বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক ঘটনা। এটা শুধু একটি আঞ্চলিক সংঘাত ছিল না, বরং এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিসরে বহু বিচিত্র ঘটনার সমীকরণও যুক্ত ছিল। এ বিষয়গুলো নিয়ে ১৯৭১: আ গ্লোবাল হিস্টরি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ নামে একটি বই লিখেছেন ভারতের হরিয়ানায় অবস্থিত অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ও সমকালীন ইতিহাস–বিশেষজ্ঞ শ্রীনাথ রাঘবন। ১৯৭১: বাংলাদেশ সৃষ্টির বৈশ্বিক ইতিহাস নামের বইটির অনুবাদ প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক ও লেখক কাজী জাওয়াদ। মার্চ মাস ছিল মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাস। সেই বিবেচনায় বইটির একটি চৌম্বক অংশ সংক্ষিপ্ত করে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ দুপুরে জাতীয় পরিষদ অনির্দিষ্টকাল স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়। ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে লাখ লাখ লোক ঢাকার রাজপথ ও ময়দানগুলোয় জড়ো হতে থাকে। সরকারি কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেন। ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও আদালতগুলো ফাঁকা হয়ে যায়। পাকিস্তান ও কমনওয়েলথ একাদশের মধ্যে চলা ক্রিকেট ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়। হাজার হাজার দর্শক বের হয়ে বাইরের জনতার সঙ্গে যোগ দেয়। বাঁশের লাঠি ও রড হাতে নিয়ে উত্তেজিত জনতা স্বাধীনতা ও সশস্ত্র সংগ্রামের ধ্বনি দিতে দিতে চারদিক থেকে দলে দলে পূর্বাণী হোটেলের দিকে আসতে থাকে। সেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা আলোচনার জন্য জড়ো হয়েছিলেন।
সেই বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী স্পষ্টভাষী ছিলেন। জাতীয় পরিষদ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে, ‘কেবল একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের অসম্মতির জন্য, আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি, আমরা তা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে পারি না।’ তিনি পরবর্তী ছয় দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যার মধ্যে ছিল পরদিন ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল, ৩ মার্চ (যেদিন পরিষদ অধিবেশনের তারিখ ছিল) সারা প্রদেশে ধর্মঘট এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা। তিনি একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন কি না, প্রশ্ন করলে শেখ মুজিব জবাব দেন, ‘অপেক্ষা করুন।’
পরদিন সকালে ছাত্র-শ্রমিকদের বানানো অসংখ্য অবরোধে ঢাকার রাজপথ ভরে গিয়েছিল। ধর্মঘট পুরোপুরি সফল হয়েছিল, আওয়ামী লীগের কর্মীরা তেজোদীপ্তভাবে তা প্রয়োগে সক্ষমতা প্রমাণ করতে পেরেছিল, সেটিও ছিল একটি কারণ। একজন পর্যবেক্ষক যেমন স্মৃতিচারণা করেছেন, ‘হরতাল অমান্য করে কোনো গাড়ি রাস্তায় বের হলে’ কম বয়সী ছেলেরা হইহই করে ‘সেটার কাচ ভেঙে দিত বা টায়ার ফুটো করে দিত।’ সন্ধ্যার মধ্যে কর্তৃপক্ষ বিক্ষোভ দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। জনতার সঙ্গে আসন্ন সংঘর্ষে সেনাবাহিনী গুলি চালায়, ৯ জন নিহত এবং ৫১ জন আহত হয়। পরের কয়েক দিনে আরও কয়েকবার ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ৮ মার্চ কর্তৃপক্ষ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ১৭২ জন নিহত এবং ৩৫৮ জন আহত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের হিসাবে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি ছিল।
■ স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন কি না, প্রশ্ন করলে শেখ মুজিব জবাব দেন, ‘অপেক্ষা করুন।’ ■ ইয়াহিয়ার তাৎক্ষণিক লক্ষ্য ছিল শেখ মুজিবকে একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে বিরত রাখা। ■ ভুট্টোর জোরাজুরিতে শেখ মুজিবকে প্রায় খোলাখুলি সামরিক হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ■ মাওলানা ভাসানী স্বাধীনতাসংগ্রামে শেখ মুজিবের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
৩ মার্চ সকালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আগের ২৪ ঘণ্টার ঘটনাবলি বাঙালি ছাত্রদের আরও বিপ্লবী করে তুলেছিল। শেখ মুজিব অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন যে রাজপথের জনতার আবেগ তিনি যা ভাবছিলেন, তার চেয়েও তীব্র ছিল। তিনি আন্দোলনের ভরবেগ এমনভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছিলেন, যাতে তা আবার সেনাবাহিনীর সঙ্গে পূর্ণ সংঘর্ষের রূপ না নেয়। উপরন্তু আন্দোলনে সহিংস কিছু ধারায় তিনি চিন্তিত ছিলেন, বিশেষ করে উর্দুভাষী ‘বিহারি’দের ওপর আক্রমণের ঘটনায়। বিহারিরা হলো দেশভাগের পর ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসা মুসলমান শরণার্থী, যারা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে সমর্থন করায় আওয়ামী লীগ কর্মীদের ক্রোধের কারণ হয়ে উঠেছিল। বিকেলে ছাত্রদের এক সভায় দেওয়া ভাষণে শেখ মুজিব আন্দোলনে সক্রিয়তা এবং সংযত থাকার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ইয়াহিয়া সরকারকে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান, আবার ‘শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহের’ ওপর জোর দেন। তিনি বলেছিলেন বিহারি এবং অমুসলিমরা ‘আমাদের পবিত্র আমানত’।
শেখ মুজিবের ঈষদুষ্ণ ভাষণে বিপ্লবীরা আশাহত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তারা তাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য অক্ষুণ্ন রাখে। ওই সভার কয়েক দিন পর বড় ছাত্র অংশগুলো ‘স্বাধীন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ নামে ঐক্যবদ্ধ হয়। তারা ঘোষণা করল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি হবে জাতীয় সংগীত এবং বেতার থেকে গানটির নিয়মিত প্রচারও তারা নিশ্চিত করেছিল। বামপন্থী দলগুলো স্বাধীনতার ডাককে সমর্থন করল। মোজাফ্ফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বিচ্ছিন্নতাসহ নিজ সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দাবি করল। বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি জনগণকে প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে কর্তৃপক্ষকে প্রতিরোধের ডাক দেয়। মাওপন্থীরা এমনকি জমির মালিক, মহাজন-প্রথা এবং অন্য অত্যাচারীদের অবলুপ্ত করার ডাক দেয়।
ঘটনা এভাবে মোড় নেওয়ায় সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ৬ মার্চ সম্প্রচারিত ভাষণে ইয়াহিয়া ঘটমান সংকটের জন্য শেখ মুজিবকে দায়ী করেন। অভিযোগনামা পড়ার পর ইয়াহিয়া ঘোষণা দিলেন ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। ভাষণের সমাপ্তিতে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্তব্য পাকিস্তানের অখণ্ডতা, সংহতি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যে কর্তব্য পালনে তারা কখনো ব্যর্থ হয়নি।’ সেই সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া ঢাকার সামরিক আইন সদর দপ্তরের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে একটি টেলেক্স পাঠান:
দয়া করে হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমি শিগগিরই ঢাকা আসছি। আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি যে আপনার আকাঙ্ক্ষা এবং জনগণকে দেওয়া আপনার অঙ্গীকারকে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া যাবে। আমার একটি পরিকল্পনা আছে, যাতে আপনার ছয় দফার চেয়েও বেশি পূরণ হবে। আমি আপনাকে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি।
ইয়াহিয়ার তাৎক্ষণিক লক্ষ্য ছিল শেখ মুজিবকে একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে বিরত রাখা। কয়েক দিন ধরে একতরফা ঘোষণার গুজব সংবাদপত্র এবং রাজনৈতিক মহলে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়ছিল। তেমন ঘোষণা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় সমস্যার সৃষ্টি করত। একদিকে পূর্বের অসন্তোষ দমানোর জন্য সামরিক বাহিনী তখনো পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে যে সেনা শক্তিবৃদ্ধি শুরু হয়েছিল, তার অগ্রগতি হচ্ছিল ধীরে। অন্যদিকে স্বাধীনতার ঘোষণায় আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে, হয়তো কোনোরূপ হস্তক্ষেপও হবে। ইয়াহিয়ার চালের আরেক লক্ষ্য ছিল শেখ মুজিবের সঙ্গে পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করা। ভুট্টোর জোরাজুরিতে শেখ মুজিবকে প্রায় খোলাখুলি সামরিক হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। আর শেখ মুজিবের কাছে পাঠানো বার্তার উদ্দেশ্য ছিল আলোচনার আগপর্যন্ত আওয়ামী লীগের উদ্বেগকে অবশ করে রাখা।
কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, ইয়াহিয়া ওই আলোচনায় নিজের ‘মজবুত অবস্থান থেকে একটি রাজনৈতিক সমাধান’ পেতে আগ্রহী ছিলেন। যুক্তিটি তাঁর মতলব ও পথের অতিসরলীকরণ। আসন্ন আলোচনায় ইয়াহিয়া শেষবারের মতো রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা সম্বন্ধে শেখ মুজিবের উদ্দেশ্য যাচাই করতে চেয়েছিলেন। কাজটি করতে তিনি প্রধানত শেখ মুজিবের ‘একগুঁয়েমি’ এবং ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ সম্পর্কে তাঁর পূর্বধারণা পোক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রমাণ খুঁজছিলেন। তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা করার আগেই ঢাকার নিয়ন্ত্রণ আবারও সেনাবাহিনীর কবজায় নেওয়ার পরিকল্পনা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল।
স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আলোচনা হয় ৬ মার্চ। দলের নেতারা জানতেন ছাত্র এবং যুবক কর্মীরা ‘দৃঢ়ভাবে ওই ঘোষণা চাইত’। ‘সন্দেহ নেই’ যে তাদের বিশাল অংশের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে কম কোনো কিছু ‘গ্রহণযোগ্য হতো না’। তবু নেতৃত্ব সাবধানে এগোতে চাইছিলেন। তার এক কারণ তেমন ঘোষণা সামরিক বাহিনীকে শক্তি প্রয়োগের ‘ছুতো’ জোগান দিত। ‘একটি নিরস্ত্র জনগোষ্ঠী কি সে রকম আক্রমণের ধাক্কা সামলে বিজয়ী হতে পারবে?’ আরেক কারণ ছিল, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে? তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সরকার সামরিক সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ খুঁজছে এবং সে সুযোগ তাদের দেওয়া হবে না। শেখ মুজিবকে পাঠানো ইয়াহিয়ার বার্তা ওই ধরনের ‘ছুতো’ সৃষ্টির চেষ্টা বলে গণ্য হয়েছিল। একই সঙ্গে তাঁরা জনপ্রিয় আন্দোলনের গতি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। যাতে সরকারকে ভাবতে বাধ্য করা যায় যে ‘সামরিক শক্তি ব্যবহার তাদের কোনো উদ্দেশ্য অর্জনেই সফল হবে না।’ তাই স্বাধীনতার ঘোষণা এড়িয়ে যাওয়া উচিত এবং সুনির্দিষ্ট দাবি জানানো উচিত। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’ হওয়া উচিত।
পরদিন বিকেলে লাখ লাখ লোক রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিল। শেখ মুজিব পৌঁছাতে দেরি করছিলেন। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ছাত্রনেতাদের একটি দল তাঁর সঙ্গে দেখা করে মঞ্চ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার অনুরোধ করেন। শেখ মুজিব তা করেননি। কিন্তু তাঁর ১৭ মিনিটের ভাষণটি ছিল সেরা একটি ভাষণ। সামরিক-ভুট্টো চক্রের বিরুদ্ধে তীব্র শ্লেষাত্মক সমালোচনায় তিনি বলেন, ‘একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ দল ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে।’ তিনি বলেন, চারটি মূল দাবি মেনে না নিলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে যোগ দেবে না। দাবিগুলো ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, সেই সময় গুলিবর্ষণের ঘটনার তদন্ত এবং অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের অঙ্গীকার করে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বই।’ শূন্যে মুষ্টি তুলে তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শেখ মুজিব দামামা বাজিয়ে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানে মার্কিন দূতাবাসের পর্যবেক্ষণ ছিল, ‘প্রশ্ন হলো, কে প্রথম আঘাত করবে—ইয়াহিয়া না শেখ মুজিব? নাকি কেউই করবে না। শক্তি পরীক্ষা বেশিক্ষণ থেমে থাকতে পারে না।’
...আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তারা, বিচারক ও ব্যবসায়ী নেতারা সবাই নিজ নিজ কার্যক্রম সংক্ষিপ্ত আকারে চালু রাখার জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এই সময়ে ঢাকার রাজপথে মিছিলের পর মিছিল বিরামহীনভাবে চলতে থাকে, সেগুলো সাধারণত শেষ হতো শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে গিয়ে। একজন মার্কিন পর্যবেক্ষকের মতে, ওগুলো মনে হতো ‘বাঙালিদের স্বপ্নের প্রবাহ, সাহস, আকাশকুসুম কল্পনা, আদর্শবাদ, পশুর ধূর্ততা, ক্রোধ আর দেশপ্রেমের এক আবেগময় সংমিশ্রণ।’
শেখ মুজিবের বক্তৃতা ও দাবিগুলো ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল। মাওলানা ভাসানী স্বাধীনতাসংগ্রামে শেখ মুজিবের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মজার ব্যাপার ছিল, পশ্চিমের ছোট দলগুলো শেখ মুজিবের অবস্থান সমর্থন করে। ৮ মার্চ জামিয়ত উলেমা-ই-ইসলামের মৌলানা মুফতি মেহমুদ পাঁচ দিন পর অনুষ্ঠেয় পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট দলগুলোর একটি সভা আহ্বান করেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ওয়ালি খান যোগ দিতে পারেননি কিন্তু ওই উদ্যোগকে সমর্থন করেছিলেন। নেতারা শেখ মুজিবের দাবি চারটি মেনে নেন এবং কেন্দ্র ও প্রদেশগুলোয় অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। তাঁরা সাংবিধানিক বিষয়ে আগাম সমঝোতা নিয়ে ভুট্টোর একগুঁয়েমির সমালোচনা করে বলেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে যেকোনো পরামর্শ বিবেচনা করার কথা শেখ মুজিব ‘পরিষ্কার ভাষায় নিশ্চিত’ করেছেন। তাঁরা ইয়াহিয়াকে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে ‘ভুল-বোঝাবুঝি, আশঙ্কা ও সন্দেহ’ দূর করার আহ্বান জানান।
একঘরে হয়ে পড়বেন, বুঝতে পেরে ভুট্টো ১৪ মার্চ করাচিতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর নিজের দেওয়া বিবরণ অনুসারে ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেছিলেন যে শেখ মুজিবের সামরিক আইন তুলে নেওয়ার এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তাঁর দলের কাছেও গ্রহণযোগ্য, তবে তার প্রক্রিয়া ‘সাধারণ সমঝোতার ভিত্তিতে নির্ণয় করতে হবে।’ ঘটনা-পরবর্তী বিশ্লেষণ থেকে এটা পরিষ্কার যে তাঁর নিজের চাপানো দোষ কাটানোর জবানিতে যা রয়েছে, ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিষয় তার চেয়েও বেশি ছিল। ওই দিনই এক বিশাল সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি পূর্বে আওয়ামী লীগের কাছে এবং পশ্চিমে পিপিপির কাছে ক্ষমতা দেওয়ার আহ্বান জানান। দুই দল তারপর পাকিস্তানের একটি ‘সার্বিক’ সংবিধান রচনা করবে। উর্দু সংবাদপত্রে তাকে উদ্ধৃত করা হয় ‘ইধার হাম, উধার তুম’ (এই কূলে আমি ওই কূলে তুমি)। তার মানে প্রকৃত অর্থে ভুট্টো সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবির বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ, তা তাঁর প্রধান মিত্র সামরিক নেতৃত্বকে দুর্বল করে দেবে।