সুন্নিদের অবশ্যই শিয়াদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে এবং শিয়াদের অবশ্যই সুন্নিদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে—বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমারা এই মন্ত্র ছড়াচ্ছে।
আপনি যদি অল্প কিছুদিন মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে নজর দেন, তাহলে দেখবেন, পশ্চিমা দেশগুলো এবং তাদের মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি-শিয়া বিভেদকে অতিরঞ্জিত করে দেখায় এবং পরস্পরকে অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে। এই ধারণা পশ্চিমা রাজনৈতিক নেতারা, পশ্চিমা ধারার গবেষণা প্রতিষ্ঠান (থিঙ্কট্যাংক), মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারীরা এবং বিশেষভাবে নির্বাচিত ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এর ফলে অঞ্চলটিতে সংঘাত বাড়তে থাকে এবং এসব পক্ষ যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা মৃত্যু ও ধ্বংসের কারবারি হিসেবে কাজ করছে।
মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আবার খারাপ হচ্ছে। আগে থেকেই এই অঞ্চলের শাসকশ্রেণির পক্ষ নেওয়া ঔপনিবেশিক শক্তি ও প্রাচ্যবাদী চিন্তাবিদেরা পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
তারা পুরোনো ঘায়ের ওপর নতুন করে নুনের ছিটা দিচ্ছে। এটি অনেক প্রজন্ম ধরে চলে আসা সমস্যাগুলোকে আরও গভীর করে তুলছে।
তারা এমনভাবে ‘সুশি তত্ত্ব’ (শিয়া-সুন্নি বিভেদকে অতিরঞ্জিতভাবে তুলে ধরে দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ককে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা) আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে এমনভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে চান, যাতে মনে হবে, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা এবং বিংশ ও একবিংশ শতকে আরব ও মুসলমানদের ওপর রাখঢাক না করে চালানো হামলা যথেষ্ট ছিল না।
তারা তাদের এই ‘সুশি তত্ত্ব’ দিয়ে আরব অঞ্চলের সমস্যাগুলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
পশ্চিমা দেশগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে সুন্নি-শিয়া বিভেদ বাড়িয়ে তুলে তাদের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ, জায়নবাদী সহিংসতা এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিদেশি হস্তক্ষেপকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে।
এখানে নতুন ও পুরোনো ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এখানে সংঘাত যাতে চলতেই থাকে, সে জন্য অনেক শক্তি ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক কাজ করে যাচ্ছে।
যে কেউ একই সঙ্গে ইসলামি ইতিহাস–সম্পর্কিত তাঁর ব্যক্তিগত বোঝাপড়া এবং যেসব বিষয়ে নিজেদের মধ্যে (ধর্মীয়, রাজনৈতিক, জাতিগত ইত্যাদি দিক থেকে) বিভাজন আছে সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারে। একই সময়ে তিনি নিজের মতের বিরুদ্ধে থাকা লোকদের সঙ্গে এক হয়ে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর বিভাজন কৌশলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন। তিনি যদি বুঝতে পারেন, তাঁর ও তাঁর নিজের লোকদের মধ্যকার বিভাজনকে ব্যবহার করে পশ্চিমারা আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তাহলে তাঁর পক্ষে বিরুদ্ধ মতের সঙ্গে এক হয়ে বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটা সহজ হয়ে যায়।
আজকের মধ্যপ্রাচ্যে যে আঞ্চলিক সংঘাত চলছে, তার মূল কারণ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল মজুত। এই তেল ও গ্যাস বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯০৮ সালে ইরানে তেলের খনি আবিষ্কারের আগে এশিয়ার বাণিজ্য রুট, কাঁচামাল এবং ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার শিল্পোৎপাদনের অতিরিক্ত পণ্য বিক্রি করার বাজারে পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান মনোযোগ ছিল।
উনিশ শতকে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বাজার দখলের জন্য ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইতালি ও বেলজিয়াম তাদের সামরিক, অর্থনৈতিক ও জ্ঞানতাত্তিক প্রভাব খাটিয়েছিল।
ঔপনিবেশিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা ‘ভাগ করো, শাসন করো’ কৌশল ব্যবহার করে সহিংসতা ও গণহত্যা চালিয়েছিল।
স্থানীয় মানুষের মতাদর্শগত বিভাজন আগে থেকেই ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিকতা এবং ইউরোপের লোভ সেই বিভাজনকে আরও গাঁজিয়ে তুলে সহিংস পরিস্থিতিতে পরিণত করেছিল।
এর ফলে সমাজগুলো নিজেদের প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো খুব সস্তায় অধিকতর প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাজার দখল করতে পেরেছে।
ধর্মকে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত, যাতে তারা সহজে ভিনদেশি সমাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
কেউ যদি ঔপনিবেশিক ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতি এবং ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ও জাতিগত পার্থক্যকে ব্যবহার করে পশ্চিমাদের ক্ষমতা বাড়ানোর কৌশলগুলো না বুঝে বৈশ্বিক দক্ষিণকে দেখে, তাহলে সে এই অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সংঘাতের মূল কারণগুলো ধরতে পারবে না।
আমাদের ভাবতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপীয় ও আমেরিকান বাহিনী কি আসলে সুন্নিদের শিয়াদের থেকে বা শিয়াদের সুন্নিদের থেকে রক্ষা করতে এসেছে? এই সামরিক ঘাঁটি এবং গোয়েন্দা তৎপরতা কি সত্যিই সুন্নি-শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি আনার জন্য?
যদি কেউ তা মনে করে, তাহলে বুঝতে হবে, এই অঞ্চলের দীর্ঘ ইতিহাস ও বর্তমান সংঘাতের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে সে একেবারেই কিছু জানে না।
পশ্চিমা ঔপনিবেশিক প্রকল্পগুলো জায়নবাদীদের বাড়বাড়ন্তে সাহায্য করেছে এবং আরব অঞ্চলে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রেখেছে। ঔপনিবেশিক শাসন চলে গেলেও, পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক, শিক্ষা এবং সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামো এখনো রয়ে গেছে।
ব্রিটিশরা যে অঞ্চলের নাম ‘মধ্যপ্রাচ্য’ দিয়েছে, সেটি উনিশ শতকের কাঠামো অনুযায়ী তৈরি হয়েছিল। এটি সাইকস-পিকো চুক্তি এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে প্যারিস শান্তি সম্মেলনের মাধ্যমে দৃঢ় করা হয়েছিল।
ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা তাদের ঔপনিবেশিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সুন্নি-শিয়া বিভাজনকে বাড়িয়ে তুলেছিল। বিশেষ করে উসমানীয় ও পারস্য অঞ্চলে তারা এই বিভেদ তীব্র করে তুলেছিল। তারা খ্রিষ্টান-মুসলিম উত্তেজনাও বাড়িয়েছিল। তারা মিথ্যা দাবি করে যে তারা পুবের দেশগুলোর খ্রিষ্টানদের সুরক্ষা দিতে এখানে এসেছিল। মূলত, তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণ করা।
বৈশ্বিক দক্ষিণের যেখানেই চোখ রাখবেন, সেখানেই দেখবেন, ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতি ব্যবহার করে পুরোনো বিরোধগুলোকে উসকে দিয়ে ধর্মীয়, জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সংঘাত সৃষ্টি করেছে যাতে তারা আক্রমণ ও হস্তক্ষেপের অজুহাত পেতে পারে।
ধর্মীয় ও জাতিগত পার্থক্য মানুষের মধ্যে থাকা স্বাভাবিক। তবে এটি বুঝতে হবে, ঔপনিবেশিক যুগে এই পার্থক্যগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখনো কীভাবে পশ্চিমাশক্তির আধিপত্য বিস্তারে এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আগেই বিদ্যমান সুন্নি-শিয়া বিভেদ উসকে দিয়েছিল। তারা উত্তেজনা বাড়িয়েছিল। দুই গোষ্ঠীর পার্থক্যগুলোকে বড় করে দেখিয়েছিল। চিন্তাবিদ ও থিঙ্কট্যাংকগুলো পশ্চিমাদের এই বিভেদমন্ত্রকে সমর্থন করে পক্ষপাতদুষ্ট নিবন্ধ লিখেছিল। মিডিয়াকে বিভেদ ছড়ানোর জন্য আর্থিকভাবে সাহায্য করা হয়েছিল।
মাথায় রাখতে হবে, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল ও গ্যাসের মজুত রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর এই সম্পদ দখলের লোভ সেখানে অস্থিরতা ছড়ানোর বড় কারণ। মার্কিন ও ইউরোপীয় করপোরেট এবং আর্থিক শক্তিগুলোর কাছে এই তেল ও গ্যাস এতই মূল্যবান যে তারা এই সম্পদকে স্থানীয় ‘আধা মানবিক জনগণের’ হাতে রাখতে চায় না। একই কথা ভেনেজুয়েলা, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সম্পদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির যে ‘সুশি তত্ত্ব’ তৈরি করা হয়েছে, তা আসলে কখনো শেষ হবে না এমন যুদ্ধের জন্য একধরনের রেসিপি।
এই তত্ত্বের মাধ্যমে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ, বিপুল সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি ও জায়নবাদের সমর্থন দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ঔপনিবেশিক রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং বৃহত্তর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এর বাইরে সুন্নি-শিয়া বিভাজনকে সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে উপস্থাপন করাকে পুরোনো প্রাচ্যবাদী ধারণাগুলোর পুনরাবৃত্তি বলা যেতে পারে।
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো বলতে চায়, এই অঞ্চলের ‘অযৌক্তিক’ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিভাজনকে পশ্চিমা ‘সভ্যতাগত পুনর্বাসন প্রকল্প’ দিয়ে ঠিক করা দরকার।
এই ধারণা বিশাল হস্তক্ষেপমূলক প্রকল্পগুলোকে সামনে আনে। এর মাধ্যমে আরব এবং মুসলিম সমাজগুলোকে পশ্চাৎপদ করে রেখে তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করা হয়।
এর মাধ্যমে সম্পদের লুটপাট মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। এর মাধ্যমে বিশ্ববাজারের শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে, লোহিত সাগরের তীরে পশ্চিমা ঘরানায় আনন্দফুর্তি করতে, মক্কার পথে হ্যালোইনের উৎসব করতে এবং মিসরের টাবার বিলাসবহুল রিসোর্টে ফুর্তিফার্তা করতে উৎসাহ দেওয়া হয়।
ঔপনিবেশিক উপদেষ্টারা এখানে এসে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ও ফাঁপা গৌরবে মোড়া আকাশচুম্বী টাওয়ার তৈরি করতে সাহায্য করবে; তারা এখানে সবচেয়ে বেপরোয়া পশ্চিমা পার্টি আয়োজন করবে; তারা সবচেয়ে তুচ্ছ খেলাধুলার প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বড় পুরস্কার দেবে যাতে আপনার নিজের মধ্যে নিজেরই বানানো নীচতার অনুভূতি কমে যায়।
যখন আপনি আপনার সমাজকে পশ্চিমা করপোরেট সমাজের কাছে বিক্রি করে দেবেন, যখন জাতীয় সম্পদের বেসরকারীকরণ করবেন, যখন আপনার সীমানা ইসরায়েলি পণ্য এবং বিনিয়োগের জন্য খুলে দেবেন, যখন প্রতিটি মার্কিন ও পশ্চিমা ইসলামবিরোধী কূটনীতিক বা মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে স্বাগত জানাবেন, তখন পশ্চিমারা ঔপনিবেশিক সুগন্ধি ছড়িয়ে দেবে, যাতে আপনার সমাজের বিকৃতিকে আপনার কাছে সুঘ্রাণবিশিষ্ট মিষ্টির মতো মনে হয়।
আপনাকে বলা হয়েছে, বিশ্ব মঞ্চে উঠতে, যারা আপনাকে আটকে রেখেছে, তারা হলো আপনার আশপাশের ‘খারাপ’ সুন্নি এবং ‘খারাপ’ শিয়া। আপনাকে বলা হয়েছে, ঔপনিবেশিকতার কাছে আপনার আত্মা বিক্রি করুন এবং আপনার নৈতিক ও ধর্মীয় বন্ধনগুলো ছিঁড়ে ফেলুন। আপনাকে বলা হয়েছে, আব্রাহাম অ্যাকর্ডস, ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ডস, ওয়াদি আরাবা চুক্তি এবং অন্যান্য চুক্তি আপনার জন্য ‘সমৃদ্ধি’ এবং ‘অন্তর্ভুক্তি’ নিয়ে এসেছে।
কিন্তু ‘আমার শত্রুর শত্রু যে ঔপনিবেশিক শক্তি, সে আমার বন্ধু’—আমাদের আগে এই ধারণাটি পরিত্যাগ করতে হবে। এর বদলে বৈশ্বিক দক্ষিণে আমাদের এই বোঝাপড়া থাকতে হবে যে ঔপনিবেশিক শত্রুবিভাজন ও শাসনের কৌশল ব্যবহার করে আমাদের দুজনেরই ক্ষতি করেছে। সুতরাং সে আমাদের দুজনেরই শত্রু।
হাতেম বাজিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম স্বীকৃত মুসলিম লিবারেল আর্টস কলেজ জয়তুনা কলেজের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ইসলামিক আইন ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ