মতামত

গাজার বিপর্যয় অবসানে কি কোনো পথ নেই

‘গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’
‘গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’

হামাসের চালানো হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল যে সামরিক প্রতিক্রিয়ায় দেখিয়েছে, তাতে প্রায় ৩ হাজারের মতো ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। চলমান পরিস্থিতি ফিলিস্তিনিদের দুঃসহ দুঃস্বপ্নকে আরও উসকে দিয়েছে।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি হামলা থেকে প্রাণে বাঁচতে আমার বাবা, চাচা ও দাদীসহ সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। সে সময় ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের ঘোষণা এসেছিল এবং ফিলিস্তিনের বহু শহর ও গ্রামকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আমার চাচা আমার বাবা ও দাদিকে আশ্বস্ত করেছিলেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তারা সবাই আবার বাড়িতে ফিরতে পারবেন। বাড়িটি তালাবদ্ধ করে যাওয়ার সময় তাঁর বিশ্বাস ছিল, সবাই আবার সেখানে ফিরতে পারবেন। কিন্তু আর ফেরা সম্ভব হয়নি।

আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের ভয়াবহতার মুখে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। সেটি তাঁদের এতটাই আতঙ্কিত করেছিল যে, তাঁরা ওই ঘটনার নাম দিয়েছেন ‘নাকবা’ (মহা মুসিবত) এবং প্রতি বছর ১৫ মে দিনটিকে তাঁরা ‘নাকবা দিবস’ হিসেবে স্মরণ করে থাকেন।

২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা থেকে একপক্ষীয় সিদ্ধান্তে সরে এলেও ২০০৭ সাল থেকে গোটা গাজাকে ঘিরে রেখে তারা উপত্যকাটিকে একটি উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করেছে। এখন অনেক ইসরায়েলি বলা শুরু করেছেন, ইসরায়েলের পুরো গাজাকেই দখল করে নেওয়া দরকার। সেটি হলে আরও একটি ভয়ংকর সহিংসতা হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এ মাসের গোড়ার দিকে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ড্যানি আয়ালোন আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মিসরের সিনাই উপদ্বীপে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের জন্য ‘অসীম জায়গা’ রয়েছে এবং সেখানে তাদের চলে যাওয়া উচিত। তাঁর এই কথায় অনেক ফিলিস্তিনি দ্বিতীয় নাকবার উসকানি দেখতে পাচ্ছেন।

ইসরায়েলিরা উত্তর গাজার ১১ লাখ বাসিন্দাকে তাদের বসতি ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দিয়েছে। এতে ফিলিস্তিনিরা দ্বিতীয় নাকবার আতঙ্কে পড়েছেন। গাজা বরাবরই ইসরায়েলের গলার কাঁটা হয়ে আছে। ১৯৯২ সালে তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন বলেছিলেন, ‘যদি কোনো দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম গাজা সাগরে ডুবে গেছে, তাহলে বড় ভালো লাগত।’

এর এক বছর পর রবিন হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে পিএলওর চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে করমর্দন করে অসলো চুক্তিতে সই করেন। দুঃখের বিষয়, ১৯৯৫ সালে রবিনকে একজন উগ্র দক্ষিণপন্থী ইহুদি হত্যা করার পর ইসরায়েল ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব এমন একজন ইসরায়েলি নেতাকে হারায় যিনি ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন এবং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

উত্তর গাজা ছেড়ে ফিলিস্তিনিদের চলে যেতে ইসরায়েল যে আদেশ দিয়েছে, আন্তর্জাতিক বিশ্ব তার তীব্র বিরোধিতা করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইসরায়েলের পূর্ণমাত্রায় গাজা দখল করে নেওয়াটা হবে ‘বড় ধরনের ভুল’। কিন্তু ইসরায়েল বলেছে, উত্তর গাজার বাসিন্দাদের অবশ্যই দক্ষিণে চলে যেতে হবে।

গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ছাড়া এই যুদ্ধাবস্থার পরে খালি করে দেওয়া এলাকার বিষয়ে ইসরায়েলের কী পরিকল্পনা আছে, সেটি এখনো অস্পষ্ট। এই জায়গাটিকে ইসরায়েল কি একটি বাফার জোন হিসেবে রাখবে নাকি এখানেও তারা ইহুদি বসতি গড়ে তুলবে?

ইসরায়েল যদি সত্যিই তার নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে আন্তরিক হয়ে থাকে, তাহলে তাকে গাজার মতো অতি ঘন বসতিপূর্ণ ক্ষুদ্র একটা এলাকার ভূখণ্ড ছিনিয়ে না নিয়ে নিজের সীমানার মধ্যে বাফার জোন করা উচিত হবে।

গত ৭ অক্টোবর হামাস যে হামলা চালিয়েছে, সেটি ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং যে কোনো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের বিবেচনায় নিন্দনীয়। কিন্তু এর জের ধরে ইসরায়েলি নেতারা যেভাবে গাজায় আরেক দফা দখলাভিযানের কথা বলছেন তা ফিলিস্তিনিদের মনে নাকবার নারকীয় স্মৃতি জাগিয়ে তুলছে।

গাজার উত্তরাঞ্চলে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সিনাই উপদ্বীপে চলে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। বরং ইসরায়েল তাদের জায়গা দখল করে দেয়াল তুলে যে অবৈধ ইহুদি বসতি গড়েছে, তারা এখনো সেই পৈতৃক জমি ফেরত পাওয়ার আশায় আছেন। তা ফেরত না পলেও নিদেন পক্ষে তাঁরা সম্মানের সঙ্গে গাজায় বাস করতে চান।

২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা থেকে একপক্ষীয় সিদ্ধান্তে সরে এলেও ২০০৭ সাল থেকে গোটা গাজাকে ঘিরে রেখে তারা উপত্যকাটিকে একটি উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করেছে। এখন অনেক ইসরায়েলি বলা শুরু করেছেন, ইসরায়েলের পুরো গাজাকেই দখল করে নেওয়া দরকার। সেটি হলে আরও একটি ভয়ংকর সহিংসতা হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এই অবস্থায় ইসরায়েলের এমন একজন সাহসী নেতার উত্থান দরকার যিনি শান্তিতে বিশ্বাস করেন এবং শান্তির কথা মাথায় রেখেই যিনি ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করবেন।

সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত

  • দাউদ কাত্তাব ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিষয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক