হিরো আলমকে নিয়ে ‘জাত গেল’ শোরগোল ও একজন সংসদ সদস্যের গাড়ি-বাড়ি-ঘড়ির গল্প

রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনা চলছে। আমি যে সময়টা সংসদে ছিলাম, তখন তাঁর ভাষণের প্যারাগ্রাফ ধরে বক্তব্য রেখে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করতাম। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক, অসামঞ্জস্য তুলে আনতাম। তাঁর বক্তব্যের রাজনৈতিক অংশগুলো তথ্য, পরিসংখ্যান দিয়ে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তখনো দেখতাম সরকারি বা বিরোধী উভয় দলের সদস্যরাই মাঠের রাজনৈতিক বক্তব্য কিংবা স্তুতি করেই সময় পার করতেন। এমনকি গান-কবিতাও বাদ যেত না। তবে যে যা-ই বলুক, ন্যূনতম ভদ্রতা আর শালীনতা রক্ষা করেই বলতেন। কিন্তু এবার সংসদে একজন সংসদ সদস্যের দেওয়া একটা বক্তব্যে চোখ আটকে গেল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে অনেক কিছুই এখন ভাইরাল হয়, সেই সুবাদেই চোখে পড়ল তাঁর বক্তব্য।

তিনি বলছেন, ‘বিএনপির বাবারও ক্ষমতা নাই, বিএনপি দেখেন একটা সিট পাইবো কি না। আমি জমিয়তে আহলে হাদিসের অ্যাডভাইজার। সেন্ট্রাল কমিটির অ্যাডভাইজার। এই আড়াই কোটি লোক আমি যা কমু…একসময় তারা ছিল বিএনপিপন্থী। আজকে ৯০% এই আহলে হাদিসের লোক সব আওয়ামী লীগ হয়ে গেসে, কারণ আমি যেহেতু আমার জাকাতের টাকা বাংলাদেশের মানে বড় বড় মাদ্রাসাগুলোতে…কোনো মাদ্রাসায় ৫০ হাজার টাকা, কোনো মাদ্রাসায় ১ লাখ টাকা। যার জন্য জমায়েতে  ইসলামের কমিটি আমিই গঠন করি, আমিই নির্ধারণ করে দেই…আমি আওয়ামী লীগে কেন জয়েন করলাম? আমি কিন্তু অনেক বড় ব্যবসা করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও কৃতজ্ঞ এই কারণে যে আমার বউরে ডাক নামে চিনে…খুকি, তুমি কেমন আসো? আর আমি যখনই ঢুকব, আপার কাছে যাব…যাওয়ার সঙ্গেই “এই আমার খুকি কেমন আসে?” আমার ছেলের নাম হইলো রন, ওর বয়স ৪৬। “এই রন কেমন আসে?” এই জন্যই আমি কৃতজ্ঞ। আর আমাকে অনেক কিছু দিতে চাইসে আপা। আমি নিয়া কী করব? কারে দিব? আমার ছেলেমেয়েরা সব বিলাত-আমেরিকা থেকে পড়াশোনা কইরা আসছে। আমার দুই নাতি এখন হার্ভার্ডে পড়তাসে, দুই নাতি এখন অক্সফোর্ডে পড়তেসে…

...কাজেই আমি টাকাপয়সা…আমার লেখাপড়া হইলো সবচেয়ে বড় জিনিস…আমি টাকাপয়সাই নিয়া কী করব…এর মইধ্যে আপা চাইরটা প্লট আমারে দিতে চাইসে…আমি বললাম, আপা আমাদের এত জমি আসে আপ্নে গরিব এমপিদের দিয়া দেন। আমি নিব না কিছু। কয় আমি কি আপনেরে পাঁচবারের এমপি…আপনারে কিছুই দিতে পারবো না…আমি বললাম, কিছুর দরকার নাই। ইভেন আমি কিন্তু স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যানরা বাড়ি পায়, গাড়ি পায়, আমি কিচ্ছু নেই না। কিচ্ছু আমি নেই না, কারণ আমার দরকার নাই, আমারই তো আছে। আমি কেন নিতে যাব…এটা দেক…গরিব যারা আছে ওরা নেবে। আমার বাড়ি ঢাকা। আমার বাসায় ছয়টা গাড়ি সব সময় পইড়া থাকে। কী কী গাড়ি আছে এটা বলব না আমি। বললে মনে করব যে এইটা নিজেকে নিজেই ফুটানি দেখাইতেছি। কাজেই আমার মনে হয় যত দাবি করি…এই যে আমার হাতে ঘড়িটা দেখতেছেন, এক কোটি টাকা, এই রকম ঘড়ি আমার পাঁচ বাচ্চারেই দিয়া দিছি দুইটা কইরা। এই রকম ঘড়ি আমার বউরে দিয়া দিছি। এই রকম না, রোলেক্স দিয়া দিছি। মানে আমার নাতিরেও দিয়া দিছি। এই আমার নাতি একটা ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হইছে, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে, তা-ও টেক্সাস ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি। আমার মেয়ে দেখতে গেছে নাতিরে, কনভোকেশনে গেছে সেইখানে, আমি আমার মেয়ের হাতে যখন ঘড়িটা দিয়া দিলাম, সেইখানে মানে আমার গালে একটা চুমু খাইয়া চইলা গেছে…।’

সবার বক্তব্য ধরে ধরে হিসাব করতে বসলে সে হিসাব কখনোই শেষ হওয়ার নয়। তবে টাকা দেখানো সেই সংসদ সদস্যদের তিন মিনিটের বক্তব্যের হিসাব পরিষ্কার। ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে যে কথাগুলো তিনি সংসদে বলেছেন, সে ধরনের বক্তব্য বিশ্বের কোনো দেশের সংসদে চলে কি না, জানি না। হিরো আলমের সংসদ নির্বাচন নিয়ে যাঁরা ‘জাত গেল জাত গেল’ রব তুলেছেন, তাঁদের জন্য এই সংসদ সদস্যের বক্তব্য চিন্তার নতুন খোরাক হতে পারে।

এই হলো সংসদে দাঁড়িয়ে একজন সংসদ সদস্যের বক্তব্য। অবাক লাগছে পড়ে? অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই এখন সংসদ সদস্যের মান। খুব প্রান্তিক অবস্থা থেকে উঠে এসে হঠাৎ টাকা হওয়া মানুষ, তার টাকার গল্প মানুষকে শোনাতে ভালোবাসে। কোন জিনিস কত দামে কিনল, কাকে কী দিল, কত টাকা ব্যয় করল, কী ঘড়ি, কোন গাড়ি কিনল, কয়টা কিনল, সেটাই থাকে তাদের আলোচনার মূল অংশজুড়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এমন মানুষ এখন সংসদ দখল করে আছে। সেখানে তারা তাদের বিত্তবৈভবের গল্প, পারিবারিক গল্প, আত্মীয়স্বজনের গল্প অন্য এমপিদের শোনায়। সেই টাকার উৎস কী, সেটা নিয়ে যেমন কেউ প্রশ্ন তোলে না, তেমনি এই সম্পদের ট্যাক্স আদৌ দেওয়া হয় কি না, দিলে কত টাকা ট্যাক্স দেয়, সেই কথাও কোথাও ওঠে না। তা ছাড়া এই শোনানোটা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় হলে একরকম, কিন্তু এটি হয় সংসদে দাঁড়িয়ে, ২ লাখ টাকা যেখানে ব্যয় হয় প্রতি মিনিটে।

বাংলাদেশের সংসদ বহুদিন হলো ব্যবসায়ীদের দখলে। প্রায় প্রতিটি সদস্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ব্যবসায়ীরা বোঝেন লাভ-লোকসান, তাঁদের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাবটাও হয় টাকার অঙ্কেই। সুতরাং এমপি সাহেবের এ ধরনের প্রকাশ্য বক্তব্য নিম্ন রুচির হতে পারে, কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। ঘড়ি, গাড়ি, জমি তাঁর একমাত্র পরিচয়, সুতরাং সেটি তিনি প্রকাশ করবেন, তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কি আছে।

এই সংসদ সদস্যের এসব কথা নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে যতটা প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা ছিল, হয়েছে তার তুলনায় কমই, কারণ তখন সবাই মেতে ছিলেন হিরো আলমের সংসদ নির্বাচন করা, সামান্য ব্যবধানে পরাজিত হওয়া এবং তাঁকে নিয়ে দুই বড় দলের বাহাসের মতো ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। হিরো আলমের প্রতি ‘শিক্ষিত’ মধ্যবিত্তের ধারণা অনেকটা পাল্টে গেলেও কেউ কেউ এখনো প্রশ্ন করেন সংসদ সদস্য হিসেবে হিরো আলমের আদৌ কোনো যোগ্যতা আছে কি না। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, হিরো আলমকে সংসদে এনে নাকি সংসদকে ফালতু এবং ছোট করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর এই বক্তব্য শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল, হাতের ঘড়ি এক কোটি টাকা…ব্র্যান্ডের নাম শুনলে ভড়কে যাওয়ার মতো ছয়টি গাড়ি…অনেক জমিজমা…বহু মাদ্রাসায় ৫০ এবং এক লাখ টাকা করে অনুদান ইত্যাদি। আচ্ছা, একটা সংসদে এমন বক্তব্যে কি সংসদের সম্মান ক্ষুণ্ন হয় না? নাকি সংসদ এখন পয়সাওয়ালাদের আর একটি ক্লাব?

যে সংসদের হওয়ার কথা ছিল আইন প্রণয়নের, নীতিনির্ধারণের, সরকারকে জবাবদিহির মধ্যে আনার সূতিকাগার, সেই সংসদ এখন সংসদ সদস্যেদের সম্পদের ফিরিস্তি আর হামবড়া দেখানোর জায়গায় পরিণত হয়েছে। এর ফলে একজন সংসদ সদস্যের যে মূল কাজ, সেখানে ব্যয় হয় খুবই কম সময়। বাংলাদেশের সংসদের মোট সময়ের মাত্র ১২ শতাংশ আইন প্রণয়নে ব্যয়িত হয়, যা ভারতে ৩২ শতাংশ আর যুক্তরাজ্যে ৪৮ শতাংশ।

সংসদ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিয়মিত। সেখানে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ থাকে কোরাম-সংকটে সংসদের কার্যক্রম শুরু হতে কতটা দেরি হলো এবং তাতে কত টাকা ক্ষতি হয়েছে, সেটা। কিন্তু একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে যে সংসদ অধিবেশন চলার সময় প্রতি মিনিটে প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয় হয়, সেই সংসদে যখন কর্মকাণ্ড চলে, তখনকার ব্যয়ের টাকার পুরোটা কি সদ্ব্যবহার হয়? যেসব কর্মকাণ্ড অনেক সংসদ সদস্য করেন, যার সঙ্গে সংসদের কার্যাবলির দূরতম সম্পর্ক নেই, সেটাও কি জনগণের টাকার অপচয় নয়? সেই সময়গুলোর ক্ষতি হিসাব করলে ক্ষতির পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

সবার বক্তব্য ধরে ধরে হিসাব করতে বসলে সে হিসাব কখনোই শেষ হওয়ার নয়। তবে টাকা দেখানো সেই সংসদ সদস্যদের তিন মিনিটের বক্তব্যের হিসাব পরিষ্কার। ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে যে কথাগুলো তিনি সংসদে বলেছেন, সে ধরনের বক্তব্য বিশ্বের কোনো দেশের সংসদে চলে কি না, জানি না। হিরো আলমের সংসদ নির্বাচন নিয়ে যাঁরা ‘জাত গেল জাত গেল’ রব তুলেছেন, তাঁদের জন্য এই সংসদ সদস্যের বক্তব্য চিন্তার নতুন খোরাক হতে পারে।

  • রুমিন ফারহানা বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী