চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকৌশলশিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাদানের পদ্ধতি নিয়ে তাদের গবেষণা অব্যাহত আছে।
অন্যদিকে আমাদের বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কয়েকটি নতুন কোর্স প্রোগ্রামের কারিকুলামে যুক্ত করা ছাড়া অন্য কিছু ভাবছে না। তারা এ বিষয় নিয়ে কোনো গবেষণার উদ্যোগও নিচ্ছে না।
বর্তমানে নিয়তপরিবর্তনশীল জটিল প্রযুক্তির যুগে এ ধরনের চিন্তাধারা বা পদক্ষেপ কতখানি যৌক্তিক, তা আমাদের ভাবতে হবে।
এটি স্বীকৃত যে প্রতিটি শিল্পবিপ্লব শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আগের তিনটি শিল্পবিপ্লব থেকে একেবারেই ভিন্ন হওয়ায় প্রকৌশলশিক্ষার ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তনের প্রয়োজন।
পাঠ্যক্রম, শিক্ষাদান ও শেখার পদ্ধতিতে যথাযথ পরিবর্তন করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবশ্যই বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত জটিলতা আর কর্মক্ষেত্রের নতুন দক্ষতা ও জ্ঞানের পাশাপাশি সমাজের প্রত্যাশা বুঝতে হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ক্লাউড কম্পিউটিং, থ্রিডি প্রিন্টিং, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটিএস), জৈবপ্রযুক্তি, জিনোমিকস, ন্যানো ম্যাটেরিয়ালসহ বিভিন্ন ‘এক্সপোনেনশিয়াল টেকনোলজি’র একীকরণ (ইন্টিগ্রেশন) এবং যৌগিক (কম্পাউন্ডিং) প্রভাব দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমের সংযোজন শুধু উৎপাদনপ্রক্রিয়াগুলোকে স্বয়ংক্রিয় করে না, বরং নানা ধরনের কার্যকর প্রায়োগিক জটিল সিস্টেম উদ্ভাবন করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য এআইয়ের বিকাশ যথেষ্ট পরিমাণে এগোবে কি না অথবা এআইয়ের কারণে ভবিষ্যতের চাকরির অনিশ্চয়তা কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে, তা নিয়ে আলোচনা বাড়ছে।
ক্রিটিক্যাল থিংকিং এবং জটিল সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বিকাশের দিকটা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমোন্নতির সঙ্গে এগুলো ক্রমবর্ধমান মূল্যবান হয়ে উঠবে।
এআইয়ের নৈতিক ও দায়িত্বশীল বিকাশ এবং ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য নৈতিক কাঠামো এবং নীতিকাঠামো প্রতিষ্ঠা করাও অপরিহার্য।
প্রচণ্ড গতিতে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে এবং কাজের প্রকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যা প্রকৌশলের শিক্ষার্থীদের বহুবিষয়ক জ্ঞান ও দক্ষতা দেবে এবং কর্মজীবনে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে সহায়ক হবে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রকৌশলীদের কাজের প্রকৃতি ও পরিধি জানা দরকার। অন্যথায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবেও সনাতন নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু প্রতিটি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামের পাঠ্যক্রমে নতুন কিছু বিষয় (যেমন মেশিন লার্নিং, বায়োটেকনোলজি, ইনোভেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেটা অ্যানালিটিকস ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত করে কারিকুলাম প্রণয়নের প্রস্তাবকেই যথেষ্ট মনে হবে।
শিক্ষাগবেষকেরা মনে করেন, প্রকৌশলীদের দায়িত্বে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। সংক্ষেপে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
প্রকৌশলীরা আসলে কী করেন? প্রকৌশলীরা বিশ্লেষণ, নকশা, উদ্ভাবন, কোড, বিল্ড এবং তৈরি করতে বৈজ্ঞানিক নীতিগুলো প্রয়োগ করে বিশ্বকে অধিকতর সহজ করার চেষ্টা করেন। তাঁরা উদ্ভাবনের অগ্রভাগে থাকেন। তাঁদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো তাঁদের নিজস্ব সৃজনশীলতা।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগে স্নাতক প্রকৌশলশিক্ষার ভিত্তি ছিল নিউটনিয়ান–কার্টেসিয়ান বিশ্বদর্শন। সেখানে সিস্টেমের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
১. এখানে সিস্টেম পর্যবেক্ষক থেকে স্বাধীনভাবে বিদ্যমান থাকে।
২. এ ব্যবস্থায় ‘উদ্দেশ্য’ অভিজ্ঞতামূলক তথ্য থেকে অনুমান করা যায়।
৩. তাদের উপাদান অংশগুলোর আচরণ বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়।
নিউটনিয়ান–কার্টেসিয়ান বিশ্বদর্শন মূলত ডুয়েলিস্টিক (যা ‘বিষয়’ ও ‘বস্তু’—এ দুই ভাগে বিভক্ত)।
‘বিষয়’ হচ্ছে একটি চিন্তার জিনিস, যা প্রসারিত হয় না। আর ‘বস্তু’ হচ্ছে একটি বর্ধিত জিনিস, যা চিন্তা করে না।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রকৌশলীর কার্যক্রম এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রকৌশলীরা প্রযুক্তিগত সিস্টেমের অংশ এবং তার দৃষ্টিকোণ ও মূল্যবোধগুলো প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
প্রকৌশলের শিক্ষার্থীদের বহু-বিষয়ক জ্ঞান ও কর্মসংস্থান দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি আন্তবিভাগীয় জ্ঞানও অর্জন করতে হবে। এ কারণে লিনিয়ার থেকে নন–লিনিয়ার প্যারাডাইমে রূপান্তরের ওপর ভিত্তি করে স্নাতক প্রকৌশলশিক্ষার জন্য একটি নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।
প্রথাগত ‘চক ও ডাস্টার’ শিক্ষাদানের পদ্ধতির মাধ্যমে বর্ণিত দক্ষতাগুলো ছাত্ররা অর্জন করতে পারেন না। এই শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে আমরা দেখতে পাই, শিক্ষক রুমের সামনে দাঁড়িয়ে একটি ডেরিভেশন তাঁর নোট থেকে কপি করছেন বোর্ডে এবং তিনি যা লেখেন, তা জোরে জোরে পুনরাবৃত্তি করেন। শিক্ষার্থীরা নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে বোর্ড থেকে নকল করেন। তাঁদের মধ্যে তখন কাজ করে অন্য ক্লাসের হোমওয়ার্ক বা অন্য কিছু।
কাজেই নতুন এ পদ্ধতির জন্য একটি লাইনার রিডাকসনিস্ট মানসিকতা থেকে একটি নন–লাইনার সামগ্রিক মানসিকতায় একটি প্যারাডাইম শিফট প্রয়োজন।
আর এটি কয়েকটি নতুন কোর্স প্রোগ্রামের কারিকুলামে যুক্ত করে করা যাবে না। এর জন্য একটি ‘হলিস্টিক স্নাতক কারিকুলাম’ প্রণয়ন করতে হবে। প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত জটিলতা, অস্পষ্টতা এবং অনিশ্চয়তাকে শুধু হলিস্টিক স্নাতক কারিকুলাম দ্বারাই পরিচালনা করা সম্ভব।
প্রযুক্তির প্রকৃতি ও সিস্টেমের বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা করে বিশ্বের স্বনামধন্য প্রকৌশলশিক্ষার গবেষকেরা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করে রূপান্তরমূলক শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে মতামত দেন।
প্রকৌশল বিষয় নিয়ে অধ্যয়নের সময় ছাত্রদের যেসব দক্ষতা অর্জন করতে হবে, সেগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন, ক্রিটিক্যাল থিংকিং, জটিল সমস্যার সমাধান, সহযোগিতা, চাহিদামাফিক দক্ষতা, নীতিশাস্ত্র, আজীবন শিক্ষা, মেশিন-মানুষের মিথস্ক্রিয়া, এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ এবং আন্তবিভাগীয় দক্ষতা।
প্রথাগত ‘চক ও ডাস্টার’ শিক্ষাদানের পদ্ধতির মাধ্যমে বর্ণিত দক্ষতাগুলো ছাত্ররা অর্জন করতে পারেন না। এই শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে আমরা দেখতে পাই, শিক্ষক রুমের সামনে দাঁড়িয়ে একটি ডেরিভেশন তাঁর নোট থেকে কপি করছেন বোর্ডে এবং তিনি যা লেখেন, তা জোরে জোরে পুনরাবৃত্তি করেন। শিক্ষার্থীরা নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে বোর্ড থেকে নকল করেন। তাঁদের মধ্যে তখন কাজ করে অন্য ক্লাসের হোমওয়ার্ক বা অন্য কিছু।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দাবিকৃত বৈচিত্র্যময় দক্ষতার বিকাশকে সীমিত করে অধ্যাপকেরা কিছু সমস্যা সমাধানের বরাদ্দ দিয়ে ক্লাস শেষ করেন।
সমস্যা সমাধান করতে ছাত্রদের তাঁদের শিক্ষকদের মতো কিছু করতে হয় বা অন্য ভ্যারিয়েবলের প্রদত্ত মান থেকে কিছু ভ্যারিয়েবলের জন্য উদ্ভূত সূত্র সমাধান করতে হয়।
‘চক ও ডাস্টার’ শিক্ষাদানের পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়াগুলোয় জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর না হওয়ায় বিভিন্ন বিকল্প শিক্ষাপদ্ধতি অন্বেষণ করা হয়।
উদ্ভাবনী শিক্ষাদানের পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রজেক্টভিত্তিক শিক্ষা, প্রবলেমভিত্তিক শিক্ষা, ফ্লিপড ক্লাসরুম, এক্সপেরিয়েনশিয়াল শিক্ষা এবং কেসস্টাডি পদ্ধতি।
ক্যাপস্টোন প্রজেক্টগুলোর প্রবর্তন, বিশেষ করে আন্তবিভাগীয় প্রজেক্টগুলো ক্রিটিক্যাল চিন্তাভাবনা এবং প্রবলেম সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে।
বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের প্রকৌশলশিক্ষার্থীদের জন্য একটি লার্নিং ল্যাবরেটরি রয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো শিক্ষাকে অভিজ্ঞতামূলক, সহযোগিতামূলক এবং পুনর্বিন্যাসযোগ্য করে তোলা।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উনিশ শতকের শ্রেণিকক্ষে বসে বিশ শতকের পাঠ্যক্রম নিয়ে একুশ শতকের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছে।
একুশ শতকের প্রযুক্তির অগ্রগতিতে অবদান রাখতে সক্ষম প্রকৌশলীদের গড়ে তোলার জন্য একটি প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে—একজন প্রকৌশলীর ভূমিকাকে সমাজের জন্য প্রযুক্তির বিকাশকারী থেকে সামাজিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী হতে হবে।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য প্রকৌশলীদের রূপান্তর করতে প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি থেকে প্রস্থান প্রয়োজন। প্রকৌশলশিক্ষায় পরিবর্তনের সময় এসেছে, যা সমসাময়িক প্রযুক্তিগত ল্যান্ডস্কেপের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগগুলোর জন্য শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত করার জন্য রূপান্তরমূলক পরিবর্তনকে গ্রহণ করে।
এম এম শহিদুল হাসান ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক
ই–মেইল: shahidul7371@gmail.com