মতামত

মোদি সরকারের অর্জন যেভাবে ঢাকা পড়ে গেছে

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার গত সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবন উদ্বোধন করেছে। গত ৯ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে মোদি ও তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যে ‘নতুন ভারত’-এর স্বপ্নের কথা বলে যাচ্ছে, এই নতুন ভবনকে সেই স্বপ্নের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এই ভবন বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ২০টি বিরোধী দল উদ্বোধন অনুষ্ঠান বয়কট করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান অমেরামতযোগ্য সম্পর্কের আরও একটি লক্ষণ ফুটে উঠেছে।

বিরোধী দলের সদস্য হিসেবে আমি নিজেও ভারত সরকারের নীতি, বাকসর্বস্ব কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মোদি যেকোনো বিশ্বনেতার চেয়ে বেশি পাত্তা উপভোগ করে থাকেন। আমরা যখন একটি নির্বাচনী বছরের শুরুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, সে মুহূর্তে এই সমর্থনের উত্সগুলো বিবেচনা করা দরকার।

মোদি সরকার কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন দাবি করতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো হলো, দ্রুতগতিতে নতুন বিমানবন্দর, বন্দর–মহাসড়কসহ অত্যধিক প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ। সুবিন্যস্ত পদ্ধতি, দ্রুত অনুমোদন এবং বেসরকারি ঠিকাদারদের ওপর ব্যাপক নির্ভরতার মাধ্যমে এসব অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব হয়েছে।
অবকাঠামো নির্মাণের তেজিভাব ভারতের অনেক অংশের চেহারা বদলে দিয়েছে এবং নতুন বৃহৎ বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রেলওয়ে নেটওয়ার্ক হিসেবে অনেক আগেই প্রতিষ্ঠা পাওয়া ভারতীয় রেলওয়ের আধুনিকীকরণের কাজ এগিয়ে চলেছে। সরকার কোটি কোটি ভারতীয় দরিদ্র মানুষের জন্য তৈরি করা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকেও শক্তিশালী করেছে।

যদিও ২০১৪ সালে পূর্ববর্তী সরকারের জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর সময় মোদি দাবি করেছিলেন, সেগুলোর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপব্যয় হয়েছে এবং দরিদ্র মানুষকে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে অভ্যস্ত করেছে; কিন্তু তাঁর সরকার পাকা শৌচাগার, রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার, কৃষকের হাতে নগদ টাকা সহায়তা হিসেবে পৌঁছে দেওয়া এবং গ্রামীণ অঞ্চলে বিদ্যুৎ ও খাবার পানি পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

তবে এ ধরনের উদ্যোগ সর্বাংশে সফল হয়নি। শৌচাগারগুলোয় পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি; নারীরা তাঁদের হেঁশেলের গ্যাস সিলিন্ডার রিফিল করার সামর্থ্য রাখছেন না; বিদ্যুৎ সরবরাহও অনিয়মিত। তবে এ সরকার সন্দেহাতীতভাবে গ্রামীণ জীবনমান উন্নত করতে পেরেছে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলীয় ‘হিন্দি বেল্টের’ দরিদ্র রাজ্যগুলোয়। মোদি সরকার প্রযুক্তির প্রসারেও লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। সস্তায় ডেটা সুবিধা দেওয়ায় ভারতে স্মার্টফোনের যে প্রসার ঘটেছে, তা প্রায় ১০০ কোটি ভারতীয়কে ইন্টারনেট জগতের সঙ্গে যুক্ত করেছে।

যখন একজন পাকিস্তানি ভিডিও ব্লগার ভারতের রাস্তার পাশের দোকানদারদের চায়ের গাড়িতে পেটিম কিউআর কোড (ডিজিটাল পদ্ধতিতে মূল্য পরিশোধের উপায় বিশেষ) অফার করতে দেখে কিংবা পাকিস্তানের ব্যাংকাররা ভারতের ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস (যা সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মধ্যে অর্থ স্থানান্তর করে) দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন, তখন ভারত বিশ্বব্যাপী গৌরব বোধ করে। সামাজিক সুরক্ষা খাতের অর্থ সরাসরি সুবিধাভোগীদের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সরকার এই অর্থপ্রবাহের ‘লিকেজ’ হ্রাস করার যে দাবি করে থাকে, সেটিও বেশ বিশ্বাসযোগ্য।

কিন্তু সব সাফল্য অনেক কম প্রশংসনীয় নীতির কারণে আড়ালে চলে গেছে। বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদকে (যা ইতিহাসের সংকীর্ণ ব্যাখ্যাকে উৎসাহিত করে এবং ভারতের সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের খারাপভাবে উপস্থাপন করে) ভারতীয় সমাজের শিরায় প্রবেশ করা বিষের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু একমাত্র নেতা, যিনি টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী পদে জয়ী হয়েছিলেন। আগামী বছরের ভোটে ভারতবাসী মোদির কাজের মিশ্র রেকর্ডটি চিন্তার বাটখারায় ওজন করবেন এবং নেহরুর পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে আনা যায় কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

সংঘ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বিজেপি নেতারা ও তাঁদের অনুগামীরা নিয়মিত উত্তেজনাকর ও বিভেদমূলক বক্তব্য ছড়াচ্ছেন এবং অবাক হওয়ারও কিছু নেই যে এসব বক্তব্যের কারণে সহিংসতা বেড়েছে। ইতিমধ্যেই তথাকথিত গোরক্ষকদের হাতে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক পিটুনির শিকার হয়েছেন এবং বড়দিনের মৌসুমে কিছু খ্রিষ্টানও মারধরের শিকার হয়েছেন।

যদিও ভারতে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়ে থাকে, তবে সম্প্রতি ভোটে গণতন্ত্রবিরোধী কিছু প্রবণতা ঢুকে পড়েছে। সরকারি নীতির সমালোচনাকারীর গায়ে ‘দেশবিরোধী’ তকমা সেঁটে দেওয়া হয়। কর সংস্থাগুলো এবং পুলিশ বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছে এবং সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের, বিশেষ করে মুসলমান বিক্ষোভকারীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আক্ষরিক অর্থে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যাকে সবাই ‘বুলডোজার বিচার’ বলে জানে।

উপরন্তু, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসিত চরিত্রও দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিচার বিভাগ পর্যন্ত চাপের মুখে পড়েছে। পার্লামেন্ট সরকারি সিদ্ধান্ত পাস করার একটি বুলেটিন বোর্ডে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক নীতিতেও মোদি সরকার অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। পরিবহন পরিকাঠামো এবং প্রযুক্তির বিস্তারের মতো ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করলেও ভারতকে স্কুলিং, দক্ষতা উন্নয়ন, স্যানিটেশন এবং জনস্বাস্থ্য পরিচর্যা সুবিধাসহ অনেকগুলো ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করতে হবে।

একইভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষের কাছে পৌঁছাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। বেকারত্ব রেকর্ড উচ্চতায় ঠেকেছে এবং নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৬ সালের বিপর্যয়কর ব্যাংক নোট বাতিলের পর অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাঁদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন কৃষকেরা আয় কমে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ কর্মসূচিসহ অনেক প্রয়োজনীয় কল্যাণমূলক কর্মসূচির বাজেট বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। স্বজনতোষী পুঁজিবাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

কোভিড-১৯ সংকটের সময় মোদি সরকারের পরিস্থিতি মোকাবিলাও প্রত্যাশাকে ছুঁতে পারেনি। যদিও ভারতীয় নাগরিকদের শেষ পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু লকডাউনের মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার ছবি এখনো দেশবাসীকে তাড়া করে ফেরে। করোনায় ৫০ হাজারের কম লোক মরেছে বলে সরকারের দিক থেকে দাবি করা হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান, প্রকৃত সংখ্যা এর ১০ গুণের বেশি, যা সরকারি পরিসংখ্যানের নির্ভরযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে হিমালয় অঞ্চলে চীনের অনুপ্রবেশের ঘটনা মোকাবিলায় মোদি সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। চীন অথবা পাকিস্তান (অথবা উভয়কেই) মোকাবিলায় ভারতের প্রস্তুতি কতখানি যথার্থ, তা মোটেও স্পষ্ট নয়। ২০১৫ সালে ফরাসি কোম্পানি দাসাউ অ্যাভিয়েশনের কাছ থেকে ৩৬টি রাফাল যুদ্ধ বিমান কেনার চুক্তিতে অনিয়ম থাকার বিষয় নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়ে গেছে।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু একমাত্র নেতা, যিনি টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী পদে জয়ী হয়েছিলেন। আগামী বছরের ভোটে ভারতবাসী মোদির কাজের মিশ্র রেকর্ডটি চিন্তার বাটখারায় ওজন করবেন এবং নেহরুর পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে আনা যায় কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির এমপি ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব।