে সম্বল করে তিনি ক্যাম্পাসে ফিরে এসে নির্বিঘ্নে থাকতে পারবেন না। তাঁর দৃঢ়তার সমর্থনে প্রশাসনকেও সুনিশ্চিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আদালত ও সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাঁর নিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করা একজনকে যদি এটুকু সহযোগিতা করতে পারা না যায় তবে বুঝতে হবে, অন্য অনেক ক্ষেত্রে যেমন অরাজকতা চলছে, তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের অন্যায় প্রভাবের ওপরে অন্য কারও কর্তৃত্ব চলে না।
বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। বারো বছর স্কুল-কলেজে লাগাতার তপস্যা শেষ করে ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় এসে দাঁড়ান চোখে ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে।
অথচ সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এখন আর শিক্ষা ও গবেষণার মতো কাজে মনোযোগ দেওয়ার দাবি করতে পারে না। সেখানকার শিউরে ওঠার মতো পরিবেশ ভেতরে গিয়ে না দেখলেও পত্রপত্রিকা মারফত সময়মতো মানুষ জানতে পারে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সারা দেশের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রমাগত ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী হয়রানি, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের নিয়মিত ঘটনা ঘটে চলেছে।
সেখানে ছাত্রদের রাজনৈতিক সংগঠনের পদে অভিষিক্ত হয়ে ছাত্ররা একেকজন নির্যাতনের প্রতীক হয়ে উঠছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন এই সব নির্যাতন ও অরাজকতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নৈতিক সাহস ও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কার্যকলাপই এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরোক্ষ আইন হয়ে উঠেছে।
১২ ফেব্রুয়ারি রাতে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের একটি বদ্ধ ঘরে কয়েক ঘণ্টা ছাত্রলীগের নেত্রী ও অনুসারীদের নির্যাতনের শিকার হন ফুলপরী খাতুন। রিট পিটিশন শুনানির পরে হাইকোর্ট এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। হাইকোর্টের তরফ থেকে নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্তদের ক্যাম্পাসের বাইরে পাঠানোর ফলে কিছুকাল আগে তাঁদেরই হাতে নির্যাতনের শিকার আরও অন্তত চারজন ছাত্রী মুখ খোলেন।
একই নেত্রীর হাতে তাঁরাও মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বলে জানান। অভিযুক্ত নেত্রী ও অনুসারীদের ভয়ে তাঁরা নির্যাতন সয়ে চুপ থাকেন। এই চিত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নয় এবং কেবল দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও নয়। বস্তুত, সারা দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ রকম ঘটনা পত্রপত্রিকায় লাগাতার দেখা যায়।
একেবারে হাল আমলের কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করতে চাইলে উল্লেখ করা যায়, এ বছরের শুরুর দিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে সিট রাখাসংক্রান্ত বিষয়ে অ্যাকাউন্টিং ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের ছাত্র রিয়াদ হোসেনকে ছাত্রলীগের সদস্যরা শারীরিক নির্যাতন করেন।
এই তো, ১২ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কামালউদ্দিন হলের গেস্টরুমে ছাত্রলীগের দুইজন নেতা ও কর্মী মিলে ‘অগ্রজদের সম্মান দিতে জানে না’ অভিযোগ তুলে দ্বিতীয় বর্ষের পাঁচ ছাত্রকে শারীরিক নির্যাতন করেন। পরে অভিযোগ ঠেকাতে ওই নেতা নির্যাতনের শিকার একজনকে হুমকি দিয়ে ক্যাম্পাসছাড়া করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইদানীংকালে অনন্ত ২৩ জন ছাত্রকে নির্যাতন করে তাঁদের জিনিসপত্রসহ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হল থেকে বের করে দেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সামিউল ইসলাম নামের ফোকলোর তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রকে গত ২৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগের কর্মীরা নির্যাতন করেন এবং ১০ হাজার টাকার দাবি করেন, না দিলে হত্যা করার হুমকি দেন।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রচুর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংগ্রামের মাধ্যমে একটি সন্তানকে লালন করে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে দেশের সর্বোচ্চ কোনো বিদ্যাপীঠে পাঠানোর পর পিতা-মাতা যদি নিশ্চিন্তে থাকতে না পারেন, তবে তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সার্বিক সরকারযন্ত্রের ব্যর্থতা।
নিকট অতীতে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে ধর্ষণ ও হত্যা-জাতীয় ঘটনা বারবার ঘটেছে। সিলেটের এমসি কলেজে সংঘটিত ধর্ষণের কথা গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে এসেছে। ২০১৯ সালে বুয়েটে ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে রাতভর নির্যাতনের শিকার হয়ে আবরার নামের এক ছাত্রের মৃত্যুবরণের কথাও সহজে ভোলার নয়। ওদিকে কিছুদিন আগে ইডেন গার্লস কলেজে ছাত্রলীগের নেত্রী ও অনুসারীদের হাতে নির্যাতিত হয়ে কয়েকজন ছাত্রী সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন। সেখানে ছাত্রলীগের নেত্রীর বিরুদ্ধে হলের সিট-বাণিজ্যের অংশ হিসেবে শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, সিটপ্রার্থী ছাত্রীদের ‘যৌনদাসী’ হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বদ্ধ ঘরে নির্যাতনের ঘটনায় একই ধরনের নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখান। তাঁরা তদন্ত কমিটি গঠন করেন, যা মূলত অপরাধটাকে একটি দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে ফেলে সমাধানহীন ও বিস্মৃত করে তোলে। অপরাধ সংগঠন হলে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা না নেওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে অপরাধকারীকে আরও বেশি অপরাধে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে নির্যাতনের শিকার ছাত্রছাত্রীর জন্য তাঁর নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ক্লাস শেষে পড়া ও বিশ্রামের ‘নিশ্চিন্ত’ স্থানটি শ্বাপদসংকুল হয়ে ওঠে। তাঁকে ভয়াবহ মানসিক আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে সুস্থ থাকা ও লেখাপড়ায় মনোযোগ দেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেখানে মারধর ও নির্যাতনের মাধ্যমে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয়, সেখানে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ প্রায়ই বিষয়টিকে হালকাভাবে নিয়ে নির্যাতন পরিচালনাকারী ছাত্রছাত্রীদের কাউন্সেলিংকে একমাত্র কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করবে বলে জানায়। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।
অবস্থাদৃষ্টে বলা যায় যে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কারই ছাত্রলীগের অন্তর্গত অপরাধীর একমাত্র আইনগত শাস্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। এতে সমাজ ও আইনের চোখে একজন অপরাধী যেমন সূর্যালোকে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পায় ও তার নিত্যনতুন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ থাকে, তেমনি তার মুক্ত অবস্থান নির্যাতনের শিকার মানুষদের জন্যও হুমকিস্বরূপ হয়ে থাকে। অপরাধীর স্বাভাবিক শাস্তি না হওয়াতে দেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও হোস্টেলে বারবার একই ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়।
সরকার তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি কোনো একটি ক্ষেত্রে একজন অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে কেবল একটিমাত্র দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত, তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্বস্তিকর পরিবেশ হয়ে উঠত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রচুর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংগ্রামের মাধ্যমে একটি সন্তানকে লালন করে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে দেশের সর্বোচ্চ কোনো বিদ্যাপীঠে পাঠানোর পর পিতা-মাতা যদি নিশ্চিন্তে থাকতে না পারেন, তবে তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সার্বিক সরকারযন্ত্রের ব্যর্থতা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বলা চলে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা একরকমের অত্যাচারী দলের সঙ্গে হাতে প্রাণ নিয়ে সহাবস্থানে বাধ্য হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনোখানে যে কেউ নির্যাতনের শিকার হতে পারে। সত্যিকারের বিদ্যাপীঠের নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের হাতে থাকার কথা। সে জায়গায় অরাজকতা দেখলে তাদের হাত গুটিয়ে থাকা, কেবল বহিষ্কার বা কাউন্সেলিংয়ের ধোঁয়া তুলে অপরাধকে জিইয়ে রাখার প্রবণতা তাদের নৈতিক নড়বড়ে অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত করে।
ফুলপরীর সরল ও শুভ প্রত্যাশী পিতা এত কিছুর পরও কন্যাকে তদন্ত কমিটির সামনে উপস্থাপনের সাহস রাখেন, তিনি সুষ্ঠু বিচারের প্রত্যাশা করেন। এ রকম ঘটনা যেন আর না ঘটে, সে বিষয়ে আশাবাদও ব্যক্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু পরিবেশের নিশ্চয়তা দিয়ে এ রকম একজন পিতাকে নিশ্চিন্ত রাখার দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
তবে এটা অদ্ভুত পরিস্থিতি বটে, জীবনে বিকশিত হওয়ার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে একজন ছাত্রী ১০ দিনের মাথায় নির্যাতনের শিকার হন এবং অভিযোগের সাহস করে ওঠার সূত্র ধরে তাঁর ওপর আবারও আক্রমণ হতে পারে বিবেচনায় নিজের ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে অপারগ হন। উচ্চশিক্ষার সিদ্ধান্ত নিলে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার কথাও একই সঙ্গে ভাবতে হবে?
আফসানা বেগম সাহিত্যিক