নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও শিক্ষার্থী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

চার বছর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশজুড়ে চলছিল স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চুম্বক দিকগুলো কী ছিল? এ আন্দোলন দেশের কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়টি কীভাবে সামনে নিয়ে আসে?

বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিকেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতির পুরোপুরি বাইরে থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনটি শুরু হয়। এমন ব্যতিক্রম ধারার শিক্ষার্থী আন্দোলন অবশ্য বাংলাদেশে নতুন নয়। ২০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে সেনা ক্যাম্প উঠিয়ে নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করেন, যা পরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন এবং রানা প্লাজা ধসের পরবর্তী সময়ে শ্রমিকদের উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের পেছনে শিক্ষার্থীরা ছিলেন অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন কিংবা ২০২১ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ প্রমাণ করে যে আমাদের কিশোর-তরুণদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যথেষ্ট গভীর এবং প্রয়োজন পড়লে দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নামতেও তাঁরা প্রস্তুত।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা তাঁদের আন্দোলনের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সড়ক দুর্ঘটনাগুলো আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। এ দুর্ঘটনাগুলো সমাজের ঘুণে ধরা প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মাণ করা একেকটি হত্যাকাণ্ড।

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা অভিনব কিছু কাজ করেন। যেমন তাঁরা আমাদের প্রথাগত ‘সড়ক দুর্ঘটনার’ ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করেন। বাংলা একাডেমির অভিধানের সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘দুর্ঘটনা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো ‘আকস্মিক ও অমঙ্গলজনক ঘটনা’। রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতা অতীতে বারবার এ দেশের দুর্ঘটনাগুলোর ‘আকস্মিকতার’ ওপরে বেশি জোর দিয়েছেন।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকায় দুই বাসের যাত্রী ধরার বেপরোয়া প্রতিযোগিতার কারণে দুই কলেজশিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এ দুর্ঘটনার সঙ্গে ভারতের মহারাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে পড়ে গিয়ে ৩৩ জন মারা যাওয়ার ঘটনা তুলনা করেন। তিনি বলেন, ভারতে দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের মতো প্রতিক্রিয়া হয় না। এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মানুষদের একটি প্রবণতা হচ্ছে ধরেই নেওয়া যে দুর্ঘটনা ঘটাটাই স্বাভাবিক।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা তাঁদের আন্দোলনের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সড়ক দুর্ঘটনাগুলো আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। এ দুর্ঘটনাগুলো সমাজের ঘুণে ধরা প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মাণ করা একেকটি হত্যাকাণ্ড। শিক্ষার্থীদের নয় দফা দাবির মধ্যে শুধু শাজাহান খানের ক্ষমা চাওয়ার দাবিই ছিল না; তাঁরা সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য কাঠামোগত পরিবর্তন দাবি করেন। এসব দাবিদাওয়ার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনার দায়ভার যে রাষ্ট্র এবং সরকারেরও, এ বিষয় তাঁরা সামনে নিয়ে আসেন। তাঁদের হাতে লেখা প্ল্যাকার্ডগুলোর শক্তিশালী বার্তা সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। ‘আমরা ৯ টাকায় ১ জিবি চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘রাস্তা বন্ধ, মেরামতের কাজ চলছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’, ‘শিক্ষকের বেতের বাড়ি নিষেধ যে দেশে, পুলিশের হাতে লাঠি কেন সে দেশে?’, ‘ছাত্রদের আপাতত রাস্তা সামলাতে দিন। মন্ত্রী-পুলিশকে স্কুলে পাঠান শিক্ষিত করতে’—এ ধরনের প্ল্যাকার্ডগুলো নামকাওয়াস্তের গণতন্ত্র, পুলিশি রাষ্ট্র এবং তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ ও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর আখ্যানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল (আমাদের নতুন সময়, ৩ আগস্ট ২০১৮)।

শিক্ষার্থীদের এ প্রতিবাদ নেতাবিহীন আন্দোলনের অপার সম্ভাবনাকে সামনে তুলে ধরে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থীর মন্তব্য ছিল, ‘আমাদের নেতাও নাই, কমিটিও নাই। সহজে তুলে দিতে পারবে না’ (আহমেদ ২০১৯)। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের ওপরে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ব্ল্যাক লাইভস মেটার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অ্যালিসিয়া গার্জার ভাষায়, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ ও জটিল। তাই একটি কণ্ঠ অনুসরণ করার সামর্থ্য আমাদের নেই।’ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনও ব্ল্যাক লাইফস মেটারের মতো নিচ থেকে উঠে আসা তৃণমূল বিদ্রোহের আদল অনুসরণ করেছিল। কোনো নির্দিষ্ট বা একক নেতা না থাকায় এ আন্দোলনকে কবজা বা নিয়ন্ত্রণ করা ক্ষমতাবানদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা এবং তাঁদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা শিক্ষার্থীদের বারবার ‘কিশোর’, ‘নিষ্পাপ’ ইত্যাদি হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং এজেন্সিকে অস্বীকার করেন। বয়স কম বলেই যেন এই শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকলাপ বোঝার ক্ষমতা নেই। তাঁরা যেন খুব সহজেই ‘তৃতীয় পক্ষের’ ইন্ধনের শিকার হন। শিক্ষার্থীরাও অত্যন্ত সৃজনশীল উপায়ে তাঁদের শিশু বা অপরিপক্ব বা নিষ্পাপ হিসেবে আখ্যায়িত করাকে আন্দোলনের পক্ষে ব্যবহার করেছিলেন। বিভিন্ন ইন্টারভিউতে আমরা শিক্ষার্থীদের বারবার বলতে শুনেছি, একটু বিবেক থাকলেও মানুষ বুঝবে আন্দোলনকারীরা তাদেরই সন্তান এবং সাময়িক কিছু অসুবিধা হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সর্বজনের জন্য। শিক্ষার্থীরা যে বোধ-বুদ্ধিবিহীন, অপরিপক্ব বা অবিবেচক সন্তান নন, সেটাও খুব সুন্দর করে তাঁরা রাজপথে নেমে সুশৃঙ্খলভাবে ট্রাফিক পরিচালনা করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর খসড়া অনুমোদনের পর সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয় যে সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমের তারকা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীরা বারবার শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু ‘সরকার দাবি মেনে নিয়েছে’ বলার মাধ্যমে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের বিশাল প্রতিবাদী ব্যাপ্তিকে উপেক্ষা করে একে নয় দফার মধ্যে সংকুচিত করে ফেলেন। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ নয় দফার ঊর্ধ্বে উঠে ডিজিটাল বাংলাদেশে তথাকথিত উন্নয়নের আখ্যান এবং পুলিশি রাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ওপরে চলেছিল পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলা। আক্রমণকারীদের গ্রেপ্তার করার পরিবর্তে পুলিশ কয়েক হাজার আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে মামলা করে (গার্ডিয়ান, ৫ আগস্ট ২০১৮)।

আন্দোলনকারীদের ৮৬ জনকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে পাস করা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮, যেটি ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের চেয়েও অনেক কঠোর ছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সাল পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, অ্যাকটিভিস্ট, শিক্ষার্থীসহ ৪৩৩ জন গ্রেপ্তার ও জেলবন্দী হয়েছেন (স্ক্রল ইন, ২৭ জুলাই ২০২১)।

জাতীয় সংসদে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ পাস হলেও আইনটির বাস্তবায়ন হতে না হতেই পরিবহনশ্রমিকদের সংগঠন ধর্মঘট ডাকে। ২০২১ সালে পরিবহন ব্যবসার মালিক-শ্রমিকনেতাদের চাপে এ আইনের ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি সংশোধন করে শিথিল করা হয় (ডেইলি স্টার, ৩১ আগস্ট ২০২১)।
এত কিছুর পরেও ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন কতটা শক্তিশালী হতে পারে, তার একটি জ্বলজ্বলে উদাহরণ তৈরি করে। এই শিক্ষার্থীরা সড়ক দুর্ঘটনা যে নিছক দুর্ঘটনা, তা মানতে নারাজ। তাঁরা রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্নীতি এবং ব্যর্থতা কীভাবে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে, তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। তাঁরা উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ আর পুলিশি রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতে পিছপা হন না। তাঁদের কোনো নেতার প্রয়োজন হয় না। তৃণমূল পর্যায়ে একদম নিচ থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে অভিনব কৌশলে তাঁরা আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিতে জানেন। এই কিশোর-তরুণদের প্রতিবাদী রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং সত্তাকে যদি আমরা লালন ও ধারণ করতে পারি, তবেই হয়তো একদিন মুক্তির দেখা মিলবে।

  • নাফিসা তানজীম সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজ, উস্টার স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র। ই-মেইল: ntanjeem@worcester.edu.