বাংলাদেশে যতবার দারিদ্র্য-মানচিত্র প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিবারই রংপুর অঞ্চল ছিল পিছিয়ে। রংপুর আলাদা বিভাগ হওয়ার পর থেকে বিভাগ হিসেবে রংপুর দারিদ্র্যের শীর্ষে আছে। রংপুরের দারিদ্র্য কমলেও উন্নয়নবৈষম্য কমেনি। ২০১০ সালের দারিদ্র্য-মানচিত্রে দেখা যায়, সারা দেশের গড় দারিদ্র্য প্রায় ৩১ শতাংশ। সেই বছরে রংপুর বিভাগের গড় দারিদ্র্য ছিল ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৬ সালের দারিদ্র্য-মানচিত্রে দেখা যায়, গড় দারিদ্র্য ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ওই বছরে রংপুর বিভাগের গড় দারিদ্র্য ৪৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১০ সালের পর ২০১৬ সাল পর্যন্ত সারা দেশে গড় দারিদ্র্য কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ আর রংপুর বিভাগে দারিদ্র্য বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।
বৈষম্য অকল্পনীয় হারে বাড়ছে। রংপুর বিভাগের সঙ্গে ঢাকা বিভাগের বৈষম্য তিন গুণ। ঢাকা বিভাগের দারিদ্র্য ১৬ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ৪৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। কুড়িগ্রাম জেলার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলার ব্যবধান প্রায় ২৮ গুণ। নারায়ণগঞ্জে ২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং কুড়িগ্রামে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০০ গুণ বৈষম্য রাজীবপুর উপজেলার সঙ্গে গুলশানের। গুলশানে দারিদ্র্য দশমিক ৪ শতাংশ এবং রাজিবপুরে ৭৯ শতাংশ। কোভিড–১৯ এবং অর্থনৈতিক মন্দা রংপুর অঞ্চলের মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে।
২০১৯ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে রংপুর বিভাগের ২ কোটি মানুষের জন্য ১ শতাংশের কম বরাদ্দ ছিল। মেগা প্রকল্প বাদ দিলে মাত্র শূন্য দশমিক ৯৮ শতাংশ বরাদ্দ ছিল রংপুর বিভাগের জন্য। মেগা প্রকল্পসহ হিসাব করলে সেই বরাদ্দ আধা শতাংশে নেমে আসবে। এ অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের উন্নয়নবৈষম্য বৃদ্ধির এটিও কারণ। রংপুর বিভাগে একটিও মেগা প্রকল্প নেই।
চলতি বছরের বাজেট রংপুর অঞ্চলের বৈষম্য আরও অনেক গুণ বৃদ্ধি করবে। এই আশঙ্কারও নির্দিষ্ট কারণ আছে। সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে বাজেট–বিষয়ক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলে দারুণ বিশ্লেষণ হয়েছে বাজেট নিয়ে। এই সেমিনারে বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোরশেদ হোসেন যে তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন, সেখানেই বোঝা যায়, রংপুর বিভাগ কী পাচ্ছে চলতি বাজেটে।
দেশের খাদ্য জোগানদাতা হিসেবে নাম থাকবে রংপুর বিভাগের আর উন্নয়নের তলানিতে পড়ে থাকবে, এটি মেনে নেওয়ার দিন হয়তো ফুরিয়ে এসেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও আজকাল বৈষম্য নিয়ে আলোচনা হয়। এ আলোচনাই একদিন সংগঠিত হবে এবং বৈষম্যনীতি পরিহার করতে সরকারকে বাধ্য করবে। সরকারের উচিত তার আগেই বৈষম্য দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ধরে অধ্যাপক মোরশেদ হোসেনের তৈরি করা তুলনামূলক চিত্রে দেখলাম, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ যত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে, সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যত শহরে ওয়াসার কার্যক্রম আছে, সেসব স্থানেও হাজার হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ। রংপুরে যেহেতু কোনো উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং ওয়াসার কার্যক্রম নেই, তাই এসব বরাদ্দ থেকে রংপুর বঞ্চিত।
দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম বরাদ্দ রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য। ২০৫ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য বরাদ্দ নামমাত্র। সাবেক মেয়র শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু মারা গেছেন। জীবদ্দশায় অসংখ্যবার বলে গেছেন, রংপুর সিটি করপোরেশন নতুন, এখানে নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি করতে হলে বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন। সেই বিশেষ বরাদ্দ তো দূরের কথা, সাধারণ বরাদ্দও সবচেয়ে কম এখানকার জন্য।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১টি সিটি করপোরেশনে প্রায় ৫ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তখন রংপুর সিটি করপোরেশনে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৪৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ১১টি সিটি করপোরেশনের জন্য মোট বরাদ্দ প্রায় একই পরিমাণ। কিন্তু রংপুর বিভাগের বরাদ্দ গত অর্থবছরের চেয়ে অর্ধেকের বেশি কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে ১৭ কোটি ৭ লাখ টাকা মাত্র।
গত অর্থবছরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে বরাদ্দ ছিল ২০০ কোটি টাকা। আয়তনে রংপুরের চার ভাগের এক ভাগ এই সিটি করপোরেশনে চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ৫০০ কোটি টাকা। রংপুর সিটি করপোরেশনের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি। আয়তনভিত্তিক প্রতি বর্গকিলোমিটারে কুমিল্লায় বরাদ্দ ১২০ গুণ বেশি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ৯৯১ কোটি টাকা। সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে সম্ভবত রংপুরের নিজস্ব আয় সবচেয়ে কম। এ কারণে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন ছিল রংপুরকে।
দেশে মোট অর্থনৈতিক অঞ্চল সরকারি-বেসরকারি মিলে ৯৭টি। রংপুর বিভাগের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তাব করা হয়েছে মাত্র চারটি। বিভাগের আয়তন, জনসংখ্যা এবং প্রয়োজনের হিসাব করলে এখানে অন্তত ২০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়া প্রয়োজন। রংপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুরের অর্থনৈতিক অঞ্চল বলা যায় ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রংপুর বিভাগে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল নেই। সরকারের কাছে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের প্রণোদনার দাবি ছিল। রংপুরে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠায় সরকার যদি বিশেষ প্রণোদনা দেয়, তাহলে এখানে অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে পারে। সেই আশা দুর্দশামাত্র।
অনেকেই মনে করেন, ১৯৯১ সালের পর ২০০৬ সাল পর্যন্ত রংপুর বিভাগের অধিকাংশ সংসদ সদস্য সরকারদলীয় ছিলেন না। সে কারণে এখানে উন্নয়ন আশানুরূপ হয়নি। তা–ই যদি হবে, তাহলে ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এ অঞ্চলের সংসদ সদস্যরা প্রধানত সরকারদলীয়। তারপরও এখানে প্রতিবছর কেন উন্নয়নবৈষম্য বাড়ছে? বোঝা যায়, কেবল রাজনৈতিক কারণে এখানে উন্নয়ন থেমে গেছে তা নয়; যখন, যারাই দেশ পরিচালনায় থাকুক না কেন, রংপুরের উন্নয়নবৈষম্য দূর হবে না।
ভাবতে অবাক লাগে, দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলের বৈষম্য দূরীকরণে আমরা কোনো নেতা পেলাম না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন যে কটি কারণে, তার মধ্যে অন্যতম বৈষম্য দূর করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর আর কাউকে পাওয়া যায়নি, যিনি দেশের উন্নয়নবৈষম্য দূর করবেন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছি বৈষম্য দূরীকরণ মন্ত্রণালয় গঠন করা হোক। কয় দিন আগে অধ্যাপক মোরশেদ হোসেন বলেছেন, রংপুরকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য রংপুর উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা প্রয়োজন।
রংপুরের মানুষ প্রজন্মপরম্পরায় চরমতম বৈষম্যনীতি মেনে নিয়ে চলবে—এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। রংপুর বিভাগে চার কোটি মানুষের খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। দেশের খাদ্য জোগানদাতা হিসেবে নাম থাকবে রংপুর বিভাগের আর উন্নয়নের তলানিতে পড়ে থাকবে, এটি মেনে নেওয়ার দিন হয়তো ফুরিয়ে এসেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও আজকাল বৈষম্য নিয়ে আলোচনা হয়। এ আলোচনাই একদিন সংগঠিত হবে এবং বৈষম্যনীতি পরিহার করতে সরকারকে বাধ্য করবে। সরকারের উচিত তার আগেই বৈষম্য দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক
ই–মেইল: wadudtuhin@gmail.com