মতামত

আওয়ামী লীগে ‘বড় আর মেজ মেয়েদের’ দৌরাত্ম্য

শুরুতে একটি গল্প বলি। এক রাজ্যের রাজা তাঁর তিন কন্যাকে প্রশ্ন করলেন, তারা তাদের বাবাকে কেমন ভালোবাসে। বড় কন্যা বলল, আমি তোমাকে চিনির মতো ভালোবাসি। রাজা বেজায় খুশি। মেজ কন্যা বলল, আমি তোমাকে মধুর মতো ভালোবাসি। রাজা আরও বেশি খুশি। ছোট কন্যা বলল, আমি তোমাকে লবণের মতো ভালোবাসি।

এবার রাজা ভীষণ রেগে গেলেন। ছোট কন্যাকে বনবাসে পাঠিয়ে দিলেন। বড় কন্যা বাবাকে চিনি দিয়ে খাবার বানিয়ে খেতে দেয়, কিন্তু রাজার মন ভরে না। কারণ, চিনি দিয়ে রান্না করা খাবার দিয়ে তো আর পেট ভরে না। মেজ মেয়ে মধু দিয়ে খাবার রান্না করে খেতে দেয়, কিন্তু রাজার তাতে বিরক্তি আরও বাড়ে। কারণ, মধু দিয়ে রান্না খাবার তো খাওয়া যায় না।

রাজার তখন ছোট মেয়ের কথা মনে হয়। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। তখন রাজা তাঁর ছোট মেয়েকে বনবাস থেকে নিয়ে আসেন আর লবণ দিয়ে রান্না করা খাবার খেয়ে কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যান। (গল্পটি ঈষৎ পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত)

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও চলমান সংকটের সঙ্গে ওপরের গল্পটি বিশেষভাবে সম্পর্কিত। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলে আজ বড় আর মেজ মেয়েদের ব্যাপক দৌরাত্ম্যের কারণে সরকারের জন্য শুধু চিনি ও মধু দিয়ে তৈরি খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে। বর্তমান সংকটের সূচনা একটি সামাজিক আন্দোলনকে ঘিরে, যার নেতৃত্বে ছিল আমাদের ছাত্রসমাজ।

ছাত্রদের চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনটি ছিল একটি সময়োপযোগী ও ন্যায্য দাবি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশেরও অধিক বছর পরে মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী তৃতীয় প্রজন্মের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশের মতো বিপুল পরিমাণ কোটা সংরক্ষণ ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিতেই পারে।

উপরন্তু দেশে সময়ের পরিক্রমায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি, উচ্চ বেকারত্বের হার, দেশের বেসরকারি খাতে চাকরির বাজারের সংকোচন আর বিভিন্ন অনৈতিক প্রথার ব্যাপক বিস্তারের ফলে সরকারি চাকরির অহেতুক আকর্ষণ বৃদ্ধির কারণে যুবসমাজের মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম কোনো কাকতালীয় বিষয় নয় বরং তা অতিশয় যুক্তিযুক্ত। এই প্রেক্ষাপটে ছাত্রসমাজ কোটাপদ্ধতি সংস্কারের জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে।

ছাত্রসমাজের এই আন্দোলনকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। বরং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা যেই সম্মানের চোখে দেখি, ছাত্রদেরও তদ্রূপ সম্মানের চোখে দেখা বাঞ্ছনীয়। কেননা তারা দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের মেধা আর মননকে শাণিত করে এ দেশেরই সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে।

সুতরাং ছাত্রদের এই সামাজিক আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে তাদের সঙ্গে স্বল্পতম সময়ে যথাযথ আলোচনার ব্যবস্থা করা ছিল একটি আবশ্যিক পদক্ষেপ। এর ফলে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল তো হতোই, উপরন্তু একটি বিশাল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনে সরকারের সদিচ্ছার মূল শিকড়ের ন্যায় গ্রথিত হতে পারত।

কিন্তু সরকারের মাঝে লুকিয়ে থাকা চিনি আর মধুর কারবারিরা সরকারকে খুশি করাতেই ব্যস্ত। সরকারকে লবণের জ্ঞান দিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বসানোর কোনো ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কোনো লবণের কারবারির খোঁজ পাওয়া গেল না। ফলে একটি সহজ বিষয় জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে আবর্তিত হতে থাকল।

ছাত্র আন্দোলনের প্রাতঃকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চমহলের কর্তাব্যক্তিরা ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারতেন এবং তাদের দাবিগুলো শুনে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করার আশ্বাস দিতে পারতেন। কিন্তু এমন কিছুই করা হয়নি।

বর্তমান বিশ্বে একটি সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে দেশ পরিচালনার অনেক উদাহরণ রয়েছে। উন্নয়নের পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা এবং তার সফল বাস্তবায়নের জন্য এটি সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু ধারাবাহিক দেশ পরিচালনার সুযোগে একটি সরকারের মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাবেরও জন্ম হতে পারে, যা কিনা জন–অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই দ্বিমুখী প্রক্রিয়ার একটি সহজ সমাধান হতে পারে জনগণের সঙ্গে বেশি বেশি আলোচনার মাধ্যমে সম্পৃক্ততা সৃষ্টি করা।

আমার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চমহলের কর্তাব্যক্তিদের দলদাসত্বের কারণে তাঁদের মধ্যে যে স্নায়ুবৈকল্যের বিস্তার লাভ করেছে, সে সম্পর্কে তাঁরা অবহিত। এ কারণে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা যে প্রশ্নের সম্মুখীন, সেটাও তাঁদের অজানা নয়। তাই তাঁরা সরকারের পক্ষে একপ্রকার সাফাই গেয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যস্ত সময় পার করেছেন।

ছাত্র আন্দোলন যখন মধ্যগগনে, তখন শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ হতে পারত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা কিনা ছাত্রদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চার করতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনিও কোনো আলোচনার ব্যবস্থা না করে আন্দোলনের উত্তাপকে আরও ঘনীভূত করার রসদ সরবরাহ করলেন। এতে আমরা অবিশ্বাস্য করুণ পরিণতির দিকে ধাবিত হতে থাকলাম, যা অগ্রহণযোগ্য ও অমার্জনীয়।

ছাত্র আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্ররা আশা করেছিল তাদের দাবির স্বীকৃতি আর সরকারের সহযোগিতা ও দাবি পূরণের আশ্বাস। কিন্তু সরকারের মাঝে লুকিয়ে থাকা চিনি আর মধুর কারবারিরা সরকারকে এই সাধারণ কথাটি বুঝতে না দিয়ে বরং অতি উৎসাহীদের দানবীয় সমাধান–প্রক্রিয়ার ন্যায্যতার বয়ান করতে লাগল। এতে ছাত্র–অসন্তোষ আরও ভয়াবহ রূপ নিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশাল পরগাছা গোত্রের আগাছা ছাত্র আন্দোলনের মহিরুহকে গ্রাস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হওয়ার প্রয়াস চালানোর সুযোগ পেয়ে গেল, যার পরিণাম আজ দেশবাসীর কাছে প্রবলভাবে দৃশ্যমান।

স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের যে দৃশ্যমান উন্নতি সাধিত হয়েছে, তার একটি বড় অংশই হয়েছে বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে। সে জন্য সরকার প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু একই সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন ভুলত্রুটিরও আমরা বিচার–বিশ্লেষণ করব এবং সরকারকে  সে ব্যাপারে অবহিত করব, যেন সরকার সেই ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নিয়ে আরও জনবান্ধব কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।

বর্তমান বিশ্বে একটি সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে দেশ পরিচালনার অনেক উদাহরণ রয়েছে। উন্নয়নের পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা এবং তার সফল বাস্তবায়নের জন্য এটি সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু ধারাবাহিক দেশ পরিচালনার সুযোগে একটি সরকারের মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাবেরও জন্ম হতে পারে, যা কিনা জন–অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই দ্বিমুখী প্রক্রিয়ার একটি সহজ সমাধান হতে পারে জনগণের সঙ্গে বেশি বেশি আলোচনার মাধ্যমে সম্পৃক্ততা সৃষ্টি করা।

একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ সদা পরিবর্তনশীল। এই চলমান পরিবর্তন বিভিন্ন সময়ে সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি কার্যকর বিরোধী দল যেহেতু অনুপস্থিত, তাই জনগণের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে।

যেকোনো সামাজিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যদি জনগণের সঙ্গে আলোচনা করে, তাহলে জনগণের মধ্যে সরকারের ব্যাপারে আস্থার জন্ম হয়। এর ফলে জনগণের মধ্যে স্বৈরাচারভীতিও লাঘব হয়। সুতরাং সামাজিক আন্দোলন সরকারের জন্য জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু সরকার যদি সামাজিক আন্দোলনকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে, এ কারণে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে এবং তা কঠোর হস্তে দমনে সচেষ্ট হয়, তাহলে ওই সামাজিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।

আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, সরকারের সঙ্গে জনগণের সংলাপ অন্যান্য যেকোনো বিকল্প ব্যবস্থার চেয়ে সহস্র গুণ বেশি কার্যকর। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলনের রকমভেদ অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি। ছাত্র আন্দোলন আর দশটা আন্দোলনের চেয়ে একেবারেই আলাদা। ছাত্ররা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ আর তাদের আবেগ ও অনুভূতির সর্বোচ্চ মূল্যায়ন অপরিহার্য। তাই সব সামাজিক আন্দোলনেই শক্তি প্রয়োগ কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে না।

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা দেখছি, সরকারের চারপাশের চিনি ও মধুর কারবারিরা, দেশের সাম্প্রতিক সামাজিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নেওয়া ভুল পদক্ষেপগুলোকে মধুমাখা বাক্যে নিরন্তর প্রশংসার বাণে জর্জরিত করছে। ফলে ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণের মধ্যে আরও হতাশার জন্ম নিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য চাই লবণমিশ্রিত বাক্যবাণ, যা সরকারকে সঠিক পরিস্থিতি বুঝতে ও সঠিক কাজটি করতে সাহায্য করবে।

  • ড. মসফিক উদ্দিন অধ্যাপক, লিডস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য