মতামত

বিসিএসের বাইরের চাকরিপ্রার্থীদের দুঃখ-বেদনা

চলতি বছরের ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হলো ১৫ মার্চ। সারা দেশে প্রায় ১৮ লাখ পরীক্ষার্থী অংশ নেন এ পরীক্ষায়। অন্যান্য পরীক্ষার মতো এখানেও পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।

ওই দিন সকালে রাজধানীর মিরপুরের মনিপুর স্কুল কেন্দ্রে নিবন্ধন পরীক্ষার প্রশ্ন হাতে পেয়েই হতবাক হন পরীক্ষার্থীরা। পরীক্ষার প্রশ্নই ছিল ভুল। ভুল-সঠিকের গ্যাঁড়াকলে সকাল সাড়ে ৯টার পরীক্ষা শুরু হয় সাড়ে ১০টায়। আরেকটি কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র ফটোকপি করে এনে নেওয়া হয় এই কেন্দ্রের পরীক্ষা।

কুমিল্লার একটি কেন্দ্রেও ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পরীক্ষার্থীরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইনভিজিলেটরদের (শিক্ষক) দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তাঁরা ভুল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা চালিয়ে যান। এতে বিষয়ভিত্তিক পার্থক্য থাকার কারণে বিভ্রান্তিতে পড়েন পরীক্ষার্থীরা।

পরীক্ষা শেষে ভুক্তভোগীরা কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে উপস্থিত হয়ে বিষয়টির প্রতিবাদ করেন।

একজন পরীক্ষার্থী জানান, প্রথমে হল কর্তৃপক্ষ ভুল প্রশ্ন দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরীক্ষা শেষে দেখা যায়, সাধারণ স্কুল পর্যায়ের প্রশ্নের জায়গায় কারিগরি–ইবতেদায়ি পর্যায়ের প্রশ্ন অদলবদল হয়েছে। 

বাংলাদেশে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষাই সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। অনেকটা বিসিএসের আদলে। প্রথমে প্রিলিমিনারিতে বহু নির্বাচনী (এমসিকিউ) পরীক্ষা, সেটিতে উত্তীর্ণরা বিষয়ভিত্তিক লিখিত পরীক্ষা দেন। সেখানে উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হবে চূড়ান্ত বাছাইয়ের জন্য। আবার চূড়ান্ত বাছাইয়ে যাঁরা টিকবেন, তাঁরা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শূন্য পদের বিপরীতে পদায়ন পাবেন।

ভুল প্রশ্নপত্রের কারণে যেসব পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা খারাপ হয়েছে, তাঁদের কী হবে? তাঁদের কি নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। যদি না দেওয়া হয়, তাহলে পরবর্তী নিবন্ধন পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এ কারণে অনেকের চাকরির বয়স থাকবে না। এই গাফিলতির জবাব কী।

বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ। একটি বিসিএস পরীক্ষা শেষ করতে যেখানে এক থেকে দেড় বছর লাগে, বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হতে তিন থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যায়।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় পিএসসির মাধ্যমে। কখনো আলাদা পরীক্ষা, কখনো বিসিএসের নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগ হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে। সেখানেও লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা হয়।

সেখানে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়, তার কিছু আলামত সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের সরকারি বাসভবনে পাওয়া গেছে। সেখানে কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী ঘুষ দিয়ে চাকরি না পেয়ে অভিযোগ করতে এসে প্রতিমন্ত্রীর লোকদের হাতে লাঞ্ছিত হন। পরে ডিবি পুলিশের মধ্যস্থতায় ঠিক হয়, টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা হয়।

আগে ব্যাংকগুলো আলাদা পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দিত। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সমন্বিত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে থাকে। তবে সেখানেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত।

বাংলাদেশে এক বড় জনগোষ্ঠী এখন বেকার তরুণ–যুবকেরা। কিন্তু রাষ্ট্রের যাঁরা মালিক-মোক্তার, তাঁরা এই বেকারদের নিয়ে খুব ভাবনাচিন্তা করেন বলে মনে হয় না। নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে বেকার সমস্যা সমাধানে কিছু গৎবাঁধা কথা বলেন। নির্বাচনের পর সেটাও ভুলেও যান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় ২০২১ সালের ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে অফিসার (ক্যাশ) নিয়োগের প্রাথমিক পরীক্ষা হয়। ১ হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে এই পরীক্ষায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ চাকরিপ্রত্যাশী অংশ নেন।

প্রশ্নপত্রের কারণে কোনো পরীক্ষা বাতিল হলে চাকরিপ্রার্থীদের দুর্ভোগ-যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়। আর বাতিল না হলে যোগ্যদের স্থলে ঘুষদাতাদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। ২০২১ সালের ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

এর বাইরে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর পরীক্ষার মাধ্যমে যেসব নিয়োগ দেয়, সেসব ক্ষেত্রেও চাকরিপ্রার্থীদের বিড়ম্বনা, দীর্ঘসূত্রতা ও উৎকোচ লেনদেনের অভিযোগ আছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী।

২১ মার্চ ডেইলি স্টার ইউরোপগামী বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে। যার শিরোনাম ‘ডেসপারেট ফর আ হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোম’। বিপুলসংখ্যক তরুণ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন তার একটাই কারণ, দেশে কাজের সুযোগ নেই।

প্রতিবেদনটি বলছে, ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ৩৩ হাজার ৭৩১ জন বাংলাদেশি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। তাঁরা চাকরি নিয়ে যাননি। অনেকে দালালদের খপ্পরে পড়ে যেসব কাগজপত্র নিয়ে গেছেন, সেগুলোও ভুয়া। ফলে তাঁরা দেশহীন মানুষ।

ওই পত্রিকারই ২৫ ফেব্রুয়ারির আরেকটি খবর হলো, সরকারি চাকরির ১৯ লাখ পদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশের বেশি পদ এখন শূন্য। নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করতে কর্তৃপক্ষের অনীহার কারণেই নাকি এটি হয়েছে।

২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি অফিসগুলোয় সরকারি শূন্য পদের সংখ্যা ৫ লাখ ৩ হাজার ৩৩৩। এতটি শূন্য পদ থাকার কারণ কী? যাঁরা প্রশাসনে উচ্চ পদে আসীন, তাঁরা কি চান না নতুন করে কেউ চাকরি পাক। বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসনে চলছে চরম বিশৃঙ্খলা। ওপরের স্তরে পদ না থাকা সত্ত্বেও তরতর করে পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছেন কর্মকর্তারা। আর নিচের স্তরে লাখ লাখ শূন্য পদ। এক-চতুর্থাংশ পদ শূন্য রেখে প্রশাসন চলে কী করে। হয় পদগুলো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হোক, না হয় শূন্য পদের বিপরীতে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হোক।

বাংলাদেশে এক বড় জনগোষ্ঠী এখন বেকার তরুণ–যুবকেরা। কিন্তু রাষ্ট্রের যাঁরা মালিক-মোক্তার, তাঁরা এই বেকারদের নিয়ে খুব ভাবনাচিন্তা করেন বলে মনে হয় না। নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে বেকার সমস্যা সমাধানে কিছু গৎবাঁধা কথা বলেন। নির্বাচনের পর সেটাও ভুলেও যান।

কয়েক দিন আগে বিসিএস চাকরিপ্রার্থীদের দুর্ভোগ নিয়ে লিখেছিলাম। ওই লেখার পর ৪১তম বিসিএসে ২ হাজার ৪৫৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকারি কর্ম কমিশন সুপারিশ করেছিল ২ হাজার ৫২০ জনের নাম। সেখান থেকে ৬৭ জন কেন বাদ পড়লেন? পুলিশের ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণে যদি তাঁদের পদায়ন আটকে যায়, সেটা চরম দুর্ভাগ্যজনক।

রোজার মাস বলে এখন চাকরির পরীক্ষা কম। আশা করা যায় রোজার পর সরকারি-বেসরকারি খাতে চাকরির পরীক্ষা পুরোদমে শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীদের দুটি ন্যায্য দাবি কর্তৃপক্ষ আমলে নেবে আশা করি। একটি হলো, সব পরীক্ষার স্থান ঢাকায় না করা। দ্বিতীয়টি, একই দিনে একাধিক পরীক্ষা না রাখা। কেবল শুক্রবারই কেন চাকরির পরীক্ষা হবে? শনিবার এমনকি অফিস চলাকালেও হতে পারে। অনেক দেশেই এই নজির আছে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি। ই–মেইল: sohrabhassan55@gmail.com