১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। আজ ১০৪তম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। শতবর্ষ পূর্ণ করে দ্বিশতবর্ষের যাত্রাপথে কোন পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান? সাম্প্রতিক বিভিন্ন উদ্যোগ ও পরিকল্পনা বিশ্লেষণ করে লিখেছেন তারিক মনজুর
১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এ অঞ্চলে দ্বিতীয় কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। বাংলা অঞ্চলে শিক্ষা, সাহিত্য ও বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল কলকাতা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকা পূর্ব বাংলার মানুষের স্বপ্ন ও আশার নতুন কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কেন্দ্র বদলের এই কাজটি সহজ করে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অধিকার আদায়ে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উচ্চশিক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেসব নীতি, কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে, দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলো বিশেষভাবে লক্ষ করে এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে সচেষ্ট হয়। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যে শক্তি ও সুযোগ দিয়েছিল, ক্ষমতাসীন রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি সেই শক্তি ও সুযোগকে বহুলাংশে নষ্ট করেছে। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাই জাতীয় স্বার্থেই শিক্ষা-উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৮ সালে রাজউকের কাছ থেকে পূর্বাচলে প্রায় ৫২ একর জমি বরাদ্দ পায়। এই জমিতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের উপযোগী ক্যাম্পাস গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। তা ছাড়া শিল্প ও পুঁজির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক নিবিড় করার জন্য সেখানে বহুবিধ উদ্যোগের কেন্দ্র তৈরি করা হবে। সেখানে একটি চিকিৎসা অনুষদ প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারেও প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া আছে।
কিন্তু বরাদ্দ পাওয়ার সাড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় পার হলেও সেই জমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে আসেনি। এই শম্বুকগতি উচ্চশিক্ষার প্রতি সরকারের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ওই পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ও উদ্ভাবনে পিছিয়ে রয়েছে। একাডেমিক ও অবকাঠামোগত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০৩৫ সালের মধ্যে উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চায়। এর ধারাবাহিকতায় ২০৪৫ সালের মধ্যে প্রথম সারির অতি উচ্চ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হতে চায়।
কিন্তু বরাদ্দকৃত উন্নয়ন বাজেটের সীমাবদ্ধতা, শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কাজে আগ্রহ এবং ক্যাম্পাসে শিক্ষাসহায়ক পরিবেশের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান তলানিতে পৌঁছেছে। গবেষণা ও উদ্ভাবনে অর্থ বরাদ্দ না বাড়ালে এবং ক্যাম্পাসকে সুবিধাবাদী ধারার রাজনীতিমুক্ত করতে না পারলে জাতীয় উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁরা কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই সরাসরি একাডেমিক কাজ শুরু করেন। ফলে তাঁদের শুধু বিষয়গত জ্ঞানই থাকে। গবেষণার প্রক্রিয়া ও ক্ষেত্র এবং শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো ধারণা তৈরি হয় না।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেলের তত্ত্বাবধানে তরুণ শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কোর্সের নকশা করেছে। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক শিক্ষক এই কোর্স করেছেন। কিন্তু এটিকে ভিত্তি কোর্স ধরে প্রতিটি বিভাগের বাড়তি চাহিদা অনুযায়ী আরেকটি অতিরিক্ত বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কোর্স যুক্ত করা প্রয়োজন রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, ভৌত অবকাঠামোগত পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে আধুনিক গবেষণাগারসহ একাডেমিক ফ্লোর স্পেস সাড়ে ২৭ লাখ বর্গফুট থেকে বেড়ে ৬০ লাখ বর্গফুট হবে। এ ছাড়া উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে আছে হাঁটার রাস্তা ও সাইকেল-লেন তৈরি, জলাবদ্ধতা নিরসন ও বৃষ্টির পানি ধারণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সৌরশক্তি উৎপাদন, সবুজায়ন বৃদ্ধি ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, জলাধার সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধন ইত্যাদি। কিন্তু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে সর্বসাধারণের জন্য সড়ক ও পরিবহনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়বহির্ভূত বিভিন্ন অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজ নয়।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে ১ হাজার ৫০০ জনের মতো শিক্ষার্থী বসতে পারেন। নতুন পরিকল্পনায় এই সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়েছে। তা ছাড়া নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা খেলার মাঠ ও সুইমিংপুল তৈরির চিন্তা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ বাড়ানো হয়েছে।
এ ছাড়া প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তির আওতায় নিয়ে আসার জন্য এ বছর নতুন নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। প্রতি মাসে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কমবেশি চার হাজার টাকা করে বৃত্তি দেওয়া হবে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং শিল্প ও কলকারখানা থেকে শিক্ষার্থীরা যাতে সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করেন, সেই উদ্যোগও নেওয়া হবে।
যে আশা নিয়ে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদের সেই আশা ভঙ্গ হয়। রাজনৈতিক আক্রোশ, যৌন হয়রানি, আবাসনসংকট, র্যাগিং কালচার তাঁদের মানসিকভাবে সংকুচিত করে রাখে। শিক্ষা ও গবেষণায়ও এর প্রভাব পড়ে। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তরের তত্ত্বাবধানে একটি নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে। এটি অনুসরণ করে প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যেসব সংকটের নিরসন বা নিয়ন্ত্রণ শিক্ষার্থীর নিজের হাতে থাকে না, সেগুলো দূর করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রায় সময়ই নির্বিকার থাকে।
কোভিড-১৯ মহামারিকালে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা সম্ভব হয়। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইসিটি সেল এখন ক্লাস ও পরীক্ষা পরিচালনার জন্য দুটি আলাদা সফটওয়্যার তৈরি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অটোমেশন প্রক্রিয়ায় আইসিটি সেল মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। কেন্দ্রীয় অনলাইন ভর্তি অফিস ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিসও এই অটোমেশন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করছে।
প্রশাসনিক ভবনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অফিসে ফাইল ব্যবস্থাপনায় ‘ডিজিটাল-নথি’ বা ‘ডি-নথি’ চালু করা হচ্ছে। এসবের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের স্বচ্ছতা ও দ্রুততা নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার, অ্যাপ্লিকেশনসহ স্মার্ট আইডি কার্ড দেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষার মানকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সেমিস্টারে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিখন মূল্যায়ন বা টিচিং ইভাল্যুয়েশন আবশ্যিক করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা নিজের আইডি থেকে অনলাইনে এই মূল্যায়নের কাজটি করতে পারবেন। আশা করা যায়, দ্রুতই এই জরিপ কোর্স শিক্ষকদের দায়িত্ব বাড়াবে।
এ ছাড়া গবেষণাকে উৎসাহিত করার জন্য স্নাতক পর্যায়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য মনোগ্রাফ বা প্রজেক্ট চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রতিটি ব্যাচে অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ শিক্ষার্থীকে থিসিস গ্রুপের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে গবেষণায় যেহেতু বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করবেন, তাই বিশেষ সতর্ক থাকাও জরুরি। নইলে কয়েক বছর পরে নীলক্ষেতের ফটোকপির দোকানে সব অভিসন্দর্ভের ‘রেডিমেড কপি’ পাওয়া যাবে—এমন আশঙ্কাও রয়েছে!
২০২৪ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনব্যাপী বিভিন্ন উদ্ভাবনী পণ্য ও সেবামূলক আবিষ্কারের ধারণা নিয়ে উদ্ভাবন মেলা হয়। মেলায় ৪০টি উদ্ভাবনী পণ্য এবং ৬১টি সেবামূলক উদ্ভাবনী ধারণা উপস্থাপন করা হয়। তা ছাড়া এ বছরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও দুটি গবেষণা মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
পৃথিবীর প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যকর গবেষণায় বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও কলকারখানার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে। এর ফলে গবেষণা খাতে খরচ হওয়া অর্থ তুলে আনতে সমস্যা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগকে আলাদাভাবে এই সুযোগ তৈরি করতে হবে।
১৯৬১ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন। তখন ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন ফিরে পায়।
কিন্তু অর্থ ব্যয় ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া প্রধানত রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন প্রশাসনিক ও একাডেমিক পদে শিক্ষকদের পদায়নের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে শিক্ষকেরা হীনবল থাকেন। সম্প্রতি ‘স্বায়ত্তশাসনে’র সর্বশেষ নমুনা দেখা গেল পেনশন প্রকল্প নিয়ে। নতুন প্রস্তাবিত ‘প্রত্যয় স্কিমে’র ব্যাপারে শিক্ষকদের প্রবল আপত্তি থাকলেও এটি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকে যতটা বাস্তবসম্মত করা যাবে এবং কাছাকাছি আনা যাবে, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিও তত নিবিড় হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ সুযোগ রয়েছে শিক্ষা ও গবেষণায় অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠার। এ জন্য সবার আগে দরকার প্রকৃত মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া এবং শ্রেণিকক্ষ ও আবাসিক হলগুলোয় শিক্ষাসহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা ও সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করতে না পারলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জাতির যে প্রত্যাশা তা পূরণ হবে না।
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক