উন্নত ও আলোকিত জাতি গঠনের প্রধান উপকরণ শিক্ষা। শিক্ষাই দিতে পারে অন্ধকার গহ্বর থেকে সম্পূর্ণ একটি জাতিকে আলোর দিশারা। উন্নত শিক্ষা জাতিকে যেমন শক্তিশালী জাতি হিসেবে গঠনে সাহায্য করে; তেমনি শিক্ষাব্যবস্থা দুর্বল হলে সেই জাতির ধ্বংস অনিবার্য।
আমাদের দেশে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর ক্যাম্পাস ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে গোটা দেশে। কলেজগুলোর মাধ্যমেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়টির ২ হাজার ২৮৩টির বেশি অধিভুক্ত কলেজে অধ্যয়ন করেন ২৮ লাখের বেশি শিক্ষার্থী।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন চলছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম? চার বছর মেয়াদি অনার্স কোর্সসহ ডিগ্রি, মাস্টার্স কোর্স কি যথাসময়ে সম্পন্ন হচ্ছে? প্রশ্নের উত্তর—না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চার বছরের অনার্স কোর্স সম্পন্ন হতে ছয়-সাত বছর লেগে যায়। তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, তাহলে সেই কোর্স চার বছর মেয়াদি হলো কীভাবে?
অথচ আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্স কোর্স সম্পন্ন হয় চার-পাঁচ বছরের মধ্যে। দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের কলেজ অধ্যয়নরত একই বর্ষের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ হয়নি; অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ হয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এত বড় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের শেষ কোথায়?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করে অনেকে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। অথচ একই বর্ষের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ হয়নি বলে কোনো চাকরিতে আবেদনের সুযোগ পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ আইনে সরকারি বা বেসরকারি চাকরির একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা থাকায়, তারা চাকরি পাওয়ার সুযোগ থেকে কয়েক ধাপ পেছনে পড়ে যান। কেন একই দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় দুই নীতি?
বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবার নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। এসব পরিবারের অনেক ছাত্র-ছাত্রী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা সেশনজটের এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে তাঁরা চাকরিতে আবেদন করতে পারেন না। তাই পরিবারের হাল ধরতেও দেরি হয়ে যায়। পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতে পারেন না বলে তাঁদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করে।
অপরদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সেশনজট না থাকায় তাঁরা সরকারি বা বেসরকারি চাকরি করে পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করছেন। তাঁরা দ্রুত স্বনির্ভর হয়ে পরিবার ও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ভূমিকা পালন করে আসছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক লাখ শিক্ষার্থী যথাসময়ে কর্মস্থলে যুক্ত হতে পারেন না, যা একটি দেশের অর্থনীতির চাকা শ্লথ করে রাখার মতো। রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন—জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কি দেশের জনশক্তি নয়?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম–নীতির বেশ কিছু পরিবর্তনশীল পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতিতে দেখা যায়, এক বর্ষের পরীক্ষা নেওয়ার পর অন্য বর্ষের পরীক্ষা নিয়ে থাকে, ফলে সেশনজট সৃষ্টি হয়। সব বর্ষের ইনকোর্স, টেস্ট, ফাইনাল পরীক্ষা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিশ অনুযায়ী হয়ে থাকে।
ফলে তাদের কার্যক্রম বিশাল। এ অবস্থা থেকে নিরসনের উপায় কী? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম কয়েকটি আলাদা বিভাগে স্থানান্তর করা। যে বিভাগ প্রথম বর্ষ নিয়ে কাজ করবে, তারা শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সব কলেজের প্রথম বর্ষ নিয়ে কাজ করবে। তারা শুধু প্রথম বর্ষের ভর্তি, ইনকোর্স, টেস্ট, ফাইনাল সব কার্যক্রম একটি বর্ষে নিয়ে থাকবে। আর এভাবে পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ বর্ষ, মাস্টার্সসহ ডিগ্রি কোর্সগুলো একই নিয়মে পরিচালিত হবে। প্রতিটি বর্ষে কর্মরত কর্মী-সহকর্মীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রতিটি বর্ষের কার্যক্রম এক বছরের মধ্যেই শেষ করার।
সময় অনুযায়ী ইনকোর্স, টেস্ট, ভর্তি, ফাইনাল পরীক্ষার নোটিশ ঘোষণা করে কার্যক্রম সম্পন্ন করে ফেলা। ফলে সেশনজট কমানো সম্ভব। সেশনজট না থাকলে দেশের কয়েক লাখ শিক্ষার্থী অযথা যেমন বসে থাকবেন না, কোনো না কোনো কর্মে যুক্ত হবেন; তেমনি হতাশা থেকে বের হবেন। যথাসময়ে চাকরির জন্য আবেদন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন না। বেকারত্ব, হতাশা, আত্মহত্যা এসব বিষয় থেকে তাঁরা বেরিয়ে আসবেন।
সেশনজট নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরি। কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এই আশা করি।
মরিয়ম সেতু
শিক্ষার্থী, সৈয়দ আশরাফ পৌর মহিলা সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ