মতামত

ওমর সানীকে কেন সাধুবাদ জানাতে হয়

বিশ্ববাজারে প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম কমছে, আর আমাদের বেড়েই চলেছে। এ যেন মুখস্থ করতে কষ্ট হয়ে যাওয়া ব্যস্তানুপাতিকের কোনো গাণিতিক সূত্র। ওএমএসের লাইনে দাঁড়িয়ে রাত পার করে দেওয়ার খবর তো আমরা হরহামেশাই দেখি। কার্ড করে দেওয়ার আগপর্যন্ত করোনার পর টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের অসহায়ত্বের যে দৌড় আমরা দেখেছি, তা–ও আদৌ ভোলার নয়।

কিছুদিন পরপর একেকটি পণ্যের লাগামহীন দাম বাড়ে, আর পত্রিকার খবর বের হয়, কয়েক সপ্তাহে বাজার থেকে শত বা হাজার কোটি টাকা তুলে নিল সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মিছে হুংকার দিতে দিতে আমাদের মন্ত্রীদের তামাশাও ঢের দেখা হয়ে গেছে। তাঁদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, ‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি’ ছড়ার মতো সিন্ডিকেটদেরই ‘দুধমাখা ভাত’ খাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন তাঁরা।

বাজারে গেলে বা রান্নাঘরে ঢুকলে বা খাবার টেবিলে বসলেই বোঝা যায়, দ্রব্যমূল্য কতটা বিষধর সাপ হয়ে মানুষের গলা পেঁচিয়ে ধরেছে। আর ঘরে রান্না না করলেও বাজারে না গেলেও দোকানে বা হোটেল রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেও বোঝা যায়।

একটা সময় গাড়িভাড়া বাড়লে বাসের হেলপারের সঙ্গে চিল্লাফাল্লা হতো, চায়ের দাম বাড়লে টংদোকানিদের সঙ্গে, খাবারের দাম বাড়লে হোটেলমালিকের সঙ্গেও। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। সবাই যার যার জায়গায় ভুক্তভোগী, এটি যেমন বুঝে গেছে, তেমন সয়েও যেতে হবে, সেটিও বুঝে গেছে।

কবি শঙ্খ ঘোষের ‘চুপ করো, শব্দহীন হও’—এই লাইন যেন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছে সবাই। একটা সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, বাম দল ও ছাত্রসংগঠনগুলো দ্রব্যমূল্যের বিরুদ্ধে মিছিল বের করত, নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বরও আমরা শুনতাম। সেসব যে এখনো হয় না, তা না। কিন্তু কেমন জানি ফিকে হয়ে গেছে।

রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের চাপে পেটের অধিকার এখন চ্যাপটা। মাঝেমধ্যে বিশিষ্টজনেরা একজোট হয়ে পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে থাকেন। কেউ সেগুলো পড়েন বলে মনে হয় না, সরকার আমলে নেওয়া তো দূরে থাক।

রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে সর্বদা সরব থাকেন বলিউড তারকারা

এমন সময় একসময়কার বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক ওমর সানীর বক্তব্য কিছুটা চমকে দিয়েছেই বলা যায়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাঁকে নিয়ে দেখা যায় সরবতা। সংবাদমাধ্যমগুলোও ঘটা করে সানীর বক্তব্য প্রচার করেছে। সানী কী বলেছেন? গত রোববার ফেসবুকের নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে তিনি পোস্ট দেন এটা লিখে, ‘সাধারণ মানুষ কি খাবে বলে দেন সরকার। খাবারের লিস্ট দিয়ে দেন আমরা কী খাব, আর পারছি না রাষ্ট্র।’

তাঁর এ বক্তব্য নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে সানীর আরও দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। একটি রেস্তোরাঁর মালিক হিসেবে তাঁর যে উপলব্ধি, সেসবই সাধারণ মানুষ ও নানা পেশাজীবীর কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই।

ওমর সানী বলছেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসার শুরুতে যে মেনু তৈরি করেছি ৩২ টাকায়, পাঁচ থেকে ছয় মাসের ব্যবধানে তা এখন ৭০-৭৫ গেছে। গরুর মাংস হয়ে গেছে কেজি ৫৫০ টাকা থেকে এখন ৮০০ টাকা। গরিবের খাবার পাঙাশের দামও এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আর অন্যদিকে কলকাতার বাজারে এক হাজার টাকায় এক হালি ইলিশ পাওয়া যায়।

তিনি বলছেন, ‘এ দেশের আর সাধারণ মানুষেরা কী অবস্থায় আছে! ভাবলেই যেন অস্থির লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসে।...স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সাধারণ ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আমাদের যেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পাওয়ার কথা, সেসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কেন!’

সানীর বক্তব্য নিয়ে সরকার দলীয় কেউ কেউ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, সানী রাজকীয় জীবনযাপন করে কীভাবে এমন কথা বলেন? তাছাড়া কয়েক বছর আগেও আওয়ামী লীগের পেছনে ধরনা দিয়ে এখন তিনি দূরে সরার বাহানা করছেন।

জাতীয় নির্বাচন থেকে সিটি নির্বাচন—সব জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তারকাদের অনেকে। গত ১০ বছরে যে পরিমাণ তারকা সরকারি দল থেকে নির্বাচনী প্রার্থী হতে চেয়েছেন, এমন কি আগে কখনো দেখা গিয়েছিল? ভোটহীন বা একপক্ষীয় নির্বাচনে সহজে সংসদ সদস্য হয়ে যাওয়ার ‘লোভ’ সামলানো কীভাবে সম্ভব!

যদিও প্রথম আলোকেই সানী বলছেন, ‘...বাজারে যেতে হয় আমাদের। আমাদের সংসার আছে। আমাদের আয়ের উৎস তো আর অন্য কিছু না।...গত ২৫ বছরে আমরা হিসাব করিনি।...কিন্তু দুই থেকে তিন বছর ধরে হিসাব করে যাচ্ছি। হিসাব করে খাচ্ছিও। ...আমরা ভাই দল করি না, কিছুই করি না। ...আমরা একেবারে সাধারণ মানুষ। নিজেদের ভিআইপি মনে করি না। ...এই রাষ্ট্র আমার, আমার বাপের, আমার চৌদ্দগুষ্টির। তো রাষ্ট্র কেন আমাদের পরিচালনা করতে ব্যর্থ হবে! মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে কেন জিম্মি থাকতে হবে রাষ্ট্রকে।’

কথা হচ্ছে, ওমর সানী যদি রাজার হালতেও থাকেন, তাঁর যদি দ্রব্যমূল্যের কষ্ট না ছোঁয়ও, তাহলে কেন তিনি মানুষের দুঃখ–দুর্দশা নিয়ে কথা বলবেন না? আমাদের খেলা বা বিনোদনজগতের সেলিব্রিটি বা তারকারা কি ‘সাবঅল্টার্ন’? তাঁদের নিয়ে তো গায়ত্রী স্পিভাক কখনো বলেননি—‘ক্যান দ্য সেলিব্রিটি স্পিক?’ হলিউড–বলিউডের তারকাদের অনেককেই যেখানে মানুষের অধিকারে কথা আমরা বলতে শুনি, সামাজিক সমস্যা–সংকটে আওয়াজ তুলতে দেখি, আমাদের এখানে তা হয় না কেন?

মি টু আন্দোলনে বলিউড–হলিউডের তারকারা গোটা দুনিয়ায় সারা ফেলে দিলেন, আর আমরা থেকে গেলাম সেই দুনিয়ার বাইরে। বলিউডের জনপ্রিয় তারকা–নির্মাতাদের অনেকেই কখনো এনআরসির বিরুদ্ধে মাঠে নামছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি দলের সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ও পুলিশের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন, শাহীনবাগের সংগ্রামী নারীদের কাছে গিয়ে বসছেন, দিল্লির সাম্প্রদায়িক হামলার বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, কাশ্মীরিদের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন, পাঞ্জাবের কৃষকদের আন্দোলনেও সংহতি প্রকাশ করছেন। এ নিয়ে নানা হুমকি–ধামকির শিকার হলেও মানুষের পক্ষেই থাকছেন তাঁরা।

তাঁদের অনুসরণ–অনুকরণ সব ঠিকই চলে, কিন্তু এসবের বেলায় আমাদের তারকারা যেন গুনগুন করে শ্যামল মিত্রের গান গেয়ে যান—আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারা দিন। মূলত প্রতিবাদের স্পৃহা তো অনুসরণ–অনুকরণের বিষয় নয়, এটি জেগে উঠতে হয় ভেতর থেকে। যেভাবে স্বাধীন বেতার বাংলার শিল্পীরা বা কলকতায় শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে আমাদের শিল্পীসমাজ নানাভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সাম্প্রতিককালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোর আন্দোলনের সময় আমাদের কিছু তারকাদের সর্বশেষ মুখ খুলতে দেখা গিয়েছিল।

মি টু আন্দোলনের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় তৈরি করেছিলেন হলিউড তারকারা

ফোর্বস ম্যাগাজিন এক প্রতিবেদনে বলছে, একজন সেলিব্রিটি বা তারকা কোনো কোম্পানির পণ্যের পক্ষে বলে তখন ওই পণ্যের তৎক্ষণাৎ বিক্রির হার ৪ শতাংশ বেড়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, তারকারা আসলে কতটা প্রভাব ফেলেন সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ভক্তদের মধ্যে। এ থেকে একটি ধারণা পাওয়া যায়, সামাজিক ইস্যুগুলো নিয়ে তাঁরা কথা বললে বা আওয়াজ তুললে মানুষের মধ্যে কেমন সচেতনতা তৈরি হয়।

বলিউড–হলিউড বা অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের মধ্যে কমবেশি এটি দেখা যায়। পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, নারী ও শিশুর অধিকার, প্রাণির প্রতি ভালোবাসা কত কিছু নিয়ে তাঁরা কথা বলেন, অনেকে নানা সংগঠন গড়ে তুলেন, স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচি চালান; বাইরের কত তারকা আমাদের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘুরে গেলেন, তেমনটি এখানে দেখা যায় না বললেই চলে।

বর্তমান সময়ে আমাদের তারকারা যথেষ্ট রাজনৈতিক হয়ে উঠছেন ঠিকই, তবে সেই রাজনীতি কতটা মানুষের অধিকারের পক্ষে, কতটা গণতন্ত্রের পক্ষে—তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট কারণ আছে। জাতীয় নির্বাচন থেকে সিটি নির্বাচন—সব জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তাঁদের অনেকে।

গত ১০ বছরে যে পরিমাণ তারকা সরকারি দল থেকে নির্বাচনী প্রার্থী হতে চেয়েছেন, এমন কি আগে কখনো দেখা গিয়েছিল? ভোটহীন বা একপক্ষীয় নির্বাচনে সহজে সংসদ সদস্য হয়ে যাওয়ার ‘লোভ’ সামলানো কীভাবে সম্ভব! সেই লোভের মৌমাছি হতে গেলে তো সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে তাঁদের চুপই থাকতে হবে। সেদিক দিয়ে অন্তত একজন ওমর সানী কথা বলেছেন, এর জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com