উন্নয়ন আর দুর্নীতি যদি মাসতুতো ভাই হয়, তাহলে অর্থনীতি আর রাজনীতি জোড়ের ভাইয়ের চাইতে কম না। দর-দামের থার্মোমিটারে নিত্যপণ্যের গায়ে ‘জ্বর’ ধরা পড়লে রাজনীতির গতরও যে আপনাআপনি গরম হয় তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
জ্বালানির দাম গগনবিহারী হওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় নিত্যপণ্যের গায়ে আগুন ধরেছে। সেই আগুনে রাজনীতির গায়ে জ্বলুনি শুরু হয়েছে। বড়, মেজ, সেজ, ছোট, ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দলের রাজনীতিকেরা জনগণের ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ দশা নিয়ে বেশ সরব হয়েছেন। রাজপথে মিছিল-টিছিলও দেখা যাচ্ছে। গণ অধিকার পরিষদ এবং বাম সংগঠনগুলো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে জোরে শোরে মাঠে নেমেছে। অল্প কিছুদিন আগেও যেসব সরকারবিরোধী স্লোগান উচ্চারণকে সাধারণ মানুষ প্রবল ধৃষ্টতা হিসেবে দেখেছে, অবলীলাক্রমে সেসব স্লোগান তাঁরা দিচ্ছেন। এর মধ্যে বড় চমক দেখিয়েছে বিএনপি।
দীর্ঘদিন রাজপথে ধারাবাহিক অনুপস্থিতির পর তারা বৃহস্পতিবার নয়াপল্টনে যে সমাবেশ করেছে উপস্থিতির সংখ্যা বিবেচনায় তাকে ‘বিশাল’ অভিধা না দিয়ে উপায় নেই। কিন্তু এর মধ্যে বিএনপির চেয়ে বড় চমক দেখিয়েছে এবং দেখাচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারা এসব প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ ঠেকানোর কোনো চেষ্টাই করেনি। এমনকি পুলিশও বিরোধীদের কোনো বাধা দেয়নি। আওয়ামী লীগের গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি ও মাঠ পর্যায়ের আচরণ বিবেচনায় এটি অতি অস্বাভাবিক।
আওয়ামী লীগের এই রহস্যময় নীরবতাই ধারণা করি অনেকের কাছে, এমনকি বিরোধী নেতা-কর্মীদের কাছে সবচেয়ে বড় চমক। আওয়ামী লীগের এই নীরবতা বিএনপিকে কিছুটা হলেও ধন্দে ফেলেছে। ‘নীরবতা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চিৎকার’—এমন উচ্চমার্গীয় দার্শনিক জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে ছাত্রলীগ বিরোধীদের প্রতিহত করতে নামছে না, এমনটা ভাবার সুযোগ কম।
জিনিসপত্রের দাম লাগাম ছাড়া হয়ে গেছে, মানুষের কষ্ট বহুগুণ বেড়েছে—এই বিষয়টি এখন বড় ইস্যু। এই ইস্যুতে যারাই কথা বলবে তাদের প্রতি ভুক্তভোগীদের সমর্থন ও সহমর্মিতা থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। ফলে সুযোগটিকে বিরোধীরা কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে চাইবেই। আন্দাজ করি, বিরোধীদের এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতিজনিত জনদুর্ভোগ ইস্যুতে মিছিল সমাবেশের অবারিত সুযোগ দিলে তা সেই মিছিলের ব্যাপ্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই বিষয়টি সরকার জানে। কিন্তু তারপরও ক্ষমতাসীন দলের নীরবতা থাকাটা বিরোধীদের ধন্দে ফেলারই কথা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন সামনে রেখে সরকারকে বিদেশিরা চাপে রেখেছে। তাই বেশ কিছুদিন ধরে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশে সরকার কোনো ঝামেলা করছে না। তিনি বলেছেন, ‘এখন তারা (সরকার) দেখাচ্ছে যে বিরোধী দলকে সভা সমাবেশ করতে দিচ্ছি।...তারা দেখাচ্ছে, আমরা তো গণতান্ত্রিক দল, আমরা কোনো ঝামেলা করি না।’
এ বিষয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘বিএনপির সমাবেশে আমরা কখনো বাধা দিইনি, দেব না। কিন্তু যদি পেট্রল বোমা বাহিনীদের দেখি তখন কিন্তু আমরা বসে থাকব না, প্রতিরোধ গড়ে তুলব।’ তবে তিনি একটি সম্পূরক হুমকিও দিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা রাজপথে এখনো নামিনি, আগামী মাসে পরিপূর্ণভাবে নামব। রাজপথে নামলে বিএনপি পালানোর জায়গা খুঁজে পাবে না।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমরা রাজপথের পুরাতন খেলোয়াড়। বিএনপি তো এই পথে নতুন। আসুন, রাজপথে মোকাবিলা হবে, ফয়সালা হবে।’
তবে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের বিরোধীরা একটা সুযোগ পাচ্ছে। তারা আন্দোলন করছে। সেটা করুক। আমি নির্দেশ দিয়েছি, তারা আন্দোলন করছে, করতে দাও। খবরদার কাউকে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়।’
তার মানে এটি মোটামুটি নিশ্চিত একটা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত হলেও সরকার বিরোধীদের আন্দোলন করতে কোনো বাধা দেবে না। কেন দেবে না, সে প্রশ্নের জবাব যথেষ্ট জটিল বলেই মনে হয়।
এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার ধারণা, সরকার তার কূটকৌশলের অংশ হিসেবে এই নীরবতার পথ নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘তাদের (আওয়ামী লীগের) অনেক বুদ্ধি। কলাকৌশল জানে।’
প্রশ্ন হলো, সেই ‘কূটকৌশল’ কী হতে পারে?
একটা দিক হতে পারে—সরকার ‘প্রেশার কুকার থিওরি’ অবলম্বন করছে। প্রেশার কুকারে বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ঢাকনা এমনভাবে আটকানো থাকে যা থেকে কোনো বাষ্প বের হতে পারে না। ফলে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয় এবং সে কারণে দ্রুত রান্না হয়। কিন্তু ভেতরের বাষ্পের চাপ সহনীয় মাত্রা ছাড়ানোর আগেই ‘শিস’ দিয়ে কিছুটা বের করে দেওয়া হয়। এতে ভেতরের চাপ আবার সহনীয় মাত্রায় চলে আসে। ভেতরের বাষ্পকে কিছুটা বের হতে না দিলে প্রেশার কুকার বিস্ফোরিত হতে পারে।
সরকার ও বিরোধী—উভয়ের মূল চিন্তার মধ্যে জনস্বার্থ কতখানি আছে এবং তা নিয়ে জনগণের মনে যে ঘোর সংশয় আছে তা তারা কেউই কাটাতে পারেনি। তারা প্রত্যেকেই দৃশ্যত জনগণের পাশে দাঁড়ানোর নামে তাঁদের মাথার ওপর ‘ইস্যু’ নামক কাঁঠাল ভাঙতেই ব্যস্ত।
যেহেতু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ কষ্টে পড়েছে, সে কারণে বিরোধীদের এসব বিক্ষোভ কর্মসূচিতে তাদের সমর্থন থাকা স্বাভাবিক। এ অবস্থায় বিরোধীদের বাধা দিলে তা অবরুদ্ধ জনক্ষোভকে আরও ঘনীভূত করতে পারে। টানা চাপ বাড়িয়ে দিলে সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হয় না, বরং আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে যায়। কিছুটা কথা বলার অধিকার দিয়ে জনক্ষোভ খানিকটা কমিয়ে ফেললে আন্দোলনের তীব্রতা কমে যায়। সেটি মাথায় রেখে বিরোধীদের ক্ষোভ বিস্ফোরণ পর্যায়ে যাওয়ার আগে ‘প্রেশার কুকারের শিস’ দিয়ে তথা খানিকটা মিছিল সমাবেশ করতে দিয়ে তা সহনীয় মাত্রায় রাখার কৌশল সরকার নিয়ে থাকতে পারে।
আরেকটি হতে পারে, মানবাধিকার রক্ষা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকার নিজেকে আগের চেয়ে উদার হিসেবে তুলে ধরতে আগ্রহী হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে সফররত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলের সঙ্গে সিরিজ মিটিংয়ে সরকারের দিক থেকে এ বার্তা দেওয়া হয়েছে।
সেই বিবেচনায় বিরোধীদের অবাধে মিছিল সমাবেশ করতে দেওয়ার বিষয়ে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে।
সরকার বলছে, জনগণকে ভবিষ্যত কালের বড় বিপদ থেকে বাঁচানোর কথা মাথায় রেখে বর্তমান কালে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিরোধীরা বলছে, সরকারের অতীত কালে করা লুটপাটজনিত আর্থিক ঘাটতি পূরণের জন্য তেলের দাম বাড়িয়ে জনগণকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে জনগণের পাশে দাঁড়াতে তাঁরা আন্দোলন করছেন।
তবে সরকার ও বিরোধী—উভয়ের মূল চিন্তার মধ্যে জনস্বার্থ কতখানি আছে এবং তা নিয়ে জনগণের মনে যে ঘোর সংশয় আছে তা তারা কেউই কাটাতে পারেনি। তারা প্রত্যেকেই দৃশ্যত জনগণের পাশে দাঁড়ানোর নামে তাঁদের মাথার ওপর ‘ইস্যু’ নামক কাঁঠাল ভাঙতেই ব্যস্ত।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ইমেইল: sarfuddin2003@gmail.com